ট্রাম্পের শুল্কনীতি কি ভারতের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করবে
Published: 19th, March 2025 GMT
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকি সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ভারতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। চলতি মাসের শুরুতে ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তাঁর পাল্টা শুল্ক আগামী ২ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এর ফলে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ, এতে তাঁরা ট্রাম্পের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারেন।
ট্রাম্পের অস্থির নীতির কারণে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা কোনো আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন না। যদিও তিনি সম্প্রতি মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আমদানি করা গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশের ওপর শুল্ক এক মাসের জন্য স্থগিত করেছেন এই যুক্তিতে যে এতে মার্কিন গাড়ি প্রস্তুতকারকেরা স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর সময় পাবেন; ভারতও একই ধরনের ছাড় পাবে বলে আশা করা নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত।
গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছিল। ওই সফরের মধ্য দিয়ে একটি নতুন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে ৯ মাসব্যাপী আলোচনা শুরু হয়, যা শরৎকালে শেষ হওয়ার কথা। তবে এই আলোচনা ট্রাম্পের আগামী মাসে কার্যকর হতে যাওয়া পাল্টা শুল্কের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
৪ মার্চ স্টেট অব দ্য ইউনিয়ন ভাষণে ট্রাম্প ভারতকে প্রধান শুল্ক অপব্যবহারকারী হিসেবে চিহ্নিত করেন। একই সঙ্গে তিনি তাঁর পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত থাকায় এই নতুন শুল্কনীতির অর্থনৈতিক প্রভাব যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ২০২৪ সালে ভারত ৭৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে ভারত প্রতিবছর প্রায় সাত বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
ট্রাম্প যদি সত্যিই পুরোপুরি পাল্টা শুল্কনীতি অনুসরণ করেন, তাহলে এই ব্যবধান মুছে যাবে এবং ভারতীয় রপ্তানিকারকদের যে ব্যয়সুবিধা রয়েছে, তা বিলীন হয়ে যাবে। এতে ভারতীয় পণ্যগুলোর প্রতিযোগিতামূলক মূল্য কমে যাবে, রপ্তানি আয় হ্রাস পাবে এবং শ্রমনির্ভর শিল্পগুলোতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে।এর প্রভাব আরও গভীর হতে পারে। এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভারত বর্তমানে মার্কিন পণ্যের ওপর গড়ে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর মাত্র ৩ শতাংশ শুল্ক ধার্য করে।
ট্রাম্প যদি সত্যিই পুরোপুরি পাল্টা শুল্কনীতি অনুসরণ করেন, তাহলে এই ব্যবধান মুছে যাবে এবং ভারতীয় রপ্তানিকারকদের যে ব্যয়সুবিধা রয়েছে, তা বিলীন হয়ে যাবে। এতে ভারতীয় পণ্যগুলোর প্রতিযোগিতামূলক মূল্য কমে যাবে, রপ্তানি আয় হ্রাস পাবে এবং শ্রমনির্ভর শিল্পগুলোতে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান হারানোর আশঙ্কা তৈরি হবে।
বিশেষত রাসায়নিক, ধাতব, গয়না, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ, টেক্সটাইল, ওষুধশিল্প এবং খাদ্যপণ্য—এই খাতগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। ভারতকে হয় শুল্ক থেকে ছাড় পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে হবে, নয়তো দ্রুত বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে।
ট্রাম্পের ঘোষিত ২৫ শতাংশ শুল্কহার ভারতীয় গাড়ির যন্ত্রাংশশিল্পের জন্য বড় ধাক্কা হবে। কারণ, ভারত এই খাতে একটি প্রধান উৎপাদক দেশ। তবে ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা মেক্সিকো ও চীনের ব্যবসায়ীদের তুলনায় বেশি ঝুঁকির মধ্যে নেই। যদি এই শুল্কনীতি সব দেশের জন্য কার্যকর হয়, তাহলে সবার জন্যই খরচ বাড়বে এবং প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে উঠবে।
ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি লুকিয়ে আছে মার্কিন গাড়িশিল্পের সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনে। যুক্তরাষ্ট্রের গাড়িশিল্প বর্তমানে আমদানি করা যন্ত্রাংশের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
যদি ট্রাম্পের শুল্কনীতি দেশীয় উৎপাদনকে উজ্জীবিত করে এবং আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়, তাহলে ভারতীয় সরবরাহকারীরা বড় ক্ষতির মুখে পড়বে। তবে এই পরিবর্তন রাতারাতি হবে না; কারণ, মজুরি ব্যবধানের কারণে মার্কিন উৎপাদিত যন্ত্রাংশ ভারতীয় পণ্যের তুলনায় এখনো ব্যয়বহুল থাকার সম্ভাবনা বেশি।
বিশ্লেষকদের মতে, রপ্তানি কমে গেলে ভারতের বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মোদির সরকার ট্রাম্প প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছু আগাম ছাড় দিয়েছে। ২০২৫-২৬ সালের ইউনিয়ন বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা বোরবন (হুইস্কিবিশেষ), ওয়াইন ও বৈদ্যুতিক যানবাহনের ওপর শুল্ক হ্রাস করা হয়েছে। এমনকি হার্লে-ডেভিডসন মোটরসাইকেলের দামও ভারতে কমানো হয়েছে, যা অতীতে ট্রাম্পের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল।
প্রশ্ন থেকে যায়, এই ছাড় কি ট্রাম্পকে শান্ত করতে যথেষ্ট হবে। যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারত থেকে আমদানি করা ওষুধের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসায়, তাহলে ভারতীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতা করা কঠিন হয়ে যাবে। বর্তমানে ভারতীয় ওষুধ কম দামে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা সম্ভব হয়; কারণ, উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে কম; কিন্তু শুল্ক বসানো হলে এই খরচ বাড়বে। ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর মূল্যের সুবিধা কমে যাবে।
এটি ভারতের জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পণ্য ভারতে রপ্তানি করে, তার প্রায় ৩১ শতাংশই ওষুধশিল্প থেকে আসে। অর্থাৎ ভারতের মোট রপ্তানির একটি বিশাল অংশ এই খাতের ওপর নির্ভরশীল। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ফার্মেসিগুলোতে বিক্রীত সাধারণ ওষুধের অন্যতম প্রধান সরবরাহকারী। যদি ট্রাম্পের শুল্কনীতি ভোক্তাদের জন্য ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেয়, তাহলে মার্কিন কোম্পানিগুলো নিজ দেশে জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন শুরু করতে পারে। এতে ভারতের সবচেয়ে লাভজনক রপ্তানি খাত ক্ষতির মুখে পড়বে।
আরও কিছু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য দেশের ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপ করবে। যদি ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা মার্কিন বাজার হারান, তাহলে তঁারা কি বিকল্প ক্রেতা খুঁজে পাবেন?
শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি। তিনি টানা চতুর্থবারের মতো লোকসভায় নির্বাচিত হয়েছেন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র জন য আমদ ন র ওপর উৎপ দ
এছাড়াও পড়ুন:
খাদি কাপড়ের জিআই স্বীকৃতিতে আনন্দে ভাসছেন কুমিল্লাবাসী
কুমিল্লার ঐতিহ্যের স্মারক খাদি কাপড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আনন্দিত জেলার মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, অবশেষে পেয়েছেন সেই সুখবর। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে স্বীকৃতির এই সনদ দেওয়া হয়।
কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় এলাকার রামঘাটলা থেকে শুরু করে রাজগঞ্জ পর্যন্ত অন্তত ৩০০ খাদি পোশাকের দোকান। কান্দিরপাড়ের খাদি বসুন্ধরা দোকানের স্বত্বাধিকারী জয়নাল আবেদীন ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, শৈল্পিক ছোঁয়ায় কুমিল্লার খাদি এখন দেশ-বিদেশে বেশ সমাদৃত। ঐতিহ্যের খাদিতে এখন লেগেছে আধুনিকতা ও নান্দনিকতার ছোঁয়া। শত বছরের বেশি পুরোনো খাদির আরও অনেক আগেই জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। অবশেষে স্বীকৃতি মিলেছে, এতেই আনন্দিত সবাই।
একই এলাকার খাদি জ্যোৎস্না স্টোরের মালিক তপন পাল বলেন, ‘কুমিল্লার প্রতিটি মানুষ খাদির এমন স্বীকৃতিতে আনন্দিত। শত বছর পার হলেও এখনো দেশ-বিদেশে খাদি কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা।’
কুমিল্লার ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সমগ্র ভারতবর্ষে অসহযোগ আন্দোলনের সময় কুমিল্লায় খাদিশিল্প প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ওই সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করার জন্য আওয়াজ ওঠে। সর্বত্র এক আওয়াজ ‘মোটা কাপড়-মোটা ভাত’। সে সময় ভারতবর্ষের মানুষ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে খাদি পোশাক ব্যবহার শুরু করেছিলেন। খাদের (গর্তে) চরকায় বসে এ কাপড় তৈরি করা হয় বলে এর নামকরণ হয় ‘খাদি’। শুরুতে মহাত্মা গান্ধী নিজেও কুমিল্লায় এসে খাদের চরকায় বসে খাদি কাপড় তৈরিতে উৎসাহ দেন।
এই গবেষক আরও বলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ভারত পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করে নিলে কুমিল্লার খাদিশিল্প সংকটে পড়ে। এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হাল ধরেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির (বার্ড) প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান।
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, জেলা প্রশাসনের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় গত বছর কুমিল্লার রসমালাই জিআই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কুমিল্লার খাদি ও বিজয়পুরের মৃৎশিল্পের জিআই স্বীকৃতির জন্য তখন থেকেই কাজ শুরু হয়। কুমিল্লার ‘ব্র্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত তিনটি পণ্যের মধ্যে দুটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। যে একটি বাকি আছে, সেটিও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বীকৃতি পাবে বলে তিনি আশাবাদী।