গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমিক আকাঙ্ক্ষা: সমাজ ও সংস্কৃতিতে শ্রমিক সুরত
Published: 23rd, March 2025 GMT
বাধা ডিঙিয়ে হয় না পাখা মেলা
জন্ম থেকেই জোটে না কানাকড়ি সময়ও
তবু প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।
আপসে মেনে নেওয়া যেন নিয়তি তোমার।
যতক্ষণ ওই নিষ্ঠুর চাপানো নিয়তির তীব্র যন্ত্রণা কুরে কুরে না খায়
যতক্ষণ না তা অসহনীয় হয়ে ওঠে
ততক্ষণ যেন তা তোমার গায়ে সয়ে রয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
[জন লেনন (১৯৪০-১৯৮০)–এর ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’ গানের ভাবালম্বনে]
১
সমাজে শ্রম কিংবা শ্রমিকের জীবনের মূল্য কত? তার পরিমাপ বা চিত্রায়ণ হয় কীরূপে? সেই ভাবনায় জন লেননের কালজয়ী গান ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’–এর কথা মনে পড়ে। গানে গানে যুক্তরাজ্যের কবি–চিত্রশিল্পী–লেখক-গায়ক-সংগঠক জন লেনন শ্রমিকের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই…প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।’ মনে পড়ে রোকেয়া সাখাওয়াতের লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধের লাইন, ‘শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া লওয়া হয়।’ রোকেয়া সাখাওয়াত যদিও নারীদের অবস্থা নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, কিন্তু এ কথা সব নারী–পুরুষ শ্রমিকের বেলায় সমান প্রযোজ্য। এমনই সেকাল-একালে সময় যত গড়ায়, নতুন এ জমানার নারী ও পুরুষ শ্রমিক যেন আধুনিক দাসের লেবাসে পর্দায় পা রাখেন। এ বিষয়ে সমাজের ওপরতলা থেকে খোদ শ্রমজীবীদের বাহাস-লড়াই ইতিহাসে কালে কালে চলমান থাকে। কখনো কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক দিনে, আন্দোলনমুখর মুহূর্তে কিংবা কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে এ আলাপ ওঠে তুঙ্গে। ‘জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান’ আমাদের সেই রকম ক্ষণে হাজির করেছে। তাই এ যাত্রায় লড়াইয়ের ময়দানে, পুলিশের লাঠি-বারুদ-কাঁদানে গ্যাসের শেল কিংবা বন্দুকের নলের মুখে, মন্ত্রণালয়ের টেবিলে, জুলাই–পরবর্তী নানা সংস্কার কমিশনে অথবা দেশি–বিদেশি সরকার-মালিকদের নির্দেশনামা-পরিকল্পনা-রোডম্যাপে কিংবা সুধী সমাজের গবেষণা-সভা-সেমিনারে জাতীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির আলাপে শ্রমিক কল্যাণ প্রশ্নের ঠাঁই জুটেছে।
এটাকে কেউ কেউ ইতিহাসের দায় মেটানোর ও পাকাপোক্ত জবাবদিহির কাঠামো তৈরির সুযোগ বলেও চিহ্নিত করতে পারেন। একই সঙ্গে চিহ্নিত করতে পারেন চব্বিশ গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থী-শ্রমজীবী, নারী-শিশুর জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এক সুবর্ণরেখায়। সন্দেহ নেই, এই রেখা বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বিশেষ মুহূর্ত। এই মুহূর্তের দায় খুব তাড়াহুড়োয় বা রাতারাতি পূরণ সম্ভব নয়, তা–ও জানি। কিন্তু দিন শেষে এই দায় অপূরণীয় থাকলে আর যেই ছাড়ুক, ইতিহাস পিছু ছাড়বে না।
২
সমাজে শ্রমজীবীর আসল পরিচয় কী? তাঁর পাওয়া না–পাওয়া বা অধিকারই–বা কী? জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের সংযোগ কী? সমাজের বাস্তব পাটাতনে এই হিসাব-নিকাশ বাদ দেওয়ার পথ নেই। নতুন করে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এখন আবশ্যক। কারণ, শ্রমিকের মৌলিক অধিকার কী অবস্থায় আছে, সেই আলাপ ছাড়া দেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও উন্নতির অগ্রগতির পরিমাপ সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ সশরীর বিদায় হলেই শ্রমিক ও জনগণের জীবনমানে উন্নতি হয় না। মন ও মননে গেড়ে বসত করা ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির সমূলে বদল হলে তবেই শ্রমিকের নাগরিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভয়মুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়। সুগম হয় জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ। তাই সমাজে বিরাজমান শ্রেণি-জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্যের আলোকে এই চাওয়া-পাওয়ার সীমাকে পাঠ করতে হবে। বিশেষভাবে এ ক্ষেত্রে যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক, নারী শ্রমিকের ওপর চাপানো ঘর-গেরস্তালি ও কর্মস্থলের দ্বৈত বোঝা এবং শ্রম খাত ও শ্রমিকের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রশ্নও।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলনে জান, জীবিকা ও জবানের অধিকার, নারী-পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গের সম–অধিকার এবং নাগরিক মর্যাদা প্রথম চাওয়া। পাশাপাশি দরকার ক্ষতিপূরণ ও মজুরির মর্যাদাপূর্ণ মানদণ্ড নির্ধারণসহ ন্যায়সংগত অধিকারের বাস্তবায়ন, যা পূরণে দেশে একটি অভিন্ন গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, মর্যাদাপূর্ণ খাতভিত্তিক ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরির মতো সব অধিকারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তেমনি আবশ্যক মতপ্রকাশ, সংগঠন ও প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ইউনিয়নের চর্চা বন্ধে আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন চলমান রাখা।
একই সঙ্গে শ্রমিক ও শ্রম খাত–সম্পর্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ [শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, শ্রম শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়াতন আইআরআই, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ ইত্যাকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) সর্বত্র জবাবদিহি, গণতান্ত্রিক চর্চা, স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকেও প্রতিষ্ঠিত করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার সময় এটা। এসব বাস্তবায়নের খাতিরে যথাযথ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা-উদ্যোগ ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই।
মাঠের লড়াই, আইনি লড়াই ও সাংস্কৃতিক লড়াই—এই তিন ময়দানেই সমসক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন আবারও শ্রমিক ও জনগণের হাতছাড়া হবে। তাই শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় নির্ধারণ এবং অধিকার বাস্তবায়নের রাজনীতি নতুন মাত্রায় সক্রিয়-সজ্জিত রাখা এখন সময়ের আকাঙ্ক্ষা। দিন শেষে শ্রমিকের জীবন কেমন হবে, সেটি কেবল শ্রমিকপক্ষ কিংবা উদ্যোক্তারা বিচ্ছিন্নভাবে নির্ধারণ করেন না। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। ফলে একে রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে বিচার করার পথ নেই।
শ্রমিকের জীবনমান ও শ্রম খাতের বিকাশের সঙ্গে পুরো দেশের নাগরিকের জীবন, গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। তাই এ খাতের উন্নয়ন বাস্তবায়নে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও মনোনিবেশ করা শ্রমিক আন্দোলনের এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক কর্তব্য। বাংলাদেশের আর যেকোনো সময়ের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়কে গুলিয়ে ফেললে ইতিহাসে সেই ভুলের মাশুল টেনে বেড়াতে হবে।
বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তি প্রায় সাড়ে সাত কোটি। মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তারা। তরুণ নারী-পুরুষ মিলে ভোটের হিসাবেও এটি কোনো অংশে ছোট নয়। অথচ এর প্রায় ৮৫ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। যাঁদের কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। তাঁদের জীবনে মঙ্গল প্রদীপের ছোঁয়া লাগাতে এবং শ্রম ও শিল্প খাতকে শক্তিশালী করতে কী কী প্রয়োজন? সেই আলাপ অন্যান্য আলাপের সঙ্গে এখন সামনের সারিতে। অন্তর্বর্তী সরকারই কেবল নয়, শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের এবং প্রবীণ-নবীন দুই প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের কাছেও বিশেষ ভূমিকা জাতি আকাঙ্ক্ষা করে এই সময়ে।
এই ভূমিকার সীমা কানাগলিতে আটকে থাকার নয়। এই প্রশ্নে সরব হওয়া কর্তব্য দেশপ্রেমিক-জনস্বার্থের পক্ষে থাকা ছাত্র-শিক্ষক, নারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, আইনজীবী, গবেষক, লেখকসহ নানা পেশার সংগঠক–সংগঠনের সচেতন নাগরিকের। যাতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত হয়।
কোনো রাষ্ট্রে জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা, ভোটাধিকার, জবাবদিহি দিন দিন নাই হতে থাকলে সমাজ কী চেহারা নেয়, তা সবার জানা। স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছায়, ক্ষমতা হয়ে উঠে ব্যক্তির গোষ্ঠীর লুটপাটের হাতিয়ার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসে। ক্রমে ফ্যাসিবাদ শিকড়ে–বাকড়ে ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জমিনে–আসমানে।৩
শ্রমিকের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে শ্রম আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন সংশোধন ও সংস্কার উদ্যোগের মধ্যেও এর গুরুত্ব টের পাওয়া যায়। এটি সমাজের আয়না বা দর্পণের মতো। বিশেষত, সমাজের ওপরতলার জন, ক্ষমতাশালী দল ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রম আইনের চলাচল। আইন কখনো হতে পারে রক্ষাকবচ, কখনোবা মারণাস্ত্র। যদিও ৮৫ ভাগ শ্রমিক এর আওতার বাইরে, তারপরও গণ–অভ্যুত্থানে পাওয়া নতুন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আইনে পরিবর্তন ও সংস্কার নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। কেননা, ভবিষ্যতে সব শ্রমিকের স্বীকৃতি, তাঁদের কপালের লিখন এবং এই খাতের বিকাশে শ্রমিকের হিস্যা কতটুকু, কতটুকু জবান ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থাকবে—এসবের পূর্বাভাস মিলবে আইনে। অনুগ্রহ বা দয়াদাক্ষিণ্যে নয়, আইনে নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি জন্মায়। তাই বর্তমান আইনের সংস্কার ও পরিবর্তন এমন হওয়া দরকার, যাতে তার ফলাফল শতভাগ শ্রমশক্তি ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারে। দরকার বাস্তবায়নের জন্য লড়াই। সংবিধান, শ্রম আইনবিধি, ফৌজদারি আইন, পারিবারিক আইন, নারী নীতি, নারীবিষয়ক প্রস্তাবনা যাতে পারস্পরিক সংঘাতপূর্ণ, দ্বন্দ্বের বা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী-অগণতান্ত্রিক না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ যাতে ঘটে শ্রম আইনে, তার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে সবাইকে।
সংসদ আইন প্রণীত হওয়ার স্থান। বিগত সময়ে মালিক বা উদ্যোক্তারা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে গিয়েছেন, আইন তৈরি করেছেন। সেখানে মালিকপক্ষের স্বার্থই প্রধানত রক্ষিত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রবলভাবে তৈরি করেছেন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ। আইন প্রায়ই ব্যবহৃত হয়েছে নিপীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অস্ত্র আকারে। সংবিধানে সংগঠন ও মত প্রকাশ করা জনগণের মৌলিক অধিকার বলা হলেও সংগঠন করাতেই এসেছে সরকার-মালিকের সম্মিলিত কায়দায় যত বাধা। সংবিধানে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের পক্ষের সংগঠনগুলো। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমশক্তি ব্যবস্থাপনার নামে এমন বাধা–নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যাতে নিয়মনীতির মধ্যে ইউনিয়ন করা কঠিনতর হয়।
‘সিংহকে বশে’ রাখার চিন্তার প্রভাব যেন খুঁজে পাওয়া যায় ইউনিয়ন করার আইনি বিধিবিধানে। রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে শতকরা হার আরোপসহ নানা যে শর্ত, তা পূরণ প্রায়ই অসম্ভব। কারণ, এসব পাহাড়সম শর্ত আদতে নিষেধের সমান। প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়নের অন্যতম বাধা এসব শর্ত। অর্থাৎ স্পষ্ট ও সহজ বিধির বদলে পরোক্ষভাবে এমন বিধান আইনে যুক্ত আছে, যাতে শ্রমিক স্বার্থে প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হতে না পারে। মালিকপক্ষের যত ভীতি এই ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন সংগঠন ও সংগঠকদের নিয়ে।
বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমন রেজিস্টার্ড ইউনিয়ন-ফেডারেশন যার বেশির ভাগ মালিক-সরকারের ‘বশে’ থাকা বা বিদেশিদের সুনজরে থাকা। এ রকম ‘বশে’ থাকা ইউনিয়ন শ্রমিক কল্যাণের প্রকৃত আধার হওয়ার চরিত্র হারাতে বাধ্য। এ ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের খুব সামান্য কিছু সংগঠনকে দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে রেজিস্ট্রেশন পেলেও তা কাগজে–কলমে আছে। বাস্তবে ততটা চর্চার সুযোগ থাকে না। রেজিস্ট্রেশন করলে, সংঘগুলোর সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃত হলে, সবার তাতে স্বীকৃতি ও আইনি অধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় শ্রমিকের স্বার্থের পক্ষের সংঘগুলো ক্রমেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে এই প্রক্রিয়ায়। প্রকৃত ইউনিয়ন তৈরির সব পথই যেন রুদ্ধ, অনিয়ম-দুর্নীতি যখন নিয়ম, তখন মাঠের আন্দোলনই সংগঠিত ও দাবি আদায়ের অন্যতম পথ হয়।
শ্রম আইনের সঙ্গে আদালতেও রয়েছে জটলা। শ্রম আদালতের শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত সর্বত্র নেই বাংলা ভাষার প্রচলন। শ্রম আইন তৈরি হয়েছে এমন বাংলা ভাষার গঠনে, যা সাধারণ শ্রমিক তো দূরে থাক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্যও নাকানিচুবানির দশা। দ্রুত নিষ্পত্তি নেই মামলার, নেই পর্যাপ্ত আদালত। শ্রমিক কখনো শ্রম আইনে ছাঁটাই-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কখনোবা ফৌজদারি মামলায় জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। এত কিছুর পরও আইনকে ধরাছোঁয়ার বাইরে কিংবা মধ্যপন্থা বা সরল দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। আইন নিয়ে সরব থাকার সময় এটা। তবে সরবে পঞ্চমুখ হয়ে উচিত কথা বললেই সব সমস্যার সমাধান হবে বা রাত পোহালে সব বাস্তবায়ন হবে, তা–ও নয়। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়েও আমার-আপনার শ্রমিক প্রশ্নে নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া এবং তার ঘোষণা নিতে দোটানা থাকলে, সেটার হিসাবও ইতিহাস করবে। তরুণ প্রজন্ম, আগামী প্রজন্ম করবে। তাই রব তুলতেই হবে এই সময়ে। একসময়ে তার প্রতিধ্বনি হবেই।
এযাবৎ বিদ্যমান মজুরি, শ্রমঘণ্টা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার—কোনোকিছুই শ্রমিকের আকাঙ্ক্ষার স্মারক নয়। কর্মপরিবেশ, নারী-পুরুষের সমান অবস্থান, দক্ষতা—সব ক্ষেত্রেই অধিকার দিন দিন যেন সংকুচিত হচ্ছে। নারীরা শ্রমশক্তির বড় অংশ হলেও নাগরিক মর্যাদা তো দূরে থাক, দক্ষ শ্রমিক হওয়ার সুযোগটুকু পাচ্ছেন না। মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি, ডে–কেয়ার, যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা, অভিযোগ নিষ্পত্তিসহ নানা দাবি করে আসছেন তাঁরা। আইন আর ন্যায্যতার ফারাক টেনে শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছেন। সর্বোপরি দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতিতে বেহাল আছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা। তাই বর্তমান কাঠামোয় লড়াই করে ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তিতে শ্রমিকদের পাওনাগুলো আদায়ে মতাদর্শিক ও মাঠের লড়াই জীবন্ত থাকা দরকার।
লুটেরা ও নয়া উদারনীতি অর্থনীতির প্রাধান্য ও জাতীয় অর্থনীতির যথাযথ বিকাশ না হওয়ায় আমাদের দেশে আর দশটা গণতান্ত্রিক দেশের মতো শ্রমিকদের অবস্থান ও অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। সুরক্ষিত হয়নি শিল্প খাত। সুরক্ষার বদলে একধরনে নীতিবিরুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চার সুযোগ সরকার ও মালিকপক্ষ এযাবৎকাল জারি রেখেছে। দিন শেষে সেই চর্চা এই খাতের ক্ষয়ই ডেকে এনেছে। দাঁড় করিয়েছে এক বুমেরাং সিন্ডিকেট চক্র, যা দুষ্টচক্রের মতো এই খাতকে বারবার আঘাতে হেনেছে। বঞ্চিত করেছে শ্রমিককে।
শ্রমিকের অধিকার অনিশ্চিত রেখে উৎপাদশীলতা ও শ্রম খাতের বিকাশ সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি মালিকশ্রেণিরও আসতে হবে। হয়তো এর জন্য শ্রমিক ও অর্থনীতির গতিপথকে আরও বিকশিত ও রক্তাক্ত হতে হবে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক-ভূরাজনৈতিক অবস্থার এবং শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দক্ষতা তৈরির কারণে বাংলাদেশে সামনে রপ্তানিভিত্তিক খাতে অমিত সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। সেই সম্ভাবনা অর্জনে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাসহ প্রবীণদেরও নতুন করে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু আন্তর্জাতিক নয়, দেশীয় নতুন নতুন বাজার, খাত ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী না হলে আত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা পরিষদের সামনে চা–শ্রমিকদের অবস্থান (২২ আগস্ট, ২০২২).উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক শ রমশক ত প রজন ম অবস থ ন পরবর ত জনগণ র র জন ত কল য ণ র জন য কপক ষ ম আইন আইন র স গঠন দরক র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।
এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?
আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?
হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!
মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’
আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!
তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।
একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।
টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।
একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।
যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।
আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।
তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’
যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?
যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।
সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।
হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।
এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।
এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।
এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।
আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।
কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।
ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।
বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।
নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।
বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।
ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব