পবিত্র রমজান মাসে খাদ্যসংস্কৃতি অনেকটাই বদলে যায়। প্লেটে উঠে আসে রকমারি মজাদার খাবার। ভাজাপোড়া, তেল জবজবে খাবার থেকে শুরু করে ফিরনি, পায়েস, শাহি জিলাপি, পুডিং আরও কত কী! খাদ্যের ধরন ও খাদ্যগ্রহণ সময়সূচি বদলে যাওয়ায় ডায়াবেটিক রোগীর বিপাক প্রক্রিয়ায় কিছুটা বিপত্তি ঘটে।

দীর্ঘ সময় খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকায় যেমন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা অনেক নিচে নামে, তেমন ইফতার ও সাহ্‌রির পর গ্লুকোজের মাত্রা অস্বাভাবিক বাড়তে পারে। এ জন্য সতর্ক থাকা দরকার।

রোজায় প্রায়ই যা ঘটে

ইফতারে বেশি খাবার গ্রহণ। কখনো এক বৈঠকে ১৫০০ কিলোক্যালরির ওপরে খাদ্য গ্রহণ।

অঢেল শর্করাজাতীয় খাদ্য ইফতার ও এর পরবর্তী সময়ে গ্রহণ।

হালুয়া, জিলাপি, পুডিংসহ হরেক মিষ্টান্নের সমাহার।

বিরিয়ানি, হালিমসহ বিভিন্ন স্ন্যাকস খাদ্য টেবিলে চলে আসা।

ইফতারে প্রায়ই দ্রুত খাদ্য গ্রহণের ফলে বেশি খাওয়া।

সাহ্‌রি না খাওয়া অথবা অনেক আগে সাহ্‌রি গ্রহণ করার প্রবণতা থাকে কারও মাঝে।

ভাজাপোড়া খাওয়ার আধিক্য।

কাজকর্ম কমিয়ে দেওয়া ও ঘুমের রুটিন বদলে যাওয়ায় ওজন বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা।

যেসব বিষয়ে গুরুত্ব

রোজায় ডায়াবেটিক রোগীদের খাদ্যতালিকায় নজর দিতে হবে, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে। নিচের বিষয়গুলো বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে:

ইফতারে পর্যাপ্ত পানি গ্রহণ; যাতে পানিশূন্যতা দূর হয়।

মিষ্টিজাতীয় খাবার, যেমন জিলাপি, চিনির শরবত, মিষ্টান্ন এবং ভাজাপোড়া খাবার, কাবাব, পাকোড়া, পরোটা; এগুলো ইফতারে পরিহার করা।

অতিরিক্ত মিষ্টি ফল গ্রহণ না করা।

শসা, খিরা, পেয়ারা, নাশপাতি, বরই, আমড়া, ডাবের পানি, লেবুর পানি অন্যান্য টকজাতীয় ফল ইচ্ছেমতো খাওয়া যাবে।

সাহ্‌রি অবশ্যই বাদ দেওয়া যাবে না। সাহ্‌রিতে দুপুরের আহারের সমান খাবার খাওয়া।

সাহ্‌রি যতটা দেরিতে সম্ভব গ্রহণ করা।

সাহ্‌রিতে শর্করার পাশাপাশি আমিষ ও চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ।

পর্যাপ্ত ফাইবার বা আঁশজাতীয় খাবার গ্রহণ; যাতে কোষ্টকাঠিন্য দূর হয়।

চা-কফি-কোলা পান করলে পানিশূন্যতা বাড়তে পারে। এগুলো কমানো।

রোজায় ডায়াবেটিক রোগীর খাদ্যতালিকায় শতকরা ৪০-৫০ ভাগ শর্করা, ২০-৩০ ভাগ আমিষ, ৩০-৩৫ ভাগ চর্বি যাতে স্থান পায়, সেদিকে নজর দেওয়া জরুরি। তবে সম্পৃক্ত চর্বি থাকবে শতকরা ১০–এর নিচে।

কর্নেল ডা.

নাসির উদ্দিন আহমদ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সিএমএইচ, বরিশাল

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ দ য গ রহণ খ ব র গ রহণ ইফত র

এছাড়াও পড়ুন:

তিন কারণে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, অক্টোবরের বৃষ্টিও ভোগাবে

‘রোগতাত্ত্বিক ত্রিভুজ’ বলে জনস্বাস্থ্যে একটি পরিভাষার ব্যবহার আছে। এই ত্রিভুজের তিন বাহুর একটি হলো জীবাণু (ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মশা), একটি রোগী এবং তৃতীয়টি পরিবেশ। এই তিনটির একটিও যদি নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে রোগ বৃদ্ধির প্রবণতা কমানো যায়।

গতকাল শুক্রবার শেষ হলো অক্টোবর মাস। এ মাসে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে, এডিস মশার বিস্তার কমেনি এবং জীবাণু সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ যেমন বৃষ্টিও ছিল। পরিবেশের অন্য উপাদান যেমন শহরাঞ্চলে নোংরা ও আবর্জনা। এ ক্ষেত্রেও কোনো উন্নতি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অক্টোবরের শেষ সময়ে এসে এই বৃষ্টি আমাদের ভোগাবে। নভেম্বরে ডেঙ্গুর বিস্তার কমার সম্ভাবনা কম। রোগতাত্ত্বিক ত্রিভুজ বলতে যা বোঝায়, তাকে রুখে দেওয়ার কোনো তৎপরতা তো দেখছি না। গ্রামে-গঞ্জে এডিস ছড়িয়ে পড়েছে। তার নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৃশ্যমান কাজ দেখা যাচ্ছে না। ভীতির কারণ এটাও।’

অক্টোবরের শেষে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছিল। আর গত বুধবার দেখা যায়, এক মাসে বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২ হাজার ৫২০ জন। এ মাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৮০। সংক্রমণ ও মৃত্যু—দুই দিক থেকেই ডেঙ্গুর আক্রমণে অক্টোবর ছিল বছরের শীর্ষে।

বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫০৩ জন। এ সময় কারও মৃত্যু হয়নি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৭৮ জন। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৮৬। গত বছর এ সময় রোগীর সংখ্যা ছিল ৬১ হাজার ৮১৭ আর মৃত্যু হয়েছিল ২৯৭ জনের।

দুই মাস ধরে বাড়ছে রোগ ও মৃত্যু

চলতি বছরের জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। এ সময় অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছিলেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বড় আকারের হতে পারে। সরকার তাতে তেমন গা করেনি। গত জুলাই মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা জুনের দ্বিগুণ হয়ে যায়। আগস্টে মৃত্যু ও সংক্রমণ সামান্য কমে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন। অক্টোবরে প্রায় ৭ হাজার রোগী বেড়েছে।

ঢাকা ও আশপাশে রোগী বাড়ছে

চলতি বছরের ডেঙ্গুর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এবার ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এবার মোট আক্রান্তের ২৮ শতাংশ ঢাকার। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকার বাইরে রোগী বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। কিন্তু অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ঢাকায় রোগী বাড়তে শুরু করে। শুধু ঢাকা নয়, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয় রোগী ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অক্টোবরে ঢাকায় অন্তত ১৫ শতাংশ রোগী বেড়েছে সেপ্টেম্বরের চেয়ে। তবে ঢাকায় ভর্তি রোগীদের অন্তত ৫০ শতাংশ ঢাকার বাইরের বাসিন্দা।

নারায়ণগঞ্জে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৩০। অক্টোবরের শেষে এসে রোগীর সংখ্যা হয়েছে ১ হাজার ৩১০ জন। অর্থাৎ শুধু অক্টোবরে আগের নয় মাসের তুলনায় রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। গাজীপুরে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রোগী ছিলেন ১ হাজার ৬৬১ জন। আর অক্টোবরের শেষ দিন পর্যন্ত রোগী হয়েছেন ২ হাজার ৯৯৩ জন।

তিন কারণে ডেঙ্গুর বড় বিস্তার

চলতি বছর এপ্রিল থেকে মোটামুটি বৃষ্টি হচ্ছে। জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও পরের মাসগুলোয় স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়। আর থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে গরম কিন্তু কমেনি। এই বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা চলতি বছর ডেঙ্গুর বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবীরুল বাশার। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই বর্ষা দেরিতে আসছে। এবারও অক্টোবরজুড়ে বৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ডেঙ্গুর বিস্তারে দ্বিতীয় কারণ। পৌরসভার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতিনিধিশূন্য করা ঠিক হয়নি। ঢাকার বাইরে এবার ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে এসব ভঙ্গুর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বড় কারণ। কবীরুল বাশার মনে করেন, ঢাকার বাইরে যেহেতু চিকিৎসা অবকাঠামো দুর্বল, তাই সেসব এলাকায় রোগ বেড়েছে।

অধ্যাপক কবীরুল বাশার বলেছিলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে শীতের ভূমিকা আসলে কম। কারণ, এখানে জানুয়ারি মাসে দিনের তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। রাতে হয়তো তা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে চলে আসে। কিন্তু এখানে এডিসের বংশ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে বৃষ্টি।

অক্টোবরের শেষে যে বৃষ্টি হয়েছে, আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, অন্তত ৩টি বিভাগে পরের ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।এরই মধ্যে বৃষ্টির আরেক খবর আছে। ৬ থেকে ৭ নভেম্বর সাগরে লঘুচাপের ফলে আবারও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।

এভাবে বৃষ্টি হলে পাঁচ থেকে সাত দিন লার্ভা থেকে বাচ্চা মশা হয়। সেটি প্রাপ্তবয়স্ক হতে আরও ১১ দিনের মতো সময় লাগে। সব মিলিয়ে আরও ২০ থেকে ২৫ দিন এডিসের বংশবিস্তার ঘটতে থাকবে। ফলে নভেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না। এর রেশ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকতে পারে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • তিন কারণে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, অক্টোবরের বৃষ্টিও ভোগাবে