স্বাধীন দেশে প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনীই কাম্য
Published: 19th, March 2025 GMT
গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যে বৈঠকটি করেছেন, সেটিকে গতানুগতিক বলা যাবে না। সংবাদমাধ্যমের খবর দেখে মনে হয়, দুই পক্ষই বেশ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল এবং খোলামেলাভাবে কথা বলেছে।
পুলিশকে অবহেলা করে, পাশ কাটিয়ে দেশ গড়া যাবে না বলে প্রধান উপদেষ্টা যে মন্তব্য করেছেন, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, পুলিশ মানে আইন, পুলিশ মানে শৃঙ্খলা। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রেই এই দুটিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিকল্প নেই। কেননা আইন ও শৃঙ্খলা না থাকলে গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ একটি আধুনিক রাষ্ট্রের যে মৌলিক উপাদান, তা অর্জন করা যাবে না।
পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব দাবিদাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে সদস্যদের পেশাগত সুযোগ–সুবিধার বিষয়টিও আছে। অন্যান্য পেশার মানুষের মতো পুলিশ বিভাগেও ওপরের স্তর ও নিচের স্তরের সদস্যদের সুযোগ–সুবিধার ফারাকটি অনেক বেশি। এরপর কিছু মৌলিক ও মানবিক বিষয়ের দিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। একজন নারী কর্মকর্তাকে যেখানে পদায়ন করা হবে, সেখানে অবশ্যই ডে–কেয়ার সেন্টার থাকতে হবে। প্রত্যেক পুলিশ সদস্যের আবাসিক ও যাতায়াত–সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটাই প্রত্যাশিত।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে অতীতের ব্যর্থতা ভুলে পুলিশ সদস্যদের প্রতি সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। কেবল নির্বাচন নয়, সব ক্ষেত্রেই তাদের পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের চেয়ে ঊর্ধ্বতনদের দায়িত্ব বেশি। আজ যাঁরা পূর্ববর্তী স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই ‘রাজার ইচ্ছায়’ চলেছেন। এই ‘রাজার’ ইচ্ছেয় চলার মানসিকতা থেকে পুলিশ বাহিনীকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আইনের সুরক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে সব ক্ষেত্রে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন বলে আশা করি। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তাঁরা আইন দ্বারা পরিচালিত হবেন। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা অতীতের অনিয়ম নিয়ে বুলন্দ আওয়াজ তুলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিও তাঁদের কড়া নজর রাখতে হবে। বিভিন্ন স্থানে আইনভঙ্গের ঘটনা ঘটার পরও যখন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন, তখন সাধারণ মানুষের প্রতিকার পাওয়ার কোনো পথ থাকে না।
পুলিশ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠন করার দাবি জানানো হয়েছে। এটা জরুরি বলে মনে করি। প্রধান উপদেষ্টা পুলিশ বাহিনীর মনোবল বাড়ানোর জন্য অনেক কথা বলেছেন। আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজে তাঁদের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। আইনশৃঙ্খলা ঠিক না থাকলে কোনো বড় চিন্তাকে যে বাস্তবে রূপ দেওয়া যাবে না, সেই সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।
এর আগে কোনো সরকারপ্রধান পুলিশের সঙ্গে এ রকম খোলামেলা কথা বলেছেন বলে জানা নেই। এখন পুলিশ সদস্যদেরই ঠিক করতে হবে তারা পুরোনো ধারায় চলবেন না নতুন ধারায় নিজেদের তৈরি করবেন। স্বৈরতান্ত্রিক সরকার বিদায় নেওয়ার পরও যে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি এবং যেকোনো বড় দুর্যোগ মোকাবিলায় যৌথ বাহিনীকে তলব করতে হয়, এটা পুলিশের সক্ষমতার প্রমাণ নয়।
আশা করি, পুলিশ সদস্যরা নিজেদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার পাশাপাশি পেশাগত দায়িত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকবেন। স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ বাহিনীই কাম্য।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প ল শ সদস য কর মকর ত কর ছ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ফেস্টুন অপসারণ করায় ইউএনওকে শাসালেন বিএনপি নেতা
ফেস্টুন অপসারণ করায় রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফয়সাল আহমেদকে শাসিয়েছেন এক বিএনপি নেতা। তিনি ইউএনওকে আগের স্থানেই ফেস্টুন লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, “তা না হলে যেটা করা দরকার, সেটাই করব।”
এই বিএনপি নেতার নাম কে এম জুয়েল। তিনি রাজশাহী মহানগর বিএনপির সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক। গোদাগাড়ী উপজেলার রিশিকুলে তার বাড়ি।
গত মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সড়ক বিভাজকে থাকা বিভিন্ন দলের ফেস্টুন অপসারণ করেন ইউএনও ফয়সাল আহমেদ। বিষয়টি জানতে পেরে ইউএনওকে ফোন করে ধমকান জুয়েল।
কে এম জুয়েলের ফোনকল রেকর্ড পাওয়া গেছে। এতে শোনা গেছে, কে এম জুয়েল বলেছেন- “আজকে একটা ঘটনা ঘটেছে, আমি শুনেছি। আমি ইঞ্জিনিয়ার কে এম জুয়েল বলছি, সম্ভাব্য ক্যান্ডিডেট। আপনার গোদাগাড়ী থানার প্রোপারে যে পোস্টার সরিয়েছেন, এই বিষয়ে কিছুক্ষণ আগে আমাকে ইনফর্ম করা হয়েছে। সেখানে আমার পোস্টার ছিল। জামায়াত-বিএনপির পোস্টার ছিল। আপনি যে হটাইছেন, এর কারণ কী? কোনো পরিপত্র আছে, না ইচ্ছে করেই?”
ইউএনও তখন বলেন, “জনগণ অভিযোগ দিয়েছে।” জুয়েল বলেন, “জনগণ তো অনেক অভিযোগ দিয়েছে। সমগ্র গোদাগাড়ী থানাতে ভর্তি হয়ে আছে পোস্টার। তোলেন, সব তোলেন।”
এ সময় ইউএনও কিছু বলতে চাইলে তাকে থামিয়ে দিয়ে জুয়েল বলেন, “শোনেন, আমি যেটা বলছি লিগ্যাল রাইট নিয়ে বলছি, সেটার সঠিক অ্যানসার করবেন। আপনি কেন ওই জায়গার পোস্টার তুলেছেন, আর অন্য জায়গার তুলছেন না কেন? আমি ঢাকাতে আছি, আমি আসতেছি।”
ইউএনও বলেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।” জুয়েল বলেন, “না, আপনি যেখান থেকে পোস্টার তুলেছেন, সেখানে আপনি সাবমিট করবেন পোস্টার।” কথা না বাড়িয়ে ইউএনও বলেন, “ঠিক আছে।”
এ সময় আরো ক্ষুব্ধ হয়ে বিএনপি নেতা জুয়েল বলেন, “কালকে যেন আমরা ওখানে দেখতে পাই, পোস্টার যেখানে ছিল। ঠিক আছে মানে কী? অবশ্যই করবেন। না হলে যেটা করা দরকার সেটাই করব। আপনার এগেইনেস্টে যেরকম স্টেপ নেওয়া দরকার, সেটাই আমি করব। বিশেষ করে আমরা করব। আমার নেতার ছবি তুলেছেন আপনি ওখান থেকে। জাস্ট রিমেম্বার ইট।”
জুয়েল বলতে থাকেন, “নরসিংদী বাড়ি দেখান আপনি, না? কোন দল থেকে আসছেন আপনি? কোন দল থেকে এসেছেন? কার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতেছেন আপনি? কালকে পোস্টার ভদ্রলোকের মতো লাগাবেন। ফাইজলামি! এহ, বিশাল ব্যাপার। উনি টিএনও হয়ে গোদাগাড়ীতে আসছেন।”
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ইউএনও ফয়সাল আহমেদ বলেন, “ডাইংপাড়া মোড়ে ব্যানার-ফেস্টুন এরকম পর্যায়ে ছিল যে, যান চলাচলে সমস্যা হচ্ছিল। পাশাপাশি পৌরসভার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছিল বলে অভিযোগ ছিল। স্থানীয় জনগণ এ ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পৌরসভা থেকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে সরানোর জন্য। দুই-তিনবার মৌখিকভাবে ও লিখিত আকারে জানানো হয়েছিল। না সরানোর কারণে ব্যানার-ফেস্টুন সরিয়ে পৌরসভায় রাখা হয়েছে।”
তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সভাতেও আলোচনা হয়েছিল। সেখান থেকে সকল রাজনৈতিক দলের পোস্টারই পৌরসভার পক্ষ থেকে সরানো হয়েছে। তবে, বিএনপি নেতা কে এম জুয়েলের ফোনে শাসানোর বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি নেতা কে এম জুয়েল বলেন, “ইউএনওর কাছে জনগণ অভিযোগ করেছে, আর আমরা কি মানুষ না? আমরা জানোয়ার? আমার ছবি তুলে ফেলুক আপত্তি নাই। আমার নেতার ছবিতে হাত দিয়েছে কেন? তার কাছে কি নির্বাচন কমিশন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পোস্টার তুলে ফেলতে? তিন মাসের মধ্যে কি নির্বাচন? উনি জাস্টিস করতেন, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু গরু-ছাগলের মতো আচরণ করবেন, তা তো হয় না।”
বিষয়টি নিয়ে কোথাও আলোচনা হয়নি, ইউএনও কোনো চিঠিও দেননি, দাবি করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “গতকাল আমার এক লোককে ডেকে ইউএনও বলেছেন, যেখানে পোস্টার ছিল, দয়া করে আপনারা লাগিয়ে নেন। কিন্তু, আমরা তো লাগাব না। ইউএনওকেই লাগাতে হবে।”
উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একজন সদস্য জানান, প্রায় দুই মাস আগে উপজেলা সদরের এসব ব্যানার-ফেস্টুন ও পোস্টারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় উত্থাপন করেন এক ব্যক্তি। এক মাসেও সেগুলো অপসারণ না হওয়ায় পরবর্তী মাসের সভাতেও বিষয়টি আলোচনায় ওঠে। ওই সভায় ট্রাফিক পুলিশ আপত্তি করেছিল যে, ফেস্টুনের কারণে রাস্তার একপাশ থেকে অন্যপাশ দেখা যায় না। এতে দুর্ঘটনা ঘটছে। এ দুটি সভার মধ্যে প্রথম সভায় উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল ছিলেন না। দুই সভার মাঝে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি পুনর্গঠন করা হলে তিনি পরবর্তী সভায় উপস্থিত ছিলেন।
তবে, কোনো আলোচনা হয়নি দাবি করে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুস সালাম শাওয়াল বলেন, “আমি আইনশৃঙ্খলা কমিটির সদস্য। পোস্টার নিয়ে কোনো আলোচনা সভায় হয়নি। ইউএনও আমাদের না জানিয়ে এভাবে ফেস্টুন অপসারণ করে ঠিক করেননি। সেখানে আমাদের নেতার ছবি ছিল।”
ঢাকা/কেয়া/রফিক