দেশের বর্তমান সংকট উত্তরণে বিকল্প ধারায় নয়া যুক্তফ্রন্ট গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশ গড়ার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সমকালের সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেছেন, এবার আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করছি বিভিন্ন শক্তির ঘাত-প্রতিঘাত ও তার ফলে
সৃষ্ট অনিশ্চয়তা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদির পটভূমিতে। তাঁর স্পষ্ট কথা, মুক্তিযুদ্ধকে কবর দেওয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিচে পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন : আপনি কি মনে করেন, ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ’৪৭ এবং ’৭১ উভয়কেই ধারণ করে?
উত্তর : ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হলো জাতির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এ কথা বুঝতে হবে যে, মুক্তিযুদ্ধ কেবল ৯ মাসের মিলিটারি অপারেশন ছিল না। এটি ছিল দশকের পর দশক ধরে উচ্চারিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারায় পরিচালিত গণসংগ্রামের নির্যাস। ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধের পর্বটি ছিল এই সংগ্রামের শীর্ষ অধ্যায়। চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছার জন্য আমাদের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছিল। ’৪৭-এ প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের ভাবধারা ও প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রক্ত দিয়ে লড়তে হয়েছিল। আর ’৪৭-কে কবর দিয়েই রচিত হয়েছিল ’৭১। সুতরাং আজকাল কেউ কেউ বলছে, ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ’৪৭ এবং ’৭১ উভয়কেই ধারণ করে। তারা হয় রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞ কিংবা তাদের দুরভিসন্ধি আছে। কারণ, ’৪৭ আর ’৭১ পরস্পরবিরোধী হওয়ায় এ দুটো একসঙ্গে ধারণ করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়ন অধরা থাকল কেন?
উত্তর : ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর অনেক স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীন দেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। এ জন্য দায়ী মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত অপশক্তি। সেই সঙ্গে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে লুটপাট চালিয়েছে– সামরিক শাসন, স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিস্ট দুঃশাসন পরিচালনা করেছিল, তারাও সমভাবে দায়ী। ওই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে কেবল দলীয়করণ করাই নয়, সেটাকে ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার যুক্তি হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছিল। এই দায় আওয়ামী লীগের। তাদের বয়ান মিথ্যা, শোষণ ও ক্ষমতায় চিরস্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে প্রণীত।
প্রশ্ন : নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ উঠছে। আপনি এটা কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : বর্তমান সরকারের অধীনে দেখলাম, বঙ্গভবন থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলা হয়েছে। আমি এটি সঠিক মনে করি না। আওয়ামী লীগ কেবল এক ব্যক্তির ছবি টাঙিয়ে যে মিথ্যা ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল, সেটির অবসান অবশ্যই কাম্য। তা করতে হলে বঙ্গবন্ধুর ছবি সেখানে রেখেই একই সঙ্গে তাঁর পাশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, মণি সিংহ, এমএজি ওসমানী, শেরবাংলা একে ফজলুল হক সবার ছবি টাঙিয়ে দেওয়াই হতো সঠিক কাজ। আওয়ামী লীগের বিকৃত বয়ানকে কবর দিতে হবে ঠিকই, সে কারণে ইতিহাসকে কবর দেওয়া কিংবা মুক্তিযুদ্ধকে কবর দেওয়া কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। সমাজকে যেমন অপসারণ করা যায় না, জনতার যেমন মৃত্যু নেই, সেই কারণে মুক্তিযুদ্ধও অমর।
প্রশ্ন : এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
উত্তর : আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে যে গভীর ক্ষত এবং রুগ্ণতা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে দেশকে উদ্ধার করা জরুরি কর্তব্য। সে ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য। আমি এটাও মনে করি, মৌলিক সংস্কার হোক কিংবা ছোটখাটো কোনো সংস্কার হোক, তার বাস্তবায়ন করতে হলে জনগণের অংশগ্রহণ, তাদের মতামত ও সম্মতি জরুরি।
প্রশ্ন : এ সংস্কার কারা করবে?
উত্তর : সংস্কার কার্যক্রম নিশ্চিত করার জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় শর্ত হলো, সংস্কারের আগেই এই উদ্দেশ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। সেই সঙ্গে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণের পরিবেশ ও তাদের সম্মতি নিশ্চিত করতে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করে আনা। সুতরাং সংস্কারের আগেই নির্বাচন অপরিহার্য। কিন্তু সে নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। আমাদের দেশে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। যে কারণে নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার জন্য প্রয়োজনে নির্বাচনের আগেই এই নির্দিষ্ট বিষয়ে কতিপয় সংস্কার অপরিহার্য।
সে ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলো– অর্থশক্তি, পেশিশক্তি, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতার ব্যবহার ইত্যাদি থেকে নির্বাচন ব্যবস্থাকে মুক্ত করা। অন্য সব সংস্কারের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা, কথাবার্তা হওয়া এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে সেসব মতামত তুলে দিতে পারলে তারা দ্রুত একান্ত প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোর বিষয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে পারবে।
প্রশ্ন : এ বাস্তবতায় এবারের স্বাধীনতা দিবসকে কীভাবে দেখছেন?
উত্তর : এবার আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করছি বিভিন্ন শক্তির ঘাত-প্রতিঘাত ও তার ফলে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ইত্যাদির পটভূমিতে। মানুষের ভেতরে ‘কী হবে, কী হবে’– এই প্রশ্ন। অনেক মহল দেশকে অনিশ্চয়তার ভেতরে রেখে কোনো স্বার্থ চরিতার্থ করতে ইচ্ছুক। দেশের ভেতরে বহু রকম চক্র আপন আপন স্বার্থে ঘটনাবলিকে পরিচালনার চেষ্টা করছে। এদিকে সরকারের যেগুলো প্রাথমিক কর্তব্য, যথা– দৈনন্দিন নাগরিক জীবনের শান্তি ও স্বস্তি নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ রাখা, আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করা, আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকার দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছে না।
প্রশ্ন : তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
উত্তর : তরুণ সমাজ সম্প্রতি ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে। আমি তাদের সালাম জানাই। তাদের উদ্দেশে বলব, এ কথা ভুলে যাবেন না, জনগণ বিশেষত মেহনতি জনগণ পাশে না থাকলে গণঅভ্যুত্থান সফলতার মুখ দেখতে পারত না। তাই বৈষম্যবিরোধী স্লোগানের অর্থ যেন লুটপাট ও গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে আওয়ামী আনুকূল্য দূর করে অন্যদের সুযোগ দেওয়ায় পর্যবসিত না হয়। যা-ই করা হোক না কেন, তার সবকিছুই করতে হবে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে (সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা) ভিত্তি করে। এ বিষয়ে সবকিছুই যে সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে, নানা বিপদের আশঙ্কা দানা বাঁধছে সে কথা বলা যাবে না। তাই আওয়ামী স্বৈরশাসনের পুনরাবির্ভাব ঘটানোর প্রচেষ্টার যেসব ফাঁদ পাতা হচ্ছে, সে সম্পর্কে সতর্ক হয়ে পথ চলতে হবে। এই আশঙ্কা রোধ করতে হবে।
প্রশ্ন :বর্তমান সংকট উত্তরণের উপায় কী?
উত্তর :নানাদিকে আওয়ামী পুনরাবির্ভাবের ভয় দেখিয়ে জঙ্গি সাম্প্রদায়িক শক্তি জামায়াত এবং আরও কিছু কিছু প্লাটফর্মের মাধ্যমে ভয়াবহ দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এই অপশক্তিকে কিছুতেই মাথা তুলতে দেওয়া যাবে না। একই সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, চলমান সংকটের সমাধান বা পরিত্রাণের কোনো রাজনীতিবহির্ভুত কিংবা অরাজনৈতিক পথ নেই। এনজিও, সুশীল সমাজ প্রভৃতি দ্বারা অথবা সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদের নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়। সুতরাং পথ একটাই, রাষ্ট্র ক্ষমতায় জনগণের প্রকৃত স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তির একত্রিত হয়ে ‘নয়া যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপেœর ধারায়, অর্থাৎ সমাজতন্ত্র অভিমুখে গণতন্ত্র, সামাজিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা। ’৭১-এ ঘোষিত নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে জনগণকে সক্রিয়, সচেতনতা ও একতাবদ্ধ করে নতুন বন্দোবস্তের আলোকে রাষ্ট্র ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ও রাষ্ট্র্রক্ষমতা পরিচালনা করা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন স ব ধ নত ব যবস থ জনগণ র চ ত কর পর চ ল র জন ত হয় ছ ল কবর দ আওয় ম ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব: সালাহউদ্দ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুর সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব।’’
তিনি মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান এলে যেকোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া ঠেকানো যাবে।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘আগামী নির্বাচনকে যদি অনিশ্চিত করা হয় বা বিলম্বিত করা হয়, তাহলে তার সুযোগ নেবে ফ্যাসিবাদী বা অসাংবিধানিক শক্তি। এর পরিণতি জাতি অতীতে বহুবার ভোগ করেছে। আমরা আবার সে পরিস্থিতি চাই না।’’
অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে পৃথক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সাংবিধানিকভাবে এই সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সে দেওয়া সেই মতামত এখনো বহাল আছে। এর বিপরীতে সুপ্রিম কোর্ট কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তাই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা আসলে রাজনৈতিক বক্তব্য, এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’’
সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘যেকোনো সাংবিধানিক আদেশ জারি হলে তা আগামীকাল বা পরশু চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমরা এমন খারাপ নজির জাতির সামনে আনতে চাই না। তাই সমাধানের বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। সবাইকে বিবেচনায় নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’’
পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের অধিকার আছে। তবে পিআর পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, শেষ পর্যন্ত জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।’’
তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘‘পিআর পদ্ধতিতে ঝুলন্ত পার্লামেন্টের ঝুঁকি থেকে যায়। তাতে রাষ্ট্র ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব হয় না। আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারি না।’’
সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘জনগণই হলো সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। এই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বারবার গণতন্ত্রকে সংকট থেকে উদ্ধার করেছে।’’
আগামী সংসদে কিছু মৌলিক বিষয়ে সংশোধনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘‘আমরা কিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে একমত হয়েছি। তবে, ঐকমত্য কমিশনের সনদের ভেতরে যেসব পরিবর্তন হবে, সেগুলোতে অবশ্যই গণভোট নিতে হবে।’’
ঢাকা/আসাদ/রাজীব