বেশির ভাগ বাসাবাড়ি ও দোকানে জ্বালানি সাশ্রয়ী এলইডি বাতির ব্যবহার দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, আগের তুলনায় দেশে জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষতা বেড়েছে। আবার উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার ক্রমে বাড়লেও মানুষের মাঝে সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের চেয়ে ব্যয়বহুল জ্বালানি সাশ্রয়ী শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র কেনার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এদিকে শিল্প খাতে জ্বালানি দক্ষ মোটর ও বয়লার, এলইডি টিউব লাইট, ইন্সুলেশন, ভার্টিক্যাল রোলার মিল এবং জেনারেটর থেকে নির্গত তাপের ব্যবহার বেড়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে অনেকেই জ্বালানি সাশ্রয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং কার্বন নির্গমন হ্রাসের চাপ পোশাকশিল্প খাতে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বাধ্যবাধকতা তৈরি করেছে। বলে রাখা প্রয়োজন, সবুজ কারখানার সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ পৃথিবীতে শীর্ষস্থান দখল করেছে। তারপরও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনুমোদিত নতুন টেকসই রূপরেখার ফলে পোশাকশিল্প খাতে জ্বালানি দক্ষতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।   
তিন বছর ধরে আমরা মূলত জ্বালানি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বারবার মূল্য সমন্বয় করার পরও আমদানি-নির্ভরতা এবং বিদ্যুৎ খাতে মাত্রাতিরিক্ত লোকসানের কারণে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরকারকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়েছে। এবারও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা সমাধানে সরকার আশ্বস্ত করেছে। তবে বকেয়া বিল ও ডলার সংকটের কারণে নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কা থেকেই যায়। ফলে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাত এ বছরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।

এদিকে জ্বালানি সংকটের মাঝে বাংলাদেশ সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম প্রায় আড়াই গুণ করার পরিকল্পনা করেছে। যদিও অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভবিষ্যতে জ্বালানি আর আগের মতো সুলভ মূল্যে পাওয়া যাবে না। সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির দিকে তাকালে বোঝা যায়, সরকারকে ভবিষ্যতে বিদ্যুতের দাম আরও সমন্বয় করতে হবে। এ অবস্থায় খরচ বাঁচাতে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ সবার (বাসাবাড়ি, বাণিজ্যিক ভবন এবং কারখানা) জন্যই লাভজনক। আবার বিভিন্ন খাতে জ্বালানি সাশ্রয়ের সুযোগের পুরো সুবিধা আমরা নিতে পারিনি। ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিসিসের (আইইইএফএ) গবেষণায় দেখা যায়, শিল্প খাতে ব্যবহৃত গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ জেনারেটরের দক্ষতা আগের চেয়ে বাড়লেও তা এখনও ৩৫.

৩৮ শতাংশ, কিন্তু বাজারে ৪৫.২ শতাংশ দক্ষতার গ্যাস জেনারেটর পাওয়া যায়। অন্যদিকে শিল্প খাতে প্রায় ৪৪ শতাংশ গ্যাস জেনারেটর থেকে নির্গত তাপকে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে না। পুরোনো এবং অদক্ষ জেনারেটরকে জ্বালানি দক্ষ জেনারেটর দিয়ে প্রতিস্থাপন এবং জেনারেটর থেকে নির্গত তাপ কারখানায় পুরোপুরি ব্যবহার করা হলে বছরে প্রায় ৪৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমানো সম্ভব (প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম যদি মাত্র ৯.৫ ডলার ধরা হয়)। এমনও শিল্পকারখানা রয়েছে, যেখানে বয়লার সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না বিধায় গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে গ্যাসের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। আবার বাসাবাড়িতে জ্বালানি দক্ষ যন্ত্র কেনার প্রবণতা বেড়েছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না।      

২০২০-২১ সালের দিকে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও তা অনেকটা স্তিমিত। এ সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে, যাতে মানুষ জ্বালানি দক্ষ যন্ত্রপাতি ব্যবহারে উৎসাহী হয় এবং এর আর্থিক সাশ্রয় অনুধাবন করতে পারে। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির জ্বালানি দক্ষতার স্ট্যান্ডার্ড এবং লেভেল নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলে মানুষ জ্বালানি দক্ষ যন্ত্রপাতি কেনায় সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এ বিষয়ে টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) কাজ করে যাচ্ছে।   
সচেতনতামূলক কার্যক্রমের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো জ্বালানি ব্যবহারে অপচয় রোধে মানুষকে উৎসাহিত করা এবং তাদের অভ্যাসে পরিবর্তন আনা। উন্নত দেশগুলোয় এ ধরনের কার্যক্রম প্রায়ই পরিচালনা করা হয়। আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র যাতে ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে রেখে না ব্যবহার করা হয়, তা নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। ভারতে পরিচালিত গবেষণায় জানা যায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহারের সময় প্রতি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বাড়ানো হলে প্রায় ৬ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। এ ক্ষেত্রেও সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। 

অন্যদিকে শিল্পকারখানায় জ্বালানি দক্ষতা আরও বাড়াতে হলে জ্বালানি নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের শিল্প খাতে জ্বালানি নিরীক্ষার প্রবণতা বেড়েছে মূলত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার দেওয়া কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে। তবে পর্যাপ্ত অর্থায়নের সুযোগ না থাকায় অনেক শিল্পকারখানাতেই জ্বালানি নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসা বিভিন্ন সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি কিংবা বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। স্রেডা এ পর্যন্ত ১৮৯ প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত ভোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্রেডা একটি ডেটাবেজ তৈরি করবে, যেখানে জ্বালানি ব্যবহার এবং সাশ্রয়ের সম্ভাবনা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত থাকবে। তবে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে মনোনীত ভোক্তাদের জ্বালানি ব্যবহার কমানোর লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জিত হলো কিংবা কোনো প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কিনা, তা স্রেডাকে পর্যবেক্ষণ এবং সমাধানের পথ বের করতে হবে।   
জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে নেওয়া প্রকল্পে যন্ত্রপাতি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়। সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে ঋণ পেলে প্রকল্পগুলো আর্থিকভাবে লাভজনক হয়। সবুজ প্রকল্পে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ৫ শতাংশ সুদে প্রদেয় পুনঃঅর্থায়ন জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

সচেতনতার অভাবে কিংবা জটিলতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিলগুলোর ব্যবহারের হার অনেকটাই কম। অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে পুনঃঅর্থায়নের প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হলে তা দেশের জ্বালানি খাতের জন্য হবে মঙ্গলজনক। 
জাইকার অর্থায়ন সুবিধায় বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল) এবং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) ঋণে বেশ কিছু কারখানায় জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এ ছাড়া ইডকল কর্তৃক সবুজ জলবায়ু তহবিলের আওতায় গৃহীত প্রকল্প পোশাকশিল্প খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে বলে ধারণা করা যায়।

পরিশেষে আমদানি করা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল এই দেশে জ্বালানি আমদানিতে প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান নিয়ে যত আলোচনা হয়, তার চেয়ে অনেক কম আলোচনা হয় জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে। সঙ্গে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। তবে জ্বালানি নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও জ্বালানির মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই । আর এতে 
প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ, অনুকূল নীতিমালা, অর্থায়ন এবং সব অংশীজনের সচেতনতা।  

শফিকুল আলম: প্রকৌশলী ও পরিবেশ অর্থনীতিবিদ
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র ব যবহ র ব যবহ র ক প রকল প সরক র আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির, ভারত এখন কী করবে

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অস্থিতিশীলতা নতুন কিছু নয়। তবে এখন যে অস্থিরতা এ অঞ্চলে চলছে তা ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর পাশাপাশি ভারতকে আগের চেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

সাম্প্রতিক নেপালের সহিংস অস্থিরতা তারই উদাহরণ। শুধু নেপালের ঘটনা নয়। ভারতের পূর্বদিকে বাংলাদেশে ২০২৪ সালে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল এবং তার জের ধরে সেখানে সরকার পতন হয়েছিল; সেই সংকটের মীমাংসা এখনও হয়নি।

অন্যদিকে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ড নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠেছে। কারণ সেখানে আদালতের রায়ে প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করা হয়েছে ও সম্প্রতি কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্তে তাদের একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে।

আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে অন্তত ৮০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ নাগরিকের পাশাপাশি যোদ্ধারাও আছেন।

আরও পড়ুনভারত ও চীনের টানাটানিতে পড়েছে নেপাল৩১ জুলাই ২০২০

ভারতের পশ্চিমে পাকিস্তান এখনও অতীতের ‘ভূতদের’ সঙ্গে লড়াই করছে। উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠী, দুর্বল অর্থনীতি আর অকার্যকর শাসনব্যবস্থা পাকিস্তানকে অস্থির করে রেখেছে। ভারতের দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা তিন বছর আগে প্রেসিডেন্টকে সরানোর পর আপাত শান্ত হয়েছে। কিন্তু দেশটির অর্থনীতি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। আর উত্তরে চীনের আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টাও এই অস্থিরতার বড় কারণ হয়ে আছে।

ভারতের জন্য এসব সংকট মোটেও দূরের কোনো ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ ইতিমধ্যেই পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে অস্বস্তি তৈরি করছে। পাকিস্তানের সীমান্তপারের সন্ত্রাসের হুমকি এ গ্রীষ্মে কাশ্মীরে প্রায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেলেছিল। আর এখন নেপালের অস্থির রাজনীতি চীনের জন্য নতুন করে হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছে। এত বড় এক অস্থিরতার বলয়কে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই।

এখন কীভাবে এই ধাক্কাগুলো সামলানো যায় এবং কীভাবে গোটা অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা যায়, সেটিই ভারতের নেতৃত্বের সামনে মূল প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।

নেপাল দিয়েই শুরু করা যাক। দেশটি দুই দশক আগে দীর্ঘ মাওবাদী বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে যে উচ্চাভিলাষী সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, তা টিকিয়ে রাখতেই তারা হিমশিম খাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল, বিতর্কিত ও ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। পক্ষপাত, দুর্নীতি আর রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে স্থিতিশীলতার আশা বারবার ভেঙে পড়েছে। সম্প্রতি যেসব ভয়াবহ সহিংসতা ঘটেছে, তা আসলে এই গভীর অস্থিরতার লক্ষণ।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আছে, তারা আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে বা মানবাধিকারের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে অর্থনীতি কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্প ছিল, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া শুল্কনীতির কারণে সেটিও এখন টালমাটাল।

আরও পড়ুনভারত ‘তুমি রিয়েলিটি মাইন্যে ন্যাও’০৪ ডিসেম্বর ২০২৪

সাদা চোখে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর কম্বোডিয়ার সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষকে ততটা গুরুতর মনে নাও হতে পারে। কিন্তু ভারত তার ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির অধীনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত ১০ দেশ ও তাদের ৬০ কোটিরও বেশি মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক গড়ছে।

এই অঞ্চলের যে কোনো অশান্তি সেই প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলবে। তাছাড়া থাইল্যান্ড বহুদিন ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করেছে। যদি এর প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয় কিংবা বা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের শান্তি-প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কম্বোডিয়ার সঙ্গে থাইল্যান্ডের বিরোধ আরও বেড়ে যায়, তাহলে ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক করিডরের স্বপ্নই ভেঙে পড়তে পারে।

পাকিস্তানকে ‘চিরকালীন সংকটে থাকা দেশ’ বলা হয়তো কঠিন শোনায়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটিই বাস্তবতা। সেখানে বারবার বেসামরিক সরকারকে দুর্বল করা হয়েছে। যেমন, ২০২২ সালে ইমরান খানের নির্বাচিত সরকার সেনাবাহিনীর ইশারায় ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। রাজনীতি রক্তক্ষয়ী খেলায় পরিণত হলে চরমপন্থীরা মাথা তোলে, আর নাজুক অর্থনীতি সেই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। পাকিস্তানে সেটিই দেখা গেছে।

আরও পড়ুননেপালের গণ–অভ্যুত্থান ভারতের মাথাব্যথা বাড়াল১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভারতের দৃষ্টিতে পাকিস্তানের এই সংকট শুধু অভ্যন্তরীণ নয়। এগুলো প্রায়ই কাশ্মীর সীমান্ত পেরিয়ে সন্ত্রাস ছড়ায়, আঞ্চলিক শান্তির সম্ভাবনা নষ্ট করে, এমনকি পারমাণবিক সংঘাতের শঙ্কাও তৈরি করে। ভারত যখন বাইরের দিকে তাকাতে চায়, এই স্থায়ী অস্থিতিশীলতা তখন ভারতকে উপমহাদেশের দাবার ছকে আটকে রাখে। এর সঙ্গে পাকিস্তান-চীন জোট মিলে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এটি নিকট ভবিষ্যতে বদলানোর সম্ভাবনা কম।

এসব ঘটনা মিলিয়ে যে বড় প্রবণতা স্পষ্ট হচ্ছে, তা হলো: ভারতের চারপাশে গণতন্ত্র পিছিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংবিধান বারবার বদলানো হচ্ছে এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আদালতকে ব্যবহার হচ্ছে। দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক সেনাপ্রধান রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন। রাজনৈতিক নেতাদের কখনো কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, কখনো নির্বাসনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের জন্য এ প্রবণতা মোকাবিলা করা জরুরি। আর এখন আরও দৃঢ় আঞ্চলিক কৌশল ছাড়া উপায় নেই। বাস্তবে পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে সংকট দেখা দিলে ভারতই প্রথম ভরসা। তবে যখন কোনো দেশ মনে করে তাদের ভারতের সাহায্য দরকার নেই, তখন তারা ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগকেও গুরুত্ব দেয় না।

আরও পড়ুননেপালের অভ্যুত্থান নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া যেভাবে মিথ্যা বয়ান হাজির করছে১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ভারতের চারপাশের অশান্ত পরিস্থিতিই যথেষ্ট কঠিন। তার ওপর বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট আরও অনিশ্চয়তা যোগ করছে। ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া নীতি এতটাই খামখেয়ালি যে, ছোট দেশগুলো এখন নিরাপদ থাকতে বিকল্প পথ খুঁজছে। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পর্যন্ত প্রশ্ন উঠছে—চীন যখন শক্তি প্রদর্শন করছে আর মার্কিন নিরাপত্তার ছাতার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে, তখন কি তাদের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের পথে হাঁটা উচিত না?

ভারত যদিও এ ঝড়ের মুখে দৃঢ় থেকেছে, তবুও আঞ্চলিক টানাপোড়েন আর ট্রাম্পসৃষ্ট অস্থিরতা ভারতের বহুদিনের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন ধরে রাখাকে কঠিন করে তুলছে। এখন ভারতের কাজ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করা নয়, বরং সম্পর্কের কৌশলগত, প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক মূল ভিত্তি ধরে রাখা। পাশাপাশি আচমকা মার্কিন নীতি পরিবর্তনের ধাক্কা সামলানোর প্রস্তুতি নেওয়াও দরকার।

ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য চায় না। তার লক্ষ্য হলো এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, নীতিনির্ভর ও সংযুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলা যেখানে অতীতের বারবারের সংকট সরে যাবে এবং সে জায়গায় ভবিষ্যতের দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

নিরুপমা রাও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব এবং চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত

সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • প্রতিবেশী দেশগুলো অস্থির, ভারত এখন কী করবে