বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘বেহাত বিপ্লব’ কথাটা ঘুরেফিরে আসে। কথাটার পেছনে মূল ভাবটুকু হলো বিপ্লবের সুফল থেকে মানুষ বঞ্চিত হয় বা হয়েছে। আজ ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের উষালগ্নে দাঁড়িয়ে ভেবে দেখা প্রয়োজন, কেন বা কোন প্রক্রিয়ায় এই হাতছাড়া হওয়ার ঘটনা ঘটে, আর কখনই–বা আমরা সেটা দেখতে পাই? 

বিপ্লবোত্তর সমাজ গঠনের কালে যখন দেখা যায়, যে ব্যবস্থা, যে কাঠামো কিংবা আজকের আলোচিত পরিভাষায় যে বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, সেই ব্যবস্থা, কাঠামো ও বন্দোবস্ত সমাজের ভেতর পুনর্বহাল হচ্ছে, কেবল শাসকের মুখ বদলে যাচ্ছে, তখন আমরা বুঝতে পারি যে ব্যক্তি বদল হলেও বিপ্লব তার সুদূরপ্রসারী-গভীরতর লক্ষ্য সাধনে ব্যর্থ হয়েছে। নিপীড়িত জনতার বিপ্লব হাতছাড়া হয়েছে, নিপীড়কের পুরোনো বন্দোবস্ত পুনর্বার ফিরে এসেছে। ১৯৭১–পরবর্তী বাংলাদেশে এমনটিই ঘটেছিল।

যে দল ১৯৭১–এর পটভূমি রচনায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তৎকালীন পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকারের দাবি সামনে এনেছিল, সেই আওয়ামী লীগ স্বাধীন দেশে শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে জনবিরোধী ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। স্বাধীনতা–উত্তর আওয়ামী শাসনামলে জনবিরোধিতার স্মারক হয়ে উঠেছিল অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও অপশাসন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাট আর রাজনৈতিক পরিসরে নজিরবিহীনভাবে ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ; যা দ্রুততম সময়ের মধ্যে শাসকগোষ্ঠীর জনবিচ্ছিন্নতাকে ত্বরান্বিত করেছে। অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত ‘উদ্বাস্তু’ কবিতায় যেমনটা বলেছিলেন, ‘.

..ক্লান্ত যাত্রার শেষ পরিচ্ছেদে এসে/ ছেঁড়াখোঁড়া খুবলে নেওয়া মানচিত্রে হঠাৎ দেখতে পেল আলো-ঝলমল ইন্দ্রপুরীর ইশারা...’—আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের আদতে যেন সেই দশাই হয়েছিল।

১৯৭১–এর উত্থান পর্বে যাঁরা নায়কের আসনটি অন্য কারও সঙ্গে ভাগাভাগি করতেও রাজি ছিলেন না, স্বাধীনতার তিনটি বছর পেরোতে না পেরোতে তাঁরাই গণশত্রুতুল্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। স্বাধীনতার স্বাদ মিথ্যা হয়ে যাওয়ার, আজাদি ঝুটা হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অবশ্য এই ভূখণ্ডের মানুষের সেটাই প্রথম নয়। এর মাত্র কিছুকাল আগে ১৯৪৭–এর পার্টিশনের অব্যবহিত পরে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান তার জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। যে মুসলিম লীগ কৃষকের কল্পরাজ্যের স্বপ্ন মানুষের মনে এঁকে দিয়েছিল, তারাই সদ্য স্বাধীন দেশে শাসক হিসেবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। ফলে এ অঞ্চলের মানুষ কেবল তাদের দিক থেকে নয়, তাদের ‘কল্পরাজ্য’ থেকেও মুখ ফিরিয়ে নেয়। সাতচল্লিশোত্তর মুসলিম লীগ আর একাত্তর-পরবর্তী আওয়ামী লীগ—কারও ক্ষেত্রেই আধা দশকও লাগেনি নিরঙ্কুশ জনপ্রত্যাখ্যান অর্জন করতে।

২১ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, সেনাছাউনির দিকে আঙুল তুলে তরুণ নেতৃত্ব অভিযোগ করেছেন যে তাঁদের কাছে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের সত্যতা নিরূপণ করা অতি আবশ্যক। দেশের ভেতরে–বাইরে যখন নানামুখী ষড়যন্ত্র চলমান, তখন ন্যূনতম শর্তে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা ছাড়া অন্য কোনো পথ কি আমাদের সামনে আছে?

বিপ্লব বেহাত হওয়ার এসব ঐতিহাসিক নজিরের দিকে বারবারই ফিরে তাকাই। আর তাই ২০২৪–এর রক্তস্নাত দীর্ঘ জুলাইকে লোকে যখন আদর করে ‘বিপ্লব’ নামে ডাকে, তাদের আকাঙ্ক্ষা আমাকে প্রলুব্ধ করলেও আমি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করতে পারি না। ৫ আগস্টে আমাদের প্রথম এবং ওই মুহূর্তের প্রধান চাওয়াটা পূরণ হয়েছিল—স্বৈরশাসককে ক্ষমতা থেকে নেমে যেতে হয়েছিল। কিন্তু স্বৈরশাসনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, উপাদান ও বৈশিষ্ট্যগুলো রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামো এবং ব্যবস্থার স্তরে স্তরে দগদগে ক্ষত হয়ে টিকে আছে। এই ক্ষত নিরাময়ের জন্য যে ন্যূনতম ঐক্য ও সহিষ্ণুতা থাকা প্রয়োজন, তা কি আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে এই মুহূর্তে আছে?

গণ-অভ্যুত্থানে যে নানা পক্ষের মানুষ কাতারে দাঁড়িয়েছিল, ক্ষমতার জগদ্দল পাথরটা সরে যাওয়ার পর তারা অর্থাৎ ডানপন্থী, চরম ডানপন্থী, মধ্যপন্থী, বামপন্থী সবাই নিজ নিজ পক্ষীয় কল্পনার দেশ তৈরির জন্য কাজ করে চলেছে। কিন্তু এ–ও মনে রাখতে হবে, যেকোনো একটি পক্ষের স্বপ্ন, রাজনীতি এবং আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা অপরাপর পক্ষগুলোর স্বপ্ন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রধারণার চেয়ে মূলগতভাবে কেবল ভিন্নই নয়, বরং কোথাও কোথাও সরাসরি সাংঘর্ষিক। এটা সংকটের একটা দিক বটে, কিন্তু দীর্ঘ স্বৈরশাসন যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করে রেখেছিল, তাতে এমনটাই হওয়ার কথা। সংকটের গভীরতর দিকটি বিরাজ করছে অন্যত্র।

স্বৈরশাসনের দমন-পীড়ন এ দেশের মানুষের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করেছে, তার চেয়ে গভীরতর ক্ষতচিহ্ন, লোভ, অসহিষ্ণুতা, স্বার্থকেন্দ্রিকতা—এই সবকিছু জনমানসে প্রায় পাকাপাকিভাবে এঁকে দিয়ে গেছে বিগত দীর্ঘ অপশাসন। যারা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি, তারাও এর বাইরে নই। আমাদের তরুণ নেতৃত্ব, তাঁরা তো বড়ই হয়েছেন লোভ, ভয় আর ঘৃণার বাতাবরণে। মুরব্বিদের নেতৃত্ব, শাসনকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন বটে, কিন্তু তাঁদের রেখে যাওয়া লিগেসিকে তাঁরা পুরোপুরি ছেড়ে আসতে পারেনি।

যে বিভাজন, তকমা সাঁটা কিংবা ট্যাগিংয়ের রাজনীতির শিকার তাঁরা হয়েছিলেন, যেসবকে প্রত্যাখ্যানের মধ্য দিয়েই তাঁদের উত্থান, সেই বিভাজনের, ট্যাগিংয়ের রাজনীতিকে আমরা আবার মাঠে ফিরে আসতে দেখছি। হাসিনা ও সিপি গ্যাংয়ের ট্যাগ ছিল ‘রাজাকার’, ‘জামায়াত-বিএনপি’, ‘জঙ্গি’ অথবা ‘বুদ্ধিবেশ্যা’। এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাঁরা ঘুরে দাঁড়ালেন, তাঁরা এখন প্রতিপক্ষকে ডাকছেন ‘নারীবাদী’, ‘শাহবাগী’, ‘বাম’ কিংবা ‘র–এর এজেন্ট’ নামে।

হাসিনার শাহবাগ-শাপলার বাইনারির রাজনীতি নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, এমনকি হাসিনাবিরোধীদের মাধ্যমেই। আমরা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ রাজনীতি কিংবা ‘নতুন বন্দোবস্ত’র ডাক পেয়ে আশান্বিত হই। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখতে পাই বিভাজন, বর্জন, নিশ্চিহ্নকরণের হুংকার রাজনীতির অপরাপর অঙ্গীকার ও তৎপরতাকে হটিয়ে মাঠের দখল নিয়েছে। এত বিদ্বেষ আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে?

বীজ বপনের ঋতুর জন্য উন্মুখ হয়ে আছে এই ভূখণ্ডের অশোকতরুসকল। কিন্তু আমাদের বাহিনীগুলো এখনো গুম-খুনের ঊর্ধ্বে নয়। ১৯৪৭-এর পরের পুলিশ বাহিনী, ১৯৭১–এর পরের রক্ষীবাহিনীর মতোই ২০১৪–এর পরের পুলিশ, র‍্যাব, ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক আগের মতোই দূরত্বব্যঞ্জক, ভীতিকর ও অনাস্থার। দীর্ঘ জুলাই কিংবা তার আগের নিদেনপক্ষে পনেরো-ষোলোটা জুলাই ধরে যে খুন–গুম-সহিংসতা এ দেশে সংঘটিত হয়েছে, তার বিচারের কাজ এখনো সামান্যই এগিয়েছে। শোনা যায়, আওয়ামী আমলের লুটপাটের হোতা ব্যবসায়ীদের দলে ভেড়াতে তৎপর নানা পক্ষ। হাসিনা ও তাঁর ল্যাঞ্জা ক্রমে ক্রমে সেফ এক্সিট পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজনীতির মাঠে ঐক্যের চেয়ে বিভেদ-বিদ্বেষের সুর বিকটভাবে বাজছে।

আরও শোনা যায়, ৫ আগস্টের পরমুহূর্তে আমাদের তরুণ নেতৃত্ব মুরব্বি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। মুরব্বিদের অনীহার কারণেই নাকি তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ঘটনা কি আসলেই সে রকম? এত জান কোরবান করার পরে, এ দেশের মানুষের জানার অধিকার আছে যে বড় দলগুলোর দিক থেকে কেন এ ব্যাপারে সাড়া মেলেনি! নাকি আমরা বুঝে নেব যে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে দেশ গঠনের কঠিন কাজটি করার চেয়ে, ব্যর্থতার ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সহজ পথটি বেছে নিয়েছিলেন। তাঁরা কি সরকারকে দুর্বল করে রাখার মধ্য দিয়ে দ্রুত নির্বাচনকে ত্বরান্বিত করতে চেয়েছেন, কিংবা সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে চেয়েছেন?

২১ মার্চ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখলাম, সেনাছাউনির দিকে আঙুল তুলে তরুণ নেতৃত্ব অভিযোগ করেছেন যে তাঁদের কাছে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই অভিযোগের সত্যতা নিরূপণ করা অতি আবশ্যক। দেশের ভেতরে–বাইরে যখন নানামুখী ষড়যন্ত্র চলমান, তখন ন্যূনতম শর্তে জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করা ছাড়া অন্য কোনো পথ কি আমাদের সামনে আছে? এই সত্যটুকু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, ততই মঙ্গল। আরেকটা বেহাত বিপ্লবের ভার এই ক্ষতবিক্ষত জনপদ সইতে পারবে না। নিষ্ফলা এই জমিনে বীজ বপনের ঋতু ফিরিয়ে আনতেই হবে।

সাঈদ ফেরদৌস গবেষক ও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) সহ-উপাচার্য

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র র জন ত ক স ব ধ নত ব যবস থ হয় ছ ল আম দ র আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১—এই ২৪ বছর ধরে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানকে তদানীন্তন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ কলোনি’ হিসেবে লুণ্ঠন, শোষণ, বঞ্চনা, পুঁজি পাচার ও অমানুষিক নিপীড়নের অসহায় শিকারে পরিণত করেছিল, সে সম্পর্কে নিচে কয়েকটি নজির উপস্থাপন করছি। এগুলো জানার পর বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কারোরই পাকিস্তানপ্রেমী হওয়া অযৌক্তিক। কেউ যদি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতবিরোধী হয়, সেটাকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করলে দোষণীয় নয়। কিন্তু পাকিস্তান তো এখনো বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের গণহত্যার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। 

১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণ ছিল পাকিস্তানের জনগণের ৫৬ শতাংশ, কিন্তু উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তগুলো প্রমাণ করছে, কত নির্মমভাবে পাকিস্তানের শাসকমহল পূর্ব পাকিস্তানকে (‘পূর্ব বাংলা’ থেকে যার নাম ১৯৫৫ সালে হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান’) বঞ্চনা, শোষণ, লুণ্ঠন, পুঁজি-পাচার ও বৈষম্যের শিকার করেছিল—

১. প্রাথমিক পর্যায়ে পাকিস্তানের রপ্তানি আয়ের ৭৫-৭৭ শতাংশই আসত পূর্ব বাংলার রপ্তানি পণ্য থেকে। ওই রপ্তানি আয়ের প্রায় পুরোটাই ১৯৪৭-৪৮ অর্থবছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার দখলে নিতে শুরু করেছিল। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন যখন জোরদার হতে শুরু করেছিল, তখন বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের একটা ক্রমবর্ধমান অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বরাদ্দ করা হলেও ১৯৪৭-১৯৭১ এই ২৪ বছরের শেষে এসেও কখনোই বছরে রপ্তানি আয়ের এক-পঞ্চমাংশও পূর্ব পাকিস্তান নিজেদের ভাগে পায়নি, এই ২৪ বছরের গড় বার্ষিক হিস্যা ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।

২. ইঙ্গ-মার্কিন বলয়ে অবস্থান গ্রহণের কারণে পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই বিভিন্ন দাতাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান পাওয়ার ব্যাপারে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। ২৪ বছরে ওই বৈদেশিক সাহায্যের মাত্র ১৭ শতাংশ পেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার পর ওই ১৭ শতাংশ ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ গ্রহণ করার পরই কেবল দাতাদেশ ও সংস্থাগুলো নতুন করে স্বাধীন বাংলাদেশকে ঋণ ও অনুদান দিতে রাজি হয়েছিল।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি

৩. পূর্ব পাকিস্তান থেকে ২৪ বছরে পাকিস্তানের ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ আমানত সংগ্রহ করেছিল, তার মাত্র ৮ শতাংশ বাংলাদেশের ঋণগ্রহীতারা পেয়েছে, বাকি ৯২ শতাংশই পাকিস্তানের সরকার ও শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা কবজা করে নিয়েছেন।

৪. ওই ২৪ বছরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সরকারি বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়িত হয়েছিল, বাকি ৭২ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে।

৫. ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত পাকিস্তানের তিনটি পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় বরাদ্দের মাত্র ২৯ শতাংশ ব্যয় করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে।

৬. পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানিদের অনুপাত কখনোই ৭ শতাংশ অতিক্রম করেনি। সশস্ত্র বাহিনীগুলোর অফিসারদের মধ্যে বাঙালিদের অনুপাত এমনকি ৫ শতাংশেও পৌঁছায়নি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।

৭. ১৯৭০ সালে খোদ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রাইভেট খাতের শিল্পকারখানার মাত্র ১১ শতাংশের মালিক ছিল বাঙালিরা, বাকি ৮৯ শতাংশের মালিক ছিল হয় পশ্চিম পাকিস্তানিরা নয়তো অবাঙালিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত একটি শিল্পকারখানার মালিকও বাঙালি ছিল না।

৮. মুক্তিযুদ্ধের সময় ডিসেম্বর মাসে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট খালি করে অর্থ পাচার করে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের রিজার্ভের সব সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়েছিল পাকিস্তানে।

৯. ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল প্রশাসনে বাঙালি ছিল মাত্র ১৬ শতাংশ, আর বাকি ৮৪ শতাংশই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও অবাঙালিরা।

১০. যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তানে থাকা নৌবাহিনীর জাহাজ, বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টারের একাংশ এবং পিআইএর বেশ কয়েকটি উড়োজাহাজ বার্মার সহায়তায় পাকিস্তানে নিয়ে যেতে পেরেছিল পাকিস্তান সরকার।

১১. পাকিস্তানের তিনটা রাজধানী করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের বিপুল নির্মাণ ব্যয়ের সিংহভাগই বহন করেছিল পূর্ব পাকিস্তান।

১২. ২৪ বছরে পাকিস্তান সিন্ধু নদ ও এর শাখাগুলোতে বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বৈদেশিক সাহায্যের মাধ্যমে। এ কারণে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের ৬৫ শতাংশ কৃষিজমি ১৯৭০ সালে সেচের আওতায় এসেছিল। এর বিপরীতে ওই ২৪ বছরে পূর্ব পাকিস্তানের মাত্র ২২ শতাংশ কৃষিজমি সেচের আওতায় আনা হয়েছিল। উপরন্তু আর্থিক ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা সমস্যার সমাধানে অর্থায়ন করতে বারবার অস্বীকার করেছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার।

স্বাধীনতা-উত্তর ৫৪ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন বারবার বিঘ্নিত হলেও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকখানি এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ২০২৫ সালে ২ হাজার ৭৫০ ডলার ছাড়িয়েছে, অথচ পাকিস্তানের মাত্র ১ হাজার ৫৪৭ ডলার। এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের জনগণের জন্য কতখানি যৌক্তিক ছিল।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনার সরকারের মতো ভারতের কাছে নতজানু হবে না, সেটাই যৌক্তিক। কিন্তু বাংলাদেশের সীমানার প্রায় তিন পাশ ঘিরে থাকা বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় না রাখলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে চাইলেও কোনোমতেই ভুলে যাওয়া যাবে না যে পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চায়নি এবং বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনাও পরিশোধ করেনি।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক, যে বাস্তবতা ভোলা যাবে না