গণ-অভ্যুত্থানে শ্রমিক আকাঙ্ক্ষা: সমাজ ও সংস্কৃতিতে শ্রমিক সুরত
Published: 23rd, March 2025 GMT
বাধা ডিঙিয়ে হয় না পাখা মেলা
জন্ম থেকেই জোটে না কানাকড়ি সময়ও
তবু প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।
আপসে মেনে নেওয়া যেন নিয়তি তোমার।
যতক্ষণ ওই নিষ্ঠুর চাপানো নিয়তির তীব্র যন্ত্রণা কুরে কুরে না খায়
যতক্ষণ না তা অসহনীয় হয়ে ওঠে
ততক্ষণ যেন তা তোমার গায়ে সয়ে রয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
একজন শ্রমিকশ্রেণির নায়ক হওয়া সহজ কথা নয়
[জন লেনন (১৯৪০-১৯৮০)–এর ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’ গানের ভাবালম্বনে]
১
সমাজে শ্রম কিংবা শ্রমিকের জীবনের মূল্য কত? তার পরিমাপ বা চিত্রায়ণ হয় কীরূপে? সেই ভাবনায় জন লেননের কালজয়ী গান ‘শ্রমিকশ্রেণির নায়ক’–এর কথা মনে পড়ে। গানে গানে যুক্তরাজ্যের কবি–চিত্রশিল্পী–লেখক-গায়ক-সংগঠক জন লেনন শ্রমিকের পরিচয় সম্পর্কে বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই…প্রতিক্ষণে তোমায় ক্ষুদ্র-তুচ্ছ ভাবায় তারা।’ মনে পড়ে রোকেয়া সাখাওয়াতের লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ প্রবন্ধের লাইন, ‘শিখিবার পূর্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া লওয়া হয়।’ রোকেয়া সাখাওয়াত যদিও নারীদের অবস্থা নিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন, কিন্তু এ কথা সব নারী–পুরুষ শ্রমিকের বেলায় সমান প্রযোজ্য। এমনই সেকাল-একালে সময় যত গড়ায়, নতুন এ জমানার নারী ও পুরুষ শ্রমিক যেন আধুনিক দাসের লেবাসে পর্দায় পা রাখেন। এ বিষয়ে সমাজের ওপরতলা থেকে খোদ শ্রমজীবীদের বাহাস-লড়াই ইতিহাসে কালে কালে চলমান থাকে। কখনো কোনো বিশেষ ঐতিহাসিক দিনে, আন্দোলনমুখর মুহূর্তে কিংবা কোনো মাহেন্দ্রক্ষণে এ আলাপ ওঠে তুঙ্গে। ‘জুলাই ২০২৪ গণ-অভ্যুত্থান’ আমাদের সেই রকম ক্ষণে হাজির করেছে। তাই এ যাত্রায় লড়াইয়ের ময়দানে, পুলিশের লাঠি-বারুদ-কাঁদানে গ্যাসের শেল কিংবা বন্দুকের নলের মুখে, মন্ত্রণালয়ের টেবিলে, জুলাই–পরবর্তী নানা সংস্কার কমিশনে অথবা দেশি–বিদেশি সরকার-মালিকদের নির্দেশনামা-পরিকল্পনা-রোডম্যাপে কিংবা সুধী সমাজের গবেষণা-সভা-সেমিনারে জাতীয় অর্থনীতির গতিপ্রকৃতির আলাপে শ্রমিক কল্যাণ প্রশ্নের ঠাঁই জুটেছে।
এটাকে কেউ কেউ ইতিহাসের দায় মেটানোর ও পাকাপোক্ত জবাবদিহির কাঠামো তৈরির সুযোগ বলেও চিহ্নিত করতে পারেন। একই সঙ্গে চিহ্নিত করতে পারেন চব্বিশ গণ-অভ্যুত্থানের শিক্ষার্থী-শ্রমজীবী, নারী-শিশুর জীবনের বিনিময়ে পাওয়া এক সুবর্ণরেখায়। সন্দেহ নেই, এই রেখা বাংলাদেশের জনগণের জন্য এক বিশেষ মুহূর্ত। এই মুহূর্তের দায় খুব তাড়াহুড়োয় বা রাতারাতি পূরণ সম্ভব নয়, তা–ও জানি। কিন্তু দিন শেষে এই দায় অপূরণীয় থাকলে আর যেই ছাড়ুক, ইতিহাস পিছু ছাড়বে না।
২
সমাজে শ্রমজীবীর আসল পরিচয় কী? তাঁর পাওয়া না–পাওয়া বা অধিকারই–বা কী? জাতীয় অর্থনীতির বিকাশের সঙ্গে শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের সংযোগ কী? সমাজের বাস্তব পাটাতনে এই হিসাব-নিকাশ বাদ দেওয়ার পথ নেই। নতুন করে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এখন আবশ্যক। কারণ, শ্রমিকের মৌলিক অধিকার কী অবস্থায় আছে, সেই আলাপ ছাড়া দেশে গণতন্ত্র, জবাবদিহি ও উন্নতির অগ্রগতির পরিমাপ সম্ভব নয়। ফ্যাসিবাদ সশরীর বিদায় হলেই শ্রমিক ও জনগণের জীবনমানে উন্নতি হয় না। মন ও মননে গেড়ে বসত করা ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির সমূলে বদল হলে তবেই শ্রমিকের নাগরিক-গণতান্ত্রিক অধিকার ও ভয়মুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরির পথ প্রশস্ত হয়। সুগম হয় জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ। তাই সমাজে বিরাজমান শ্রেণি-জাত-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্যের আলোকে এই চাওয়া-পাওয়ার সীমাকে পাঠ করতে হবে। বিশেষভাবে এ ক্ষেত্রে যুক্ত করা প্রাসঙ্গিক, নারী শ্রমিকের ওপর চাপানো ঘর-গেরস্তালি ও কর্মস্থলের দ্বৈত বোঝা এবং শ্রম খাত ও শ্রমিকের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব প্রশ্নও।
বলার অপেক্ষা রাখে না, গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলনে জান, জীবিকা ও জবানের অধিকার, নারী-পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গের সম–অধিকার এবং নাগরিক মর্যাদা প্রথম চাওয়া। পাশাপাশি দরকার ক্ষতিপূরণ ও মজুরির মর্যাদাপূর্ণ মানদণ্ড নির্ধারণসহ ন্যায়সংগত অধিকারের বাস্তবায়ন, যা পূরণে দেশে একটি অভিন্ন গণতান্ত্রিক শ্রম আইন, মর্যাদাপূর্ণ খাতভিত্তিক ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরির মতো সব অধিকারের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। তেমনি আবশ্যক মতপ্রকাশ, সংগঠন ও প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিগ্রস্ত ইউনিয়নের চর্চা বন্ধে আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন চলমান রাখা।
একই সঙ্গে শ্রমিক ও শ্রম খাত–সম্পর্কিত সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ [শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, শ্রম কল্যাণ কেন্দ্র, শ্রম শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়াতন আইআরআই, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ ইত্যাকার সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) সর্বত্র জবাবদিহি, গণতান্ত্রিক চর্চা, স্বচ্ছতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারকেও প্রতিষ্ঠিত করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার সময় এটা। এসব বাস্তবায়নের খাতিরে যথাযথ রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা-উদ্যোগ ও ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই।
মাঠের লড়াই, আইনি লড়াই ও সাংস্কৃতিক লড়াই—এই তিন ময়দানেই সমসক্রিয় উপস্থিতি ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন আবারও শ্রমিক ও জনগণের হাতছাড়া হবে। তাই শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ পরিচয় নির্ধারণ এবং অধিকার বাস্তবায়নের রাজনীতি নতুন মাত্রায় সক্রিয়-সজ্জিত রাখা এখন সময়ের আকাঙ্ক্ষা। দিন শেষে শ্রমিকের জীবন কেমন হবে, সেটি কেবল শ্রমিকপক্ষ কিংবা উদ্যোক্তারা বিচ্ছিন্নভাবে নির্ধারণ করেন না। এটি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। ফলে একে রাজনীতি নিরপেক্ষভাবে বিচার করার পথ নেই।
শ্রমিকের জীবনমান ও শ্রম খাতের বিকাশের সঙ্গে পুরো দেশের নাগরিকের জীবন, গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্পর্ক জড়িয়ে আছে। তাই এ খাতের উন্নয়ন বাস্তবায়নে আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও মনোনিবেশ করা শ্রমিক আন্দোলনের এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক কর্তব্য। বাংলাদেশের আর যেকোনো সময়ের সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী এই সময়কে গুলিয়ে ফেললে ইতিহাসে সেই ভুলের মাশুল টেনে বেড়াতে হবে।
বর্তমানে দেশের মোট শ্রমশক্তি প্রায় সাড়ে সাত কোটি। মোট জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তারা। তরুণ নারী-পুরুষ মিলে ভোটের হিসাবেও এটি কোনো অংশে ছোট নয়। অথচ এর প্রায় ৮৫ ভাগ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। যাঁদের কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। তাঁদের জীবনে মঙ্গল প্রদীপের ছোঁয়া লাগাতে এবং শ্রম ও শিল্প খাতকে শক্তিশালী করতে কী কী প্রয়োজন? সেই আলাপ অন্যান্য আলাপের সঙ্গে এখন সামনের সারিতে। অন্তর্বর্তী সরকারই কেবল নয়, শ্রমিক আন্দোলনের সংগঠকদের এবং প্রবীণ-নবীন দুই প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের কাছেও বিশেষ ভূমিকা জাতি আকাঙ্ক্ষা করে এই সময়ে।
এই ভূমিকার সীমা কানাগলিতে আটকে থাকার নয়। এই প্রশ্নে সরব হওয়া কর্তব্য দেশপ্রেমিক-জনস্বার্থের পক্ষে থাকা ছাত্র-শিক্ষক, নারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, আইনজীবী, গবেষক, লেখকসহ নানা পেশার সংগঠক–সংগঠনের সচেতন নাগরিকের। যাতে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের দিকে ধাবিত হয়।
কোনো রাষ্ট্রে জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা, ভোটাধিকার, জবাবদিহি দিন দিন নাই হতে থাকলে সমাজ কী চেহারা নেয়, তা সবার জানা। স্বেচ্ছাচারিতা চরমে পৌঁছায়, ক্ষমতা হয়ে উঠে ব্যক্তির গোষ্ঠীর লুটপাটের হাতিয়ার। বিচারহীনতার সংস্কৃতি জেঁকে বসে। ক্রমে ফ্যাসিবাদ শিকড়ে–বাকড়ে ছড়িয়ে পড়ে রাষ্ট্রের জমিনে–আসমানে।৩
শ্রমিকের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে শ্রম আইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন সংশোধন ও সংস্কার উদ্যোগের মধ্যেও এর গুরুত্ব টের পাওয়া যায়। এটি সমাজের আয়না বা দর্পণের মতো। বিশেষত, সমাজের ওপরতলার জন, ক্ষমতাশালী দল ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রম আইনের চলাচল। আইন কখনো হতে পারে রক্ষাকবচ, কখনোবা মারণাস্ত্র। যদিও ৮৫ ভাগ শ্রমিক এর আওতার বাইরে, তারপরও গণ–অভ্যুত্থানে পাওয়া নতুন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আইনে পরিবর্তন ও সংস্কার নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার। কেননা, ভবিষ্যতে সব শ্রমিকের স্বীকৃতি, তাঁদের কপালের লিখন এবং এই খাতের বিকাশে শ্রমিকের হিস্যা কতটুকু, কতটুকু জবান ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার থাকবে—এসবের পূর্বাভাস মিলবে আইনে। অনুগ্রহ বা দয়াদাক্ষিণ্যে নয়, আইনে নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি জন্মায়। তাই বর্তমান আইনের সংস্কার ও পরিবর্তন এমন হওয়া দরকার, যাতে তার ফলাফল শতভাগ শ্রমশক্তি ভবিষ্যতে ব্যবহার করতে পারে। দরকার বাস্তবায়নের জন্য লড়াই। সংবিধান, শ্রম আইনবিধি, ফৌজদারি আইন, পারিবারিক আইন, নারী নীতি, নারীবিষয়ক প্রস্তাবনা যাতে পারস্পরিক সংঘাতপূর্ণ, দ্বন্দ্বের বা শ্রমিক স্বার্থবিরোধী-অগণতান্ত্রিক না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখবে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটাই জনগণের প্রত্যাশা। সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ যাতে ঘটে শ্রম আইনে, তার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে সবাইকে।
সংসদ আইন প্রণীত হওয়ার স্থান। বিগত সময়ে মালিক বা উদ্যোক্তারা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সংসদে গিয়েছেন, আইন তৈরি করেছেন। সেখানে মালিকপক্ষের স্বার্থই প্রধানত রক্ষিত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে প্রবলভাবে তৈরি করেছেন প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ। আইন প্রায়ই ব্যবহৃত হয়েছে নিপীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার অস্ত্র আকারে। সংবিধানে সংগঠন ও মত প্রকাশ করা জনগণের মৌলিক অধিকার বলা হলেও সংগঠন করাতেই এসেছে সরকার-মালিকের সম্মিলিত কায়দায় যত বাধা। সংবিধানে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের পক্ষের সংগঠনগুলো। ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে শ্রমশক্তি ব্যবস্থাপনার নামে এমন বাধা–নিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যাতে নিয়মনীতির মধ্যে ইউনিয়ন করা কঠিনতর হয়।
‘সিংহকে বশে’ রাখার চিন্তার প্রভাব যেন খুঁজে পাওয়া যায় ইউনিয়ন করার আইনি বিধিবিধানে। রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে শতকরা হার আরোপসহ নানা যে শর্ত, তা পূরণ প্রায়ই অসম্ভব। কারণ, এসব পাহাড়সম শর্ত আদতে নিষেধের সমান। প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়নের অন্যতম বাধা এসব শর্ত। অর্থাৎ স্পষ্ট ও সহজ বিধির বদলে পরোক্ষভাবে এমন বিধান আইনে যুক্ত আছে, যাতে শ্রমিক স্বার্থে প্রকৃত ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হতে না পারে। মালিকপক্ষের যত ভীতি এই ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন সংগঠন ও সংগঠকদের নিয়ে।
বিগত সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমন রেজিস্টার্ড ইউনিয়ন-ফেডারেশন যার বেশির ভাগ মালিক-সরকারের ‘বশে’ থাকা বা বিদেশিদের সুনজরে থাকা। এ রকম ‘বশে’ থাকা ইউনিয়ন শ্রমিক কল্যাণের প্রকৃত আধার হওয়ার চরিত্র হারাতে বাধ্য। এ ছাড়া শ্রমিক স্বার্থের খুব সামান্য কিছু সংগঠনকে দেশের বিশেষ পরিস্থিতিতে রেজিস্ট্রেশন পেলেও তা কাগজে–কলমে আছে। বাস্তবে ততটা চর্চার সুযোগ থাকে না। রেজিস্ট্রেশন করলে, সংঘগুলোর সুযোগ-সুবিধা বিস্তৃত হলে, সবার তাতে স্বীকৃতি ও আইনি অধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়ায় শ্রমিকের স্বার্থের পক্ষের সংঘগুলো ক্রমেই নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে এই প্রক্রিয়ায়। প্রকৃত ইউনিয়ন তৈরির সব পথই যেন রুদ্ধ, অনিয়ম-দুর্নীতি যখন নিয়ম, তখন মাঠের আন্দোলনই সংগঠিত ও দাবি আদায়ের অন্যতম পথ হয়।
শ্রম আইনের সঙ্গে আদালতেও রয়েছে জটলা। শ্রম আদালতের শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্ট ও অ্যাপিলেট ডিভিশন পর্যন্ত সর্বত্র নেই বাংলা ভাষার প্রচলন। শ্রম আইন তৈরি হয়েছে এমন বাংলা ভাষার গঠনে, যা সাধারণ শ্রমিক তো দূরে থাক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের জন্যও নাকানিচুবানির দশা। দ্রুত নিষ্পত্তি নেই মামলার, নেই পর্যাপ্ত আদালত। শ্রমিক কখনো শ্রম আইনে ছাঁটাই-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কখনোবা ফৌজদারি মামলায় জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। এত কিছুর পরও আইনকে ধরাছোঁয়ার বাইরে কিংবা মধ্যপন্থা বা সরল দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ নেই। আইন নিয়ে সরব থাকার সময় এটা। তবে সরবে পঞ্চমুখ হয়ে উচিত কথা বললেই সব সমস্যার সমাধান হবে বা রাত পোহালে সব বাস্তবায়ন হবে, তা–ও নয়। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়েও আমার-আপনার শ্রমিক প্রশ্নে নির্দিষ্ট অবস্থান নেওয়া এবং তার ঘোষণা নিতে দোটানা থাকলে, সেটার হিসাবও ইতিহাস করবে। তরুণ প্রজন্ম, আগামী প্রজন্ম করবে। তাই রব তুলতেই হবে এই সময়ে। একসময়ে তার প্রতিধ্বনি হবেই।
এযাবৎ বিদ্যমান মজুরি, শ্রমঘণ্টা, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার—কোনোকিছুই শ্রমিকের আকাঙ্ক্ষার স্মারক নয়। কর্মপরিবেশ, নারী-পুরুষের সমান অবস্থান, দক্ষতা—সব ক্ষেত্রেই অধিকার দিন দিন যেন সংকুচিত হচ্ছে। নারীরা শ্রমশক্তির বড় অংশ হলেও নাগরিক মর্যাদা তো দূরে থাক, দক্ষ শ্রমিক হওয়ার সুযোগটুকু পাচ্ছেন না। মাতৃত্বকালীন ছয় মাস ছুটি, ডে–কেয়ার, যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতাবিরোধী নীতিমালা, অভিযোগ নিষ্পত্তিসহ নানা দাবি করে আসছেন তাঁরা। আইন আর ন্যায্যতার ফারাক টেনে শ্রমিক বঞ্চিত হচ্ছেন। সর্বোপরি দ্রব্যমূল্যর ঊর্ধ্বগতি, মুদ্রাস্ফীতিতে বেহাল আছেন নারী ও পুরুষ শ্রমিকেরা। তাই বর্তমান কাঠামোয় লড়াই করে ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তিতে শ্রমিকদের পাওনাগুলো আদায়ে মতাদর্শিক ও মাঠের লড়াই জীবন্ত থাকা দরকার।
লুটেরা ও নয়া উদারনীতি অর্থনীতির প্রাধান্য ও জাতীয় অর্থনীতির যথাযথ বিকাশ না হওয়ায় আমাদের দেশে আর দশটা গণতান্ত্রিক দেশের মতো শ্রমিকদের অবস্থান ও অধিকার সুরক্ষিত হয়নি। সুরক্ষিত হয়নি শিল্প খাত। সুরক্ষার বদলে একধরনে নীতিবিরুদ্ধ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চার সুযোগ সরকার ও মালিকপক্ষ এযাবৎকাল জারি রেখেছে। দিন শেষে সেই চর্চা এই খাতের ক্ষয়ই ডেকে এনেছে। দাঁড় করিয়েছে এক বুমেরাং সিন্ডিকেট চক্র, যা দুষ্টচক্রের মতো এই খাতকে বারবার আঘাতে হেনেছে। বঞ্চিত করেছে শ্রমিককে।
শ্রমিকের অধিকার অনিশ্চিত রেখে উৎপাদশীলতা ও শ্রম খাতের বিকাশ সম্ভব নয়। এই উপলব্ধি মালিকশ্রেণিরও আসতে হবে। হয়তো এর জন্য শ্রমিক ও অর্থনীতির গতিপথকে আরও বিকশিত ও রক্তাক্ত হতে হবে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক-ভূরাজনৈতিক অবস্থার এবং শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের দক্ষতা তৈরির কারণে বাংলাদেশে সামনে রপ্তানিভিত্তিক খাতে অমিত সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। সেই সম্ভাবনা অর্জনে নতুন প্রজন্মের উদ্যোক্তাসহ প্রবীণদেরও নতুন করে শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু আন্তর্জাতিক নয়, দেশীয় নতুন নতুন বাজার, খাত ও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মনোযোগী না হলে আত্মনির্ভরশীল জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ বারবার মুখ থুবড়ে পড়বে।
মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলা পরিষদের সামনে চা–শ্রমিকদের অবস্থান (২২ আগস্ট, ২০২২).উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গণত ন ত র ক শ রমশক ত প রজন ম অবস থ ন পরবর ত জনগণ র র জন ত কল য ণ র জন য কপক ষ ম আইন আইন র স গঠন দরক র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সংসদে সংরক্ষিত আসন, না তৃণমূল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ?
সম্প্রতি জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতার একটি ভিডিও ক্লিপ অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সেখানে তাঁকে বলতে শোনা যায়, বর্তমান সংবিধানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বলে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তির মেয়ে, স্ত্রী, খালা, ফুফু এবং গায়িকা মমতাজের মতো নারীরা সংসদ সদস্য হয়ে যান।
তাই তাঁর দল এনসিপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়ে বর্তমান সংবিধানের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার পরিবর্তে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে ১০০ জন নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের সুপারিশকে সমর্থন করে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের মতো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনও বলেছে, বর্তমান সাংবিধানিক বিধানে নারীর ক্ষমতায়ন হয় না।
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ১০০টি নয়, বর্তমান ৩০০ সাধারণ আসনের বিপরীতে নারীদের জন্য একটি করে আসন সংরক্ষিত থাকবে। এই ৩০০ আসন থেকে নারীরা জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন।
অর্থাৎ জাতীয় সংসদের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা হবে ৬০০। এর মধ্যে ৩০০ হবে সাধারণ আসন, যেখানে নারী ও পুরুষ সবাই প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। এ ছাড়াও নারীরা সংরক্ষিত ৩০০ আসনে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন।
নির্মোহভাবে বলতে গেলে, সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে, সেটি যুক্তিসম্মত। নির্বাহী বিভাগকে জবাবদিহি করার পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বন্দনা করে সংসদে গান গাইলে সংরক্ষিত মহিলা আসনের বিধান নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক।
তবে ব্যতিক্রমও রয়েছে। একাদশ সংসদে সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানা একাই তাঁর খুবই তথ্যসমৃদ্ধ, সুনির্দিষ্ট বক্তব্যের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের চেহারা উন্মোচন করে সংসদে বক্তব্য রাখতেন। আইন প্রণয়নেও তিনি প্রতিটি ধারা অনুসারে আলোচনা করে যথার্থ আইনপ্রণেতার মতোই ভূমিকা পালন করতেন।
সত্যি বলতে, সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের খুব বেশি সম্মান প্রদর্শন করেন না দলীয় নেতারাও। এর প্রধান কারণ স্থানীয় রাজনীতিতে তাদের তেমন কোনো অবস্থান না থাকা।
অভিজ্ঞতার কথা বলি। পেশাগত কারণেই সরকার পতনের আগ পর্যন্ত সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। ২০১৩ সালে প্রথমবারের মতো স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার সময় আওয়ামী লীগের মধ্যেই বড় সমালোচনা ছিল– জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত না হয়ে নির্বাচিত সংসদের স্পিকার হন কীভাবে! তবে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি কখনও এ ব্যাপারে আপত্তিকর কিছু বলেনি। বলতে গেলে সহযোগিতা করেছে।
২০১৪ সালে দশম সংসদে তিনি সংরক্ষিত আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য হলে আবার স্পিকার নির্বাচিত হন। কিন্তু ২০১৮ সালে রংপুরের পীরগঞ্জ আসন থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর পুনরায় স্পিকার নির্বাচিত হলে তাঁর মধ্যে আমি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করি। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি কিন্তু সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নই। আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত!’ তিনি বেশ কর্তৃত্বশীলভাবেই কথাটি বলতেন।
সন্দেহ নেই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির কর্তৃত্ব ও বৈধতা অনেক বেশি। কিন্তু রাজনীতির একটি বড় দ্বান্দ্বিকতা হলো, তাত্ত্বিক যুক্তি ও আবেগের মাধ্যমে রাজনীতির সীমারেখা নির্ধারণ করা যায় না। বাস্তবতার আলোকে তত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত করে রাজনীতি পরিচালনা করতে হয়।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের লেখা ‘পলিটিক্যাল পার্টিজ ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ের শুরুতেই বলা হয়েছে, সাপ যেভাবে এঁকেবেঁকে চলে, রাজনৈতিক দল পরিচালনা করতে হলে তার চাইতেও বেশি জটিলভাবে চলতে হয়।
এখন সংবিধান সংস্কার কমিশন অথবা নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নির্ধারণ করে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের ব্যবস্থায় রাজনীতির সেই জটিল ক্ষেত্রে নতুন সমস্যা দেখা দিতে পারে।
প্রথমত, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় দু’জন নির্বাচিত এমপি থাকবেন। একটি নির্বাচনী আসনে একই পদের ও মর্যাদার দু’জন জনপ্রতিনিধি থাকতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে চলে আসবে দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব এবং দ্বৈত শাসন, যা বাস্তবিক ও তাত্ত্বিক দু’ভাবেই বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
দ্বিতীয়ত, দুই এমপি এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে তৃণমূলে শুরু হবে মারামারি, সংঘাত, খুনোখুনি। সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি বলবেন, ‘আমি তো সবার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জিতেছি; আমার অবস্থান ওপরে। আমার কথাই সব।’ অন্যদিকে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে নির্বাচিত এমপি বলবেন, ‘আমিও জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। আমিও কম কীসে?
কারণ সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, ১০০ আসন চালু হলে একটি সাধারণ আসনে গড় ভোটার সংখ্যা পাঁচ লাখ হলে সংরক্ষিত নারী আসনে হবে ১৫ লাখ। এই ১৫ লাখ ভোটারের জন্য তাঁকে অনেক বেশি টাকা খরচ করতে হবে, সময় দিতে হবে ও পরিশ্রম করতে হবে। এবং এই বিধান নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক হবে না!
দুই এমপির টানাপোড়েনে দোটানায় পড়ে যাবে প্রশাসনসহ সরকারি দপ্তরগুলো। দেখা যাবে, কোন এমপি তোয়ালে-ঢাকা চেয়ারে বসলেন আর কোন এমপি বসলেন না; কে ডানে বসলেন, কে বামে; কার নাম আগে বলা হলো এবং কার নাম পরে; কে আগে বক্তৃতা দিলেন আর কে পরে– এই নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে শুরু হবে মারামারি। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংসদ সদস্যরা কেমন আচরণ করেন, এর একটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করি। দশম সংসদের ঘটনা।
আমি স্পিকার শিরীন শারমিনের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে কথা বলছিলাম। এর মধ্যেই মেহেরপুর সদর আসনের এমপি ফরহাদ হোসেন প্রবেশ করে আমার পাশেই বসলেন। তিনি মেহেরপুরের রাজনীতি নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে বললেন, ‘আপা, আমি ডিসি চেঞ্জ করে দিলাম। বেয়াদব কোথাকার!’
তাঁর এ মন্তব্য শুনে স্পিকার আপা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, কী হয়েছে? কী বেয়াদবি করেছে ডিসি?’ জবাবে ফরহাদ হোসেন বললেন, ‘কত বড় বেয়াদব! স্টেজে আমি প্রধান অতিথি। আমার চেয়ারে তোয়ালে নাই। আর তাঁর চেয়ারে তোয়ালে!’
ফরহাদ হোসেনের জবাব শুনে তিনি অনেকটা বিরক্ত হয়ে তাঁর কথার জবাব না দিয়ে আর্দালি জামালকে বললেন, ‘স্যারকে কফি দাও’ এবং তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন।
সংরক্ষিত নারী আসন নিয়ে আরেকটি বড় সমস্যা হবে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম, দরপত্র, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি ও কোম্পানি নিয়োগ এবং বিভিন্ন বরাদ্দ ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে। দুই এমপিই চাইবেন নির্বাচনী এলাকার যেখানে তাঁর ভোট অথবা সমর্থন বেশি, সেখানে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। সেখানকার মানুষকে বেশি চাকরি দিতে।
সরকারি-বেসরকারি কোনো নিয়োগ হলে দুই এমপি আলাদা তালিকা নিয়ে হাজির হবেন। এক এমপি বলবেন, ‘আমার ওই ইউনিয়নে রাস্তা বানাতে হবে, ভবন বানাতে হবে, মেরামত করতে হবে।’ আরেক এমপি বলবেন, ‘ওখানে হবে না। আমার ইউনিয়নে হবে।’ কারণ, এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমেই স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
স্থানীয় পুকুর, খাল, জলাশয় লিজ নিয়ে বেধে যাবে দুই এমপির গ্রুপের মধ্যে মারামারি, হানাহানি। এ ছাড়াও স্থানীয় পুলিশ পড়ে যাবে বিপদে। এক এমপি বলবেন, ‘ওকে ধরো, ওকে ছাড়ো।’ আরেক এমপি বলবেন, ‘ধরতে পারবে না, ছাড়তে পারবে না।’
স্থানীয় পর্যায়ের সামান্য এই সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়িই বাস্তবতা।
এসব হালুয়া-রুটির ভাগাভাগির জন্যই এমপিদের হয়ে রাজনৈতিক কর্মীরা খুনোখুনি করে, মোটরসাইকেল মহড়া দেয়, মিছিল-সমাবেশ করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অপরের চরিত্র হনন এবং অপতথ্য প্রচারে জীবন বিনিয়োগ করে। এটিই এদের পেশা। এসব রাজনৈতিক নেতাকর্মী বছরের পর বছর নেতা-নেত্রীর প্রতি আনুগত্য দেখায়।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য এমপিদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে হবে। কিন্তু সেটি সম্ভব কিনা, সে ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে।
আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় বলে, এমপিদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ বাংলাদেশের জনগণ এমপিদের আইনপ্রণেতা হিসেবে দেখে না। তারা এমপিদের দেখে ‘এজেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট’ অর্থাৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রতিনিধি হিসেবে। অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কিছু দুর্বৃত্তের হাতে চলে যাওয়ার কারণেই হয়তো মানুষ এমপিদের উন্নয়ন কাজে দেখতে চায়।
একজন এমপি আইনপ্রণেতা হিসেবে সংসদে যতই সক্রিয় থাকুন, তিনি যদি রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি অথবা মেরামত না করতে পারেন তাহলে জনগণ তাঁকে ভোট দেয় না।
আবার স্থানীয় পর্যায়ে কাজ না করলে অনেক সময় দলও তাঁকে পরে মনোনয়ন দেয় না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নীলফামারীর এমপি কর্নেল (অব.) মারুফ সাকলান ও নড়াইলের এস কে আবু বাকেরের কথা। নবম সংসদে এই দুই আওয়ামী লীগদলীয় এমপি সবচেয়ে বেশি হাজির থেকেছেন। সংসদীয় কাজে তাদের অংশগ্রহণ দেখা যেত। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে ওই দু’জন মনোনয়নই পাননি।
শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া আসনের এমপি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কর্নেল (অব.) শওকত আলী সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি সংসদীয় কাজে অনেক সিরিয়াস ছিলেন। কিন্তু তাঁর এলাকার মানুষদের জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘তিনি লোক ভালো, কিন্তু কোনো কাজ করেননি। তিনি ভোট পাবেন না।’
তাহলে কি নারীরা সংসদ সদস্য হবেন না? অবশ্যই হবেন। তবে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য নারীদের রাজনীতিতে আসার সুযোগ করে দিতে হবে। তৃণমূলে নারীদের রাজনীতিতে প্রবেশ সীমিত
করে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদে নির্বাচিত করে আনলে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
রাজনীতিতে নারীদের সুযোগ নিশ্চিতকরণ বিষয়ে আলোচনার আগে জানতে হবে নারীরা কেন রাজনীতিতে আসতে চান না।
প্রথম সমস্যা হলো রাজনীতির নামে স্থানীয় পর্যায়ে গুন্ডামি, সহিংসতা ও বিভিন্ন ধরনের নোংরামি। নারীর শারীরিক ও সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও অসম্মানের আশঙ্কা।
কোনো নারী রাজনীতি করতে আগ্রহী হলে প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকেই। তারা মনে করেন, মেয়ে রাজনীতি করলে সমাজের মানুষ ভালোভাবে নেবে না। বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় যেতে হবে এবং সেখানে তাঁর মেয়ের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এমন হলে সেই মেয়ের ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসবে না।
স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতির আরেকটি বাস্তবতা হলো, পুরুষরা যতটুকু পেশিশক্তি দেখাতে পারেন, নারীরা সেটি পারেন না। এ ছাড়া কোনো নারী রাজনীতিতে এগিয়ে গেলে তাঁকে বিভিন্ন বিশেষণ দিয়ে নারীবিদ্বেষ ছড়ানো হয়। সমাজে খুব মুখরোচকভাবে বিভিন্ন বিষয় প্রচার করা হয়। বর্তমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অপতথ্য প্রচারের যুগে নারীরা আরও বেশি করে বিদ্বেষের শিকার হবেন।
তাই বলে তো বসে থাকা যাবে না। নারীদের রাজনীতিতে আনতে হবে। সুযোগ করে দিতে হবে। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বের উদার দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনীতিতে সহিংসতা ও গুন্ডামির সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দরকার মতৈক্য। আর এটি শুরু করা যেতে পারে কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে। সরকারিভাবে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অর্ধেক সংখ্যক ছাত্র এবং অর্ধেক সংখ্যক ছাত্রী প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এ ছাড়া ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে মেয়েদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব নির্ধারণ করতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কর্মীদের ভোটের মাধ্যমে। এভাবে তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব উঠে আসবে। এই প্রক্রিয়ায় কয়েক বছরের মধ্যেই তারা জেলা পর্যায়ে এবং কেন্দ্রীয়ভাবেই রাজনীতিতে চলে আসবেন।
নারীদের অর্থবহ ক্ষমতায়নে সংসদে সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা করে সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। নারীর ক্ষমতায়ন প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে স্থানীয় পর্যায় থেকে; ওপর থেকে নিচের দিকে নয়। মূলধারার রাজনীতিতে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি না করে শুধু সংসদে সংরক্ষিত আসন নিশ্চিত করে তেমন লাভ হবে না।
কামরান জেরা চৌধুরী: সাংবাদিক