নরসিংদীতে ১২ দিনে শিশুসহ ৮ জন ধর্ষণের শিকার
Published: 15th, March 2025 GMT
নরসিংদীতে একের পর একের এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। নরসিংদী ১০০ শয্যা সদর হাসপাতালের আরএমও-এর দেওয়া তথ্য মতে মার্চের ১ তারিখ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত সর্বমোট ৮ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়ে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।
এদের অধিকাংশই দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, কেউ পরিবারের সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিতা, কেউবা আশেপাশের পরিচিত ও অপরিচিত মানুষদের দ্বারা।
এরমধ্যে পাঁচ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ৫০ বছরেরও বেশি বয়সী নারী রয়েছে। বিভিন্ন ভয়-ভীতি, পারিবারিক মানসম্মান রক্ষার চাপ, সামাজিকতা রক্ষা, পারিপার্শ্বিক চাপসহ বিভিন্ন কারণে তারা থানা পর্যন্ত যাওয়ার সাহস পাইনি। বিচারের জন্য দাঁড়াতে পারেনি। এর আগেই ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয় ধর্ষণের ঘটনাগুলিকে।
সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে ১৯ ফেব্রুয়ারি মাধবদীতে। এক গর্ভবতী নারীকে তিনদিন আটকে রেখে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে কয়েকজন। ভুক্তভোগী ঐ নারীর স্বামী জামিনের ব্যাপারে সহায়তার আশ্বাস দিয়ে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে পাঁচদোনা এলাকায় একটি মার্কেটের কক্ষে আটকে ইকবাল, পাপ্পুসহ ও অজ্ঞাত আরও কয়েকজন মিলে টানা তিনদিন পর্যন্ত মর্মান্তিক পাশবিক নির্যাতন চালায়। এরপর তিনি বাদী হয়ে মাধবদী থানায় মামলা করলে একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
নরসিংদী সরকারি কলেজের অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী আফরোজা ও মৌমিতা বলেন, “বর্তমানে কোথায়ও নিরাপত্ত বোধ করছি না। কোথাও গেলে ভিতর প্রচণ্ড ভয় কাজ করে। কখন জানি কি হয়ে যায়! প্রতিটি মেয়ে এক অনিশ্চিত নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছে। দেশের মধ্যে একের পর এক ধর্ষণ, মেয়েদের উপর নিম্ন-নির্যাতন চলছেই। ৩-৪ বছরের ছোট্ট মেয়েটিও বাদ যাচ্ছে না ধর্ষকদের কবল থেকে। আমাদের নরসিংদীতেও ধর্ষণের এবং নির্যাতনের খবর পাচ্ছি। তাহলে নারীদের নিরাপত্তা সরকার, দেশ, প্রশাসন কতটুকু দিতে পারছে!”
তিনি আরো বলেন, “ধর্ষণের শিকার কেউ হলে, তার তো কোন দোষ নেই দোষ তো ধর্ষকের। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা সেই ধর্ষিতা নারীকে আরো কয়েকশ’ বার ধর্ষণ করে। হাসপাতাল হয়, থানাতে হয়, কোর্টে হয়, সমাজে হয়, আপন ও আশেপাশের মানুষদের দ্বারা হয়। সবাইকে জবাবদিহি করতে হয়। নানান রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় শরীরে কোথায় হাত দিয়েছে! কোথায় কি করেছে!”
নরসিংদী ১০০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতাল আরএমও মো.
নরসিংদী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর এলাহী বলেন, “প্রশাসনিক দুর্বলতা, আইনের শাসনের অভাব এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি কতটা প্রকট হলে অপরাধীরা বারবার এই ধরনের ন্যাক্কারজনক অপরাধ করার সাহস পায়৷ কতটা পৈশাচিক নির্যাতন করা হয় একজন নারীর উপর। দেখা যায় দিন শেষে সেই ধর্ষণের শিকার নারীরাই বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি ও বিচারের আশায় একেবারেই ভেঙে পড়ে।”
স্বেচ্ছাসেবক ও জনপ্রিয় হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুল হোসেন মামুন বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ধর্ষণের খবর পাচ্ছি। নরসিংদীতেও খবর পাচ্ছি ধর্ষণের ঘটনা। একের পর এক। এরকম তো দেশ চলতে পারে না।”
নরসিংদী জেলা হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডাক্তার মিজানুর রহমান বলেন, “এটেম টু রেপ বা ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট বা হ্যারেজমেন্টের রোগী আসে প্রধান দায়িত্ব হলো তার চিকিৎসা জরুরি ভিত্তিতে নিশ্চিত করা। তার নিরাপত্তা প্রদান করা। মানসিক সাপোর্ট দেওয়া।”
নরসিংদী সিভিল সার্জন ডা. সৈয়দ মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, “দেখা যাচ্ছে ৪০ বছর ৫০ বছর ৬০ বছরের বৃদ্ধ আট বছরের দশ বছরের একটি শিশু সন্তানকে ধর্ষণের শিকার করছে। এক্ষেত্রে আমাদের সকল সেক্টরকে সচেতন হতে হবে। ধর্ষণ কমাতে গেলে আমাদেরকে বেশ কিছু কাজ করতে হবে। ধর্ষণ কি! অমানবিক, অনৈতিক এবং পাশবিক নির্যাতন। এটা যদি আমরা বন্ধ করতে না পারি। আমাদের পুরো জেনারেশনটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”
নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপার মো. আব্দুল হান্নান বলেন, “নরসিংদী জেলা পুলিশ সর্বাত্মকভাবে ধর্ষণের শিকার নারীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। অপরাধীদের গ্রেফতার করছে। কয়েকদিন আগে মাধবদীতে যে ধর্ষণে অভিযোগ উঠে। সেই ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আমরা খুব দ্রুত গ্রেপ্তার করি। কোন ধর্ষণকারীকে ছাড় দেওয়া হবে না। যখন যেখানে যে অভিযোগ পাচ্ছি, তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং সেটা অব্যাহত থাকবে। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি।”
ঢাকা/হৃদয়/এস
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আম দ র বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
মজুরি বৈষম্যের শিকার নারী কৃষিশ্রমিক
‘১৫-২০ বছর ধইরা (ধরে), ই-খলায় (ধান মাড়াই ও শুকানোর স্থান) কাজ করি আমরা। আমরারে ৫০০ টেকা (টাকা) রোজ দেইন (দেন), আর বেটাইনতে (পুরুষরা) পাইন ৭০০ থেকে ৮০০ টেকা, দুপুরে আমরারে চিড়া-গুড় দেওয়া অয় (হয়) হেরার (পুরুষদের) লাগি ভাতের ব্যবস্থা করা অয়।’
কথাগুলো বলছিলেন তাহিরপুরের শনির হাওরপারের কালীবাড়ির সামনে একটি খলায় ধান শুকানো, ঝাড়াই ও বাছাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকা দুই নারীশ্রমিক গীতা বর্মণ ও লক্ষ্মী রানী বর্মণ।
কেবল তাহিরপুরের ধানের খলায় নয়। হাওর এলাকাজুড়েই ধানের খলায় কাজ করা নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের মজুরিতে বৈষম্য রয়েছে।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা সদরের নতুনপাড়ার বারীক মিয়ার খলায় কাজ করছিলেন, পাশের লক্ষ্মীপুর গ্রামের মধ্যবয়সী নারীশ্রমিক প্রেমলতা বিশ্বাস। কখন কাজে এসেছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, সকাল ৮টায়। কয়টায় ছাড়বেন কাজ, বললেন বিকাল ৫টায়। মজুরি কত জানতে চাইলে বললেন, দিনে ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিকরা কত পায় প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ৭০০ টাকা। আপনাকে কম দেওয়া হচ্ছে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রেমলতা বলেন, ‘ই-দেশও নিয়মওই এইটা, বেটাইনতে (পুরুষরা) বেশি পায়।’
মধ্যনগরের বংশিকুন্ডা গ্রামের বাসিন্দা হাসিনা বেগম জানান, ধান মাড়াই, শুকানো ও গোলায় তোলার কাজ করেন তিনি। প্রতিদিনই সকালে আগে কাজে লাগেন এবং কাজ শেষে সবার পরে ফেরেন তিনি। কিন্তু মজুরি দেবার সময় তাঁকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। পুরুষ শ্রমিককে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকাও দেওয়া হয়।
দিরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামের বড় গৃহস্থ সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছত্তার মিয়ার ভাষ্য, রাজাপুরে নারী কৃষিশ্রমিক কমে গেছে। পাশের ইসলামপুরে এখনও বেশির ভাগ কাজ করেন নারীরা। ওখানে নারী ও পুরুষ শ্রমিক অর্ধেক-অর্ধেক। এবার পুরুষ ও মহিলা শ্রমিককে কত টাকা চুক্তিতে গ্রামের বড় কৃষকরা কাজে লাগিয়েছেন জানতে চাইলে বলেন, পুরুষ ২০ দিনে ১৬ মণ ধান এবং নারী শ্রমিকদের ৮ মণে করানো হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এই মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে বলেন, ‘আমি এ নিয়ে কথাও তুলেছি, কিন্তু অন্যরা তাতে বিরক্ত হন, তারা বলেন, চেয়ারম্যান সাবে রেইট বাড়িয়ে সবাইকে বেকায়দায় ফেলতে চান।’
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের ফসল উৎপাদনে সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় কৃষি শ্রমিকের চাইতে এক সময় বেশি ছিল নারী শ্রমিক। মজুরি বৈষম্যের কারণে এদের অনেকে এলাকার কাজ ছেড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় শহরে চলে গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরী ভট্টাচার্য্য বললেন, কৃষিতে মজুরি বৈষম্যের শিকার হয়ে গ্রামীণ এলাকা ছেড়ে উপজেলা, জেলা ও রাজধানীর গার্মেন্টসমুখী হয়েছে হাজার হাজার নারীশ্রমিক। কৃষি ছাড়াও অন্যান্য পেশায়ও মজুরি বৈষম্য থাকায় নারীর উপস্থিতির সংখ্যা কমছে।
গৌরী ভট্টাচার্য্য আরও বলেন, এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র করতে গিয়ে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত পুরুষদের পেশা কৃষক লিখলেও নারীর ক্ষেত্রে হয় না। নারীর প্রতি এমন বৈষম্য বন্ধ করতে হবে।