রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের ৪ নম্বর সেক্টরে সাকিল বুক ডিপো থেকে ৭ নম্বর সেক্টরের ডাস্টবিন পর্যন্ত চলে গেছে একটি রাস্তা। এর মধ্যেই তিনটি পয়েন্টে দেখা মেলে তিন দল মাদক বিক্রেতার। শুরুতে পাপ্পু স্যালুন এলাকায় ইমতিয়াজ ও শাহ আলমের লোকজন ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন বিক্রি করছে। কিছুদূর এগোনোর পর নাসিরের সিমেন্টের দোকানের আশপাশে হাসিব এবং আরও পরে ভাঙাড়ি দোকান এলাকায় মাদক বিক্রি করছিল আজাদ-বিল্লালের সহযোগীরা। রাস্তায় নতুন কাউকে দেখলেই তারা হাঁকডাক শুরু করে। কেউ বলছিল, ‘পাতা লাগবে, পাতা?’ আবার কেউ বলে, ‘ছোট না বড়?’ আরেক দল শুধু বলছিল, ‘পঞ্চাশ-একশ, পঞ্চাশ-একশ’।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাতা মানে হেরোইন, ছোট না বড় বলতে ইয়াবার আকারের ভিত্তিতে দুটি ধরন এবং পঞ্চাশ-একশ বলতে গাঁজার পুরিয়ার দাম বোঝানো হচ্ছে। নিয়মিত ক্রেতা সাংকেতিক শব্দ শুনলেই বুঝতে পারেন কোন কারবারি কী বিক্রি করছে। 

ঢাকায় মাদকের প্রধান এই স্পট ঘিরে কয়েক মাসে দফায় দফায় অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে ভূঁইয়া সোহেল ও চুয়া সেলিমের মতো ‘মাদক মাফিয়া’সহ বহু কারবারি ধরা পড়ে। তবু থেমে নেই মাদক কারবার। এখনও ছোট-বড় ও নতুন-পুরোনো মিলিয়ে অন্তত ১৪টি মাদক চক্র রয়েছে। এর কোনোটি নতুন করে সক্রিয় হয়েছে, কোনোটি আগে ছোট পরিসরে ছিল এখন বিস্তৃত, আবার গ্রেপ্তার কারবারির জায়গা দখল করে চালানো হচ্ছে কোনো কোনো চক্র।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ক্যাম্পের পূর্ব পাশের (হুমায়ুন রোড) ৬ নম্বর লাইনে বড় কারবারির অন্যতম ইমতিয়াজ ও শাহ আলম। গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা চুয়া সেলিম এই চক্রকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিত। সেই সঙ্গে কোপ মনু গ্রুপের সমর্থনও ছিল। এখন মাঠে বড় কারবারি কম থাকার সুযোগে আগে ছোট পরিসরে চলা চক্রটি বেচাকেনার পরিধি আরও বাড়িয়েছে। এই চক্রের ম্যানেজার পিচ্চি সামির। তার হয়ে কালা ফয়সাল, লালন, কালা ভিকি গাঁজা সংগ্রহ করে দেয়। চক্রটি ইয়াবা ও হেরোইনও বিক্রি করে।

একই (৬ নম্বর) লাইনের আরেকটি শক্তিশালী চক্র চালায় হাসিব, তার ভাই মনির, সোনু ও মিঠু। তাদের আরেক ভাই হীরা এখন কারাগারে। টিপু তাহেরীর সার্বিক সহায়তা নিয়ে চলা চক্রটির পরিবারের নারী সদস্যরাও এ কারবারে জড়িত। এ ছাড়া তাদের ৭ থেকে ৮ বিক্রয়কর্মী আছে, যারা নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে মাদক বিক্রি করে। একই লাইনে নতুন করে কারবার শুরু করেছে আজাদ, তার ভাই ইকবাল ও বিল্লাল। তারা তিন ভাই ছাড়াও পাঁচ-ছয়জন বিক্রয়কর্মী মূলত গাঁজাই বিক্রি করে।
ভূঁইয়া সোহেল গ্রেপ্তারের পর কারবারের হাল ধরেছে তার ভাই টুনটুন। সেই সঙ্গে আছে নাস্সো, গেঞ্জিওয়ালা মনু, ফরিদ, নাদিম ও নাসিম। ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের আল-ফালাহ মডেল ক্লিনিক এলাকার পাবলিক টয়লেটের আশপাশে তারা মূলত হেরোইন বিক্রি করে। সেই সঙ্গে মেলে ইয়াবা, গাঁজাও। বড় এই চক্রের আছে ৩০ থেকে ৪০ বিক্রয়কর্মী। 
আরেকটি বড় গ্রুপ চালায় সৈয়দপুরিয়া বাবু। ক্যাম্পের ‘সি’ ব্লকের এ-ওয়ান মোড় এলাকায় তাদের ২০ জনের মতো বিক্রয়কর্মী মূলত হেরোইন বিক্রি করে। তাদের পরিচালনা করে নওশাদ, লম্বু রানা ও ভাতিজা রুবেল। চক্রের আরেক সদস্য বম এখন জেলে। পিচ্চি রাজার আলাদা কারবার থাকলেও সে এই চক্রকে সহায়তা করে। তার চক্রে সহযোগী হিসেবে আছে শ্বশুর খুরশিদ, আদিল, বড় রাজা ও তার ভাই শাহজাদা। চক্রের অন্যতম সদস্য দিলদার চট্টগ্রাম থেকে ইয়াবা নিয়ে আসে। 

আরেক মাদক মাফিয়া চুয়া সেলিম কারাগারে থাকলেও ‘বি’ ব্লকে তার পরিবারের সদস্যরা কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। একই এলাকায় নতুন করে গজিয়ে ওঠা একটি চক্র চালায় সামির ওরফে নেটা সামির ও তার মামা কামরান। তারা মূলত দিলদার নামের এক পাইকারি সরবরাহকারীর মাদক বিক্রি করে। ‘বি’ ব্লকের পুরোনো আরেকটি চক্র চালায় আলমগীর। অন্যতম সহযোগী তার ভাই পারভেজ এখন কারাগারে। তবে পরিবারের সদস্যরাও নেমে পড়েছে কারবারে। সেই সঙ্গে বিক্রয়কর্মী আছে ১০ থেকে ১৫ জন। জয়নুল, মোনা ও সাফিনের চক্র ‘সি’ ব্লক থেকে পাইকারি গাঁজা বিক্রি করে। একইভাবে ক্যাম্পের ৬ নম্বর সেক্টরে আগে থেকেই পাইকারি গাঁজা বিক্রি করে আসছে গলি জাহিদ। ৫ নম্বর সেক্টরের আরেকটি পুরোনো চক্র চালায় নাদিম, সাজু, মুরাদ ও সিঁথি। তারা গাঁজা, ইয়াবা ও হেরোইন বিক্রি করে। মাহমুদ, মামুন ও মাহবুবের একটি চক্র আছে। তারা ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সুবিধামতো স্থানে মাদক পৌঁছে দেয়। 
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান সমকালকে বলেন, জেনেভা ক্যাম্পে নিয়মিতভাবে মাদকবিরোধী অভিযান চালানো হচ্ছে। গত ছয় মাসে মাদক ও অস্ত্রসংক্রান্ত প্রায় দেড়শ মামলা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো। তবে শুধু পুলিশি অভিযানে ক্যাম্পের মাদক কারবার নির্মূল করা কঠিন। সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দরকার। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হ র ইন ব ক র ব ক রয়কর ম এল ক য় ক রব র র আর ক সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ