গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ সম্ভবত সবচেয়ে জটিল ও কঠিন সময় পার করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার বা সেনাবাহিনী নিয়ে প্রচারিত ও প্রকাশিত নানা মন্তব্য ও মতামত দেশে অস্থিরতার পরিবেশ তৈরি করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান মতপ্রকাশের বন্ধ দরজার অর্গল ভেঙে দিয়েছে। বর্তমান মুক্ত পরিবেশে সত্য, অসত্য, উদ্দেশ্যমূলক বা বিভ্রান্তিকর—     কোনো মত বা তথ্যের প্রকাশ ঠেকানোর সুযোগ নেই। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা নানা মত-পথের ব্লগার ও ইউটিউবাররা নাহয় এর সুযোগ নিলেন কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা পক্ষও যদি উত্তেজনা তৈরি ও বিভ্রান্তি ছড়াতে ভূমিকা রাখে, তবে তা বিশেষ উদ্বেগের বিষয়।

দেশ এখন যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা তৈরির পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে নতুন গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর একটি ফেসবুক মন্তব্য। তিনি দাবি করেছেন, ১১ মার্চ সেনানিবাসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ‘রিফাইন্ড’ অংশকে রাজনীতিতে পুনর্বাসনের জন্য তাঁদেরকে চাপ দেওয়া হয়েছে এবং তা পুরোপুরি ভারতের পরিকল্পনা। আসন সমঝোতার বিনিময়ে তাঁদেরকে এই প্রস্তাব মেনে নিতে বলা হয়।

ঘটনার ১০ দিন পর ২১ মার্চ তিনি এই ফেসবুক পোস্ট দেন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার একটি বক্তব্য প্রকাশিত হওয়ার পর। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে ড.

ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পরিকল্পনা সরকারের নেই। হাসনাত তাঁর পোস্টে বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে কোনো ধরনের আপস করার সুযোগ নেই। সঙ্গে যুক্ত করেছেন, ‘জুলাইয়ের দিনগুলোতে জনগণের স্রোতে ক্যান্টনমেন্ট আর এজেন্সির সকল প্রেসক্রিপশন আমরা উড়িয়ে দিয়েছিলাম। আজ আবারও যদি আপনাদের সমর্থন পাই, রাজপথে আপনাদের পাশে পাই, তবে আবারও এই আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনের ভারতীয় ষড়যন্ত্রও আমরা উড়িয়ে দিতে পারব।’

এ ধরনের মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে ও জনমনে হওয়ার কথা, তা-ই হয়েছে। হাসানাতের দল এনসিপি দ্রুততার সঙ্গে তাঁর পক্ষ নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনেও করেছে। সেখানে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের নিন্দা করা হয়। লিখিত বক্তব্যে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মন্তব্য করেছেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। আমরা তাঁর এ বক্তব্যের নিন্দা জানাই।’

প্রায় একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্রদের প্রতিনিধি উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার আগে রেকর্ড করা ভিডিওর একটি অংশও ফেসবুকে শেয়ার করেন হাসনাত আবদুল্লাহ। সেখানে আসিফ মাহমুদ এটা স্পষ্ট করেন যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার ব্যাপারে সেনাপ্রধানের আপত্তি ছিল।

হাসনাতের বক্তব্য নিয়ে সেনাবাহিনীর বক্তব্য কী—তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল ছিল। সুইডেনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নেত্র নিউজ জানতে চাইলে সেনা সদর এক বিবৃতিতে হাসনাতের দাবিকে ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ব গল্পের সম্ভার’ হিসেবে বর্ণনা করে। তারা সেনানিবাসে ১১ মার্চের বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে। হাসনাত আবদুল্লাহ না বললেও সেনা সদর বলেছে, সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেই ১১ মার্চ বৈঠকটি হয়েছিল। তবে হাসনাত আবদুল্লাহকে ‘ডেকে নিয়ে যাওয়া’ এবং ‘আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন’ বিষয়ে তাঁদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, হাসনাত আবদুল্লাহ ও তাঁর দলের আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল।

ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। এরপর সেই বৈঠকে উপস্থিত সারজিস আলমের কাছ থেকে যে ভাষ্য পাওয়া গেছে, হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য বা অবস্থানের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তার মিল নেই। হাসনাতের ফেসবুক মন্তব্য নিয়ে সারজিস বলেছেন, ‘যেভাবে এই কথাগুলো ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এসেছে, এই প্রক্রিয়াটি আমার সমীচীন মনে হয়নি বরং এর ফলে পরবর্তীতে যেকোনো স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আস্থার সংকটে পড়তে পারে।’

কোনো বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান আইনকানুন, নিয়ম বা সংবিধান মেনে হয় না। বাংলাদেশের ৫ আগস্টের পরিবর্তনও তাই। বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের পরের ঘটনাপ্রবাহও নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম মেনে চলে না। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে ছাত্রদের নেতৃত্বে নানা মত ও পথের রাজনৈতিক শক্তির অংশগ্রহণে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানা আলোচনা ও তৎপরতার মধ্য দিয়েই একটি সমঝোতায় আসতে হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় নানা মত এসেছে, বিরোধিতা এসেছে। বাস্তবতা বিবেচনায় কোনো পক্ষ ছাড় দিয়েছে, কেউ নমনীয় হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত সাড়ে সাত মাস ভালোভাবে দেশ পরিচালনা করতে পেরেছে এমন বলা যাচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে অদক্ষতা, সিদ্ধান্তহীনতা বা কিছু বিষয়ে জোরালো অবস্থান গ্রহণে ব্যর্থতার দিকই স্পষ্ট হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি নতুন কিছু নয়। গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকেই এই দাবি বিভিন্ন পক্ষ থেকে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এই ইস্যুতে হঠাৎ কেন মাঠ গরম হয়ে উঠল? নাকি গরম করা হলো? অন্তর্বর্তী সরকার গঠনপ্রক্রিয়ায় কে কাকে পছন্দ বা অপছন্দ করেছেন, সেই পুরোনো প্রসঙ্গই-বা কেন সামনে আনা হলো? অথবা ছাত্রদের নতুন দলটি বা তাদের দলের কেউ কেন সেনাপ্রধানকে প্রতিপক্ষ বানাতে চাইল? কোনো পক্ষ কি পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটাচ্ছে? এতে আসলে কার লাভ?

রোববার হয়ে উঠেছিল গুজবের রাত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রাতভর এর চর্চা হয়েছে। গতকাল সকালে সেনা সদরে সেনাবাহিনী প্রধানের ‘অফিসার্স অ্যাড্রেস’ নিয়েও শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। সেনা সূত্র একে রুটিন বৈঠক বললেও সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই যে সেনাপ্রধানকে এই বৈঠকটি করতে হয়েছে, সেটা পরিষ্কার।

আগেই বলেছি, নেতৃত্বে ছাত্ররা থাকলেও গণ-অভ্যুত্থানের অনেক পক্ষ ছিল। সেই পক্ষগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে ৮ আগস্ট। মাঝের তিন দিন দেশে কোন সরকার কাজ করেছে? এ সময় কাদের ওপর ভরসা ছিল জনগণের? দেশের সেই সংকটময় সময়ে ছাত্রনেতৃত্ব, রাজনৈতিক শক্তি ও সেনাবাহিনী নানা তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে মিলেমিশে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানকে তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হয়েছে। সেই পর্বে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে নানা মতপার্থক্য স্বাভাবিক। এসব আলোচনায় অনেক সংবেদনশীল বিষয় থাকে, যা প্রকাশ করা যায় না। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া তো এই বিষয়গুলোকে এখন সামনে আনার কথা নয়।

ছাত্ররা নতুন দল করেছেন, আবার তাঁদের প্রতিনিধিরা এখনো সরকারে আছেন। মানে তাঁরা সরকারে আছেন, আবার সরকারের বাইরেও আছেন। যাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের বাইরে, তাঁরা না হয় সরকারের সমালোচনা করতে পারেন। তাঁদের দল এনসিপি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের অবস্থানের নিন্দাও করতে পারে (যদিও অনেকে মনে করেন, ‘কিংস পার্টির’ বদনাম ঘোচাতেই তারা এই কৌশল নিয়েছে)। কিন্তু যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁরাও তো কোনো সীমা মানছেন বলে মনে হয় না।

ফেসবুকে হাসনাত ও সারজিসের বক্তব্য নিয়ে তাঁদের দল এনসিপিতে অস্বস্তি ও অসন্তোষের কথা আমরা সংবাদমাধ্যম সূত্রে জেনেছি। দলটির মুখ্য সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এরই মধ্যে হাসনাতের পোস্টটিকে ‘শিষ্টাচারবর্জিত’ বলে মন্তব্য করেছেন। অন্য এক সমাবেশে তিনি কোনো ক্ষেত্রে ভুল হয়ে থাকলে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা দল গঠন করেছেন, এটা আশাব্যঞ্জক ঘটনা। কিন্তু তাঁরা সম্ভবত এটা বুঝে উঠতে পারেননি যে আন্দোলন আর রাজনৈতিক দল গঠন করে দল পরিচালনা ভিন্ন বিষয়। হাসনাত ও সারজিস ছাত্রদের দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, দলের অবস্থান বা সিদ্ধান্তের বাইরে সেনানিবাসে গিয়ে বৈঠক করা বা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার দায় তাই দলকেই নিতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক মন্তব্য ও এর পরের ঘটনাপ্রবাহকে আমরা কীভাবে দেখব? এটা কি নিছক রাজনৈতিক অপরিপক্বতা? হাসনাত আবদুল্লাহর ফেসবুক মন্তব্য এবং একই সঙ্গে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের আগের রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপ প্রকাশকে পরিকল্পিত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কোনো শক্তি বা গোষ্ঠী পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে কি না, সেই প্রশ্ন কিন্তু জনমনে আছে। নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির উচিত তাদের অবস্থান বিশ্বাসযোগ্যভাবে পরিষ্কার করা।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ষ দ ধ কর র জন ত ক অবস থ ন উপদ ষ ট সরক র র দ র দল ন র পর কর ছ ন এনস প র একট আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

শ্রমিক অধিকার, আন্দোলন ও শ্রম সংস্কারের প্রস্তাবনার বাস্তবতা

মে দিবস শুধু একটি তারিখ নয়, এটি শ্রমজীবী মানুষের শতবর্ষব্যাপী সংগ্রাম, আত্মত্যাগ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক। ১৮৮৬ সালে শিকাগো শহরে শ্রমঘণ্টা নির্ধারণের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল দিনটি। আজ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দিনটি পালিত হয় শ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশেও মে দিবস পালিত হয় আনুষ্ঠানিকতা ও প্রতীকী উদ্‌যাপনের ভেতর দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দেশের শ্রমিকশ্রেণির জীবনমান, অধিকার ও কর্মপরিবেশ এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। এই প্রবন্ধে মে দিবসের তাৎপর্য, বাংলাদেশের শ্রমিকদের বর্তমান অবস্থান, শ্রমিক আন্দোলনের ধারা ও শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণি: পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৃহৎ অবদান রাখা সত্ত্বেও শ্রমিকেরা চূড়ান্ত পর্যায়ের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। দেশের প্রায় ছয় কোটি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে একটি বড় অংশ পোশাক কারখানা, নির্মাণ, পরিবহন, কৃষি ও সেবা খাতে যুক্ত। অনেকেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, যেখানে নেই কোনো সুনির্দিষ্ট চাকরির নিরাপত্তা, নেই শ্রমিককল্যাণ সুবিধা এবং নেই সংগঠনের অধিকার।

বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এখান থেকে। কিন্তু এ খাতের শ্রমিকদের অধিকাংশই পান না যথোপযুক্ত মজুরি। নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, যেমন রানা প্লাজা ধস কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন।

শ্রমিকসংগঠন ও আন্দোলনের ধারা

বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্য রয়েছে। পাকিস্তান আমলে শ্রমিকেরা বিভিন্ন আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরি বৃদ্ধির দাবি আদায় করেছিলেন। স্বাধীনতা–পরবর্তীকালে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব, সুবিধাবাদী নেতৃত্ব ও বিভক্তি শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দুর্বল করে দেয়।

বর্তমানে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে দুটি চিত্র স্পষ্ট—একদিকে কিছু আন্তরিক ও ত্যাগী শ্রমিকনেতা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে লড়ছেন; অন্যদিকে কিছু নেতার ব্যক্তিস্বার্থ ও রাজনৈতিক যোগসূত্র আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এ কারণে শ্রমিকদের প্রকৃত স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই শ্রমিকেরা আস্থা হারাচ্ছেন সংগঠনের প্রতি।

সরকার ও শ্রমিকনীতি

বাংলাদেশ সরকার শ্রমনীতি প্রণয়নের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নের অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তা অনেক সময়েই কার্যকর হয় না। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার, মজুরি নিয়ে দর-কষাকষি করার অধিকার থাকলেও বহু ক্ষেত্রে এই অধিকার চর্চা করতে গিয়ে শ্রমিকেরা হয়রানির শিকার হন।

অনেক মালিক প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনকে ভয় পান। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সংগঠনের চেষ্টা দমন করতে তাঁদের ছাঁটাই করা হয়, ভয়ভীতি দেখানো হয়; এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়রানি, হামলা বা মামলা দেওয়া হয়। আর তাই শ্রমিকেরা সংগঠিত হওয়ার আগে দশবার ভাবেন।

শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব: আশার আলো নাকি প্রতীকী পদক্ষেপ?

সম্প্রতি গঠিত শ্রম সংস্কার কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা দিয়েছে, যা বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকদের জীবনমানে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। কমিশনের প্রস্তাবনার মধ্যে রয়েছে–

১. তিন বছর পরপর জাতীয় মজুরি নির্ধারণ করা, ২. বার্ষিক মূল্যস্ফীতির ভিত্তিতে মজুরি সমন্বয়, ৩. সময়মতো বেতন না দিলে ক্ষতিপূরণ, ৪. শ্রমিকদের জন্য আপৎকালীন তহবিল গঠন, ৫. ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের শর্ত শিথিল, ৬. আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ বন্ধ, ৭. মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাসে উন্নীত করা, ৮. শ্রম আদালতকে আধুনিকায়ন ও সংস্কার ও ৯. শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা বাড়ানো।

এই প্রস্তাবগুলো অনেকাংশেই সময়োপযোগী ও শ্রমিকবান্ধব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এ প্রস্তাব বাস্তবায়নে সরকার কতটা আন্তরিক? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নীতিগত সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই মাঠপর্যায়ে এসে বাস্তবায়িত হয় না। আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দুর্বল থাকে। আবার মালিকদের সংগঠন যেকোনো সংস্কারমূলক পদক্ষেপকে ব্যাহত করতে সক্রিয় থাকে।

শ্রম সংস্কারের চ্যালেঞ্জ

প্রথমত, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত না হলে কোনো সংস্কারই বাস্তব ফল দেবে না। দ্বিতীয়ত, শ্রম আদালতের ধীরগতি, মামলার জট ও রায় কার্যকর না হওয়া শ্রমিকদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে। তৃতীয়ত, শ্রম আইন প্রয়োগে যাঁরা দায়িত্বে আছেন, যেমন শ্রম পরিদর্শক বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ— তাঁদের প্রশিক্ষণ, জনবল ও নিরপেক্ষতা অনেক সময়েই প্রশ্নবিদ্ধ।

এ ছাড়া নারী কর্মীদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ, মাতৃত্বকালীন ছুটি, যৌন হয়রানিবিরোধী কার্যকর ব্যবস্থা এখনো অনেক প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত। ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বেও নারীর অংশগ্রহণ খুবই সীমিত, যা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।

আশাবাদ ও করণীয়

তবু শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো যদি আন্তরিকতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হতে পারে। এ জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং মালিক-শ্রমিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ ও কার্যকর কাঠামো গঠন।

সরকারকে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, যেন কোনো শ্রমিককে সংগঠন গঠনের জন্য হেনস্তার শিকার না হতে হয়। ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে প্রয়োজন আত্মসমালোচনা ও গণতান্ত্রিক সংস্কার। নেতৃত্বে প্রগতিশীল, শ্রমিকবান্ধব ও দূরদর্শী ব্যক্তিদের আনতে হবে। শ্রমিকদের সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও অধিকারবিষয়ক প্রচার চালাতে হবে।

সর্বোপরি, মালিক শ্রেণিকে বোঝাতে হবে যে শ্রমিকদের কল্যাণ শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্তও বটে। একটি কর্মিবান্ধব পরিবেশ কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যা শেষ পর্যন্ত মালিকেরও লাভ।

উপসংহার

মে দিবসের চেতনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে শ্রমিকের অধিকার কোনো দয়া নয়, এটি তাঁর প্রাপ্য। এই চেতনাকে ধারণ করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। কেবল মে দিবসে ব্যানার, শোভাযাত্রা বা আনুষ্ঠানিকতা নয়, শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সংগঠনের অধিকার ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করাই হোক আমাদের মূল অঙ্গীকার।

শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যদি শ্রমিকদের উন্নত জীবনের ভিত্তি তৈরি করতে পারি, তবেই মে দিবস হবে অর্থবহ; আর বাংলাদেশ একটি মানবিক, ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

সাহিদা পারভীন শিখা সাধারণ সম্পাদক জাতীয় নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র

সম্পর্কিত নিবন্ধ