দিনাজপুরে শিশু ধর্ষণে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিন স্থগিত, আসামি এলাকা ছাড়ার খবর
Published: 23rd, March 2025 GMT
দিনাজপুরের সেই ৫ বছরের শিশু ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির জামিনে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। গত ৫ মার্চের ওই আদেশে আসামি সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। এদিকে জামিন স্থগিতের খবর পেয়ে আসামি এলাকা ছেড়েছেন বলে ভুক্তভোগী শিশুটির পরিবার জানিয়েছে।
৮ বছর ৪ মাস কারাদণ্ড ভোগের পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জামিনে মুক্ত হন আসামি সাইফুল ইসলাম। এ নিয়ে নারী ও শিশু অধিকার কর্মীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মাগুরার শিশুটিকে নিয়ে দেশজুড়ে ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ–সমাবেশের মধ্যে বার বার উচ্চারিত হয়েছিল দিনাজপুরের শিশুটির কথা।
সাড়ে ৮ বছর আগে জনন অঙ্গ কেটে দিনাজপুরের সেই শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়। এর ফলে শিশুটির মূত্রথলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একাধিকবার অস্ত্রোপচার করা হলেও এখনো প্রস্রাব ঝরে তার। শিশুটির বয়স এখন ১৩ বছর।
শিশুটির বাবা গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘বিচার তো পাইছিলাম, তাইলে এমন হইল ক্যানে? যাবজ্জীবনের আসামি ছাড়া পাইল ক্যানে? সাড়ে ৮ বছর না যাইতেই ছাড়া পাইল।’ আজ সোমবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি জামিন না পাইতো, তাহলে তো পালাইতে পারতো না।’
২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর এক প্রতিবেশীর একই বয়সী মেয়ের সঙ্গে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় শিশুটি। পরদিন শিশুটিকে তার বাড়ির কাছে অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়। শিশুটির প্রজনন অঙ্গ, মাথা, গলা, হাত ও পায়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। ঊরুতে সিগারেটের ছ্যাঁকার ক্ষত ছিল। শিশুটির বাবা ওই বছর ২০ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। ঘটনার পরপরই প্রতিবেশী সাইফুল ইসলামকে আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি আলোচিত হয়। বিচারে সাইফুল ইসলামের অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত।
ঘটনার ৮ বছর ৪ মাস পর ১৯ ফেব্রুয়ারি দিনাজপুর জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন সাইফুল ইসলাম। দিনাজপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা এক আবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট সাইফুল ইসলামের জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন।
জানা গেছে, আসামির জামিন হয়ে যাওয়ার প্রতিবাদ ও ক্ষোভের মুখে রাষ্ট্রপক্ষ বাদী হয়ে আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে জামিন বাতিলের আবেদন করে। শুনানি নিয়ে চেম্বার আদালত গত ৫ মার্চ আদেশ দেন। তাতে হাইকোর্ট থেকে দেওয়া আসামি সাইফুল ইসলামের জামিন আদেশের ওপর আট সপ্তাহের স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।
শিশুটির বাবা আজ প্রথম আলোকে বলেন, গত ১৫ দিন ধরে সাইফুল ইসলাম এলাকায় নেই। জামিন বাতিলের খবর পেয়ে সাইফুল ইসলাম পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করছেন তিনি।
এ বিষয়ে পাবর্তীপুর থানায় যোগাযোগ করলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.
বেসরকারি সংগঠন ‘আমরাই পারি’র প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক প্রথম আলোকে বলেন, জামিন বাতিলের পর আসামি ধরা কঠিন। অনেক ঘটনায় দেখা গেছে, এ ধরনের আসামিরা অন্য পরিচয়ে আবার অপরাধ করছে। ক্ষোভের মুখে রাষ্ট্রপক্ষ জামিন বাতিলের উদ্যোগ নিয়েছে। এখন পুলিশ প্রশাসনকে আসামি ধরতে অনেক তৎপর হতে হবে। থানায় থানায় আসামির ছবি টাঙিয়ে দেওয়া উচিত।
জিনাত আরা হক বলেন, ধর্ষণের শিকার শিশুটির ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য ‘আমরাই পারি’সহ ছয়টি সংগঠন ২০১৬ সাল থেকে কাজ করছিল। অনেক দিন ছোটাছুটি করে মামলার রায় পাওয়া গিয়েছিল। এ ধরনের ঘটনায় জামিন হওয়া কখনো উচিত নয়। এতে করে ভুক্তভোগী ও তার পরিবার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রথম আল ক ৮ বছর
এছাড়াও পড়ুন:
‘রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই’
ময়মনসিংহ সদর উপজেলার চর আনন্দিপুর গ্রামের মামুন মিয়া (২২) ছোটবেলা থেকে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। প্রায় প্রতি মাসেই তাঁর একাধিক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এক সময় রক্তের জোগাড় বেশ কষ্টসাধ্যই হয়ে ওঠে। মানুষ বিনা স্বার্থে রক্ত দিতে চাইতেন না। ২০১৬ সাল থেকে পরিবারটিকে রক্তের জন্য আর কাউকে অনুরোধ করতে হচ্ছে না। মামুনের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
সম্প্রতি মামুনের মা মাজেদা বেগম অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘পোলার রক্তের লাইগ্গা মাইনষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কেউ রক্ত দিতে চাইতো না। মানুষ টাকা ভিক্ষা চায়, আর আমি মানুষের কাছে আমার পোলার জন্য রক্ত ভিক্ষা করছি। শইল্যে রক্ত না ভরলে আমার পোলা মইরা যাইতো।’
দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত ব্যক্তি, জরুরি বা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার, ক্যানসার, থ্যালাসেমিয়া কিংবা কিডনি আক্রান্ত রোগীর জন্য প্রায়ই প্রয়োজন হয় রক্তের। আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা কারও কাছে প্রয়োজনমাফিক রক্ত না পেয়ে অনেকেই ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের কাছে। খবর পেয়ে স্বেচ্ছাসেবীরা দ্রুততার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রক্তদাতাকে খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর মানুষের জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ এই কাজেই তাঁদের আনন্দ বলে জানান ময়মনসিংহের ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মী।
শুধু রক্তদান নয়, সমাজ পরিবর্তনে নানা কাজও করে চলেছে তরুণদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। ২০১৮ সালের ১৯ আগস্ট এটি সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন পায়। তবে এর দু-এক বছর আগেই সংগঠনটির কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানান সংগঠনটির মূল পরিকল্পনাকারী মমিনুর রহমান। তাঁর বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মাইজবাগ এলাকায়।
সম্প্রতি মমিনুর রহমান বলেন, ‘শুধু রক্তের অভাবে একটি মানুষের জীবন বিপন্ন হতে পারে না, এই চিন্তা থেকে কাজ শুরু করি। ময়মনসিংহে রক্তদান নিয়ে কাজ করে—এমন কোনো সংগঠন ছিল না। তখন স্থানীয়ভাবে মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাম্পেইন করে ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর ৩৯ জনকে নিয়ে প্রথম সভা করি। পরে সেখান থেকে রক্তদানের এই সংগঠন করার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। যেহেতু ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বসে ওই সভা হয়েছিল, তাই সংগঠনটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটি’। ‘আর্তের মুখে হাসি ফোটানোই হয় যদি মানবতা, তবে তার শ্রেষ্ঠ সেবক হলো প্রতিটি রক্তদাতা’, এই স্লোগান সামনে রেখে শুরু হয় এর যাত্রা।
সংগঠনটি থেকে জানানো হয়েছে, রক্তদাতা তরুণেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনটির একটি কমিটি ও ফেসবুক পেজ আছে। এর মাধ্যমে কিংবা মুঠোফোনে খবর পেয়েই রক্ত দিতে ছুটে যান তরুণেরা। তরুণদের তৎপরতায় দিন দিন সংগঠনটির পরিসর বাড়ছে। বর্তমানে এই সংগঠনের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য আছেন, যাঁরা নিজেরা রক্তদান করেন এবং রক্তদানে অন্য তরুণদের উৎসাহিত করেন। ২০ বারের বেশি রক্ত দিয়েছেন, এমন রক্তদাতা আছেন ৮০ জন, যার ৬০ জনই শিক্ষার্থী। শুধু ময়মনসিংহ শহরেই ইতিমধ্যে ৩৫ হাজার ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন সংগঠনটির তরুণেরা। এর মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস ২০১৮ সাল থেকে ব্রহ্মপুত্র ব্লাড কল্যাণ সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। এ পর্যন্ত তিনি ২৬ বার রক্ত দিয়েছেন। অন্যদের উৎসাহী করতে তিনি বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় মানুষ রক্তের কারণে মারা যাবে, এটি কখনো হতে পারে না। তাই অসুস্থ জটিল রোগীর খবর পেলেই রক্ত দিতে যাই। রক্ত দিয়ে যে আনন্দ পাওয়া যায়, তা আর অন্য কিছুতেই নেই।’
সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি আবিদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক সুমন রাহাত। স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আবিদুর রহমান বলেন, ‘যাঁদের রক্তের প্রয়োজন, তাঁরা আমাদের ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করেন। অথবা রক্তের প্রয়োজন ফেসবুকে কারও স্ট্যাটাস দেখলেই আমরা নিজে থেকে যোগাযোগ করে রক্তের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। আমরা রক্তদানের মাধ্যমে অন্যের জীবন বাঁচিয়ে আনন্দিত হই। আমরা মানুষ বাঁচানোর এই আনন্দ সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে, পাড়ায় মহল্লায় রক্তের জন্য মানুষ যেন না মরে, এটিই আমাদের লক্ষ্য।’