মাদারীপুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস স্মরণ করলেই এ আর হাওলাদার জুট মিলের কথা উঠে আসে। কারখানাটির ভেতরে জেলার বৃহৎ বধ্যভূমি বা গণকবর। একাত্তরে প্রায় ৭০০ নারী-পুরুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। এক দশক আগে এখানে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু ভূমি জটিলতায় কাজটি বাতিল হয়ে যায়। এখন স্থানটি গবাদিপশুর চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানার ভেতরে সুনসান নীরবতা। বেশির ভাগ ঝোপঝাড়ে ভরা। বড় বড় কিছু খেজুর ও নারকেলগাছ দেখা যায়। কারখানার বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। গণকবরের স্থানটির চারপাশ অরক্ষিত। গরু-ছাগলের চারণভূমিতে পরিণত হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মাদারীপুর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১০ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থানগুলো সংরক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। প্রকল্পের অধীনে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাদারীপুরের বৃহৎ বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত এ আর হাওলাদার জুট মিলে জাদুঘর নির্মাণের স্থান নির্বাচন করে কর্তৃপক্ষ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৫৮ লাখ টাকা ব্যয় ধরে ‘এ আর হাওলাদার জুট মিল জেনোসাইড এবং টর্চার সেল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। কাজটি পায় মেসার্স জনি আলম এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু স্থানটি ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি হওয়ায় জাদুঘরের নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেননি ঠিকাদার। পরে প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়।

এলজিইডির মাদারীপুর কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মো.

ওবায়দুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাওলাদার জুট মিলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মিলের যে অংশে বধ্যভূমি, সেখানে একটি জাদুঘর নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করে কাজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই প্রকল্পটা অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। পরে জমির মালিকানা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। আমরা কাজটি ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দিতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে কাজটি বাতিল হয়ে যায়।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সদর উপজেলার কুকরাইল মৌজার এ আর হাওলাদার জুট মিলের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের সময় জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েক হাজার মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। ধর্ষণ করা হয় অগণিত নারীকে। কারখানার ভেতরে তাঁদের গণকবর দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মূলত কারখানায় বাহিনীটির ঘাঁটি ছিল। এখানে তারা প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করত। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর মাদারীপুর শত্রুমুক্ত হলে সেখানে অসংখ্য মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়।

মাদারীপুর সদরে সাতটি ও রাজৈরে আটটি গণকবর বা বধ্যভূমি আছে। এর মধ্যে হাওলাদার জুট মিলের বধ্যভূমিটি সবচেয়ে বড়। কারখানার ডি-টাইপ ভবনের টর্চার সেলে অসংখ্য নারীকে মাসের পর মাস আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এর মধ্যে শহীদ সুফিয়ার পরিবার অন্যতম। এ ছাড়া হাজারো বাঙালিকে কারখানার উত্তর পাশে আড়িয়াল খাঁ নদের পাড়ে দাঁড় করে ব্রাশফায়ার করে নদে ফেলে দেওয়া হয়। তাঁদের অধিকাংশই পূর্ব মাদারীপুরের (শরীয়তপুর) বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা ছিলেন।

কুকরাইল এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল ১২ বছর। কারখানার ভেতরের অনেক কিছুর প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। কারখানার ভেতরে বসে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যুদ্ধের সময় মিলটিই পাক বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এখানে বহু মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। যুদ্ধের পরেও বহু বছর ভয়ে এখানে কেউ আসত না। এখন মিলের বেশির ভাগ জায়গা ঝোপঝাড়ে ভরা জঙ্গল। যুদ্ধের কোনো স্মৃতিই এখন এখানে নাই। যেখানে গণকবর ছিল, সেই জায়গাটির বেশির ভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সংস্কার না হলে যা আছে, তা-ও ভবিষ্যতে থাকবে না।’

মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে সরকারের অবহেলাকে দায়ী করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডের প্রধান সমন্বয়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ আর হাওলাদার জুট মিলের বধ্যভূমিটি দীর্ঘদিন ধরে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। কয়েক বছর ধরে সেখানে জাদুঘর করার কথা বললেও বাস্তবে করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষোভ আছে। তবে এবার তাঁরা ওখানে নতুন করে স্মৃতি জাদুঘর করার উদ্যোগ নিয়েছেন। ভূমি জটিলতা থাকলেও সমাধান করে জাদুঘর করা হবে। বিষয়টি প্রশাসনের লোকজন নিশ্চিত করেছেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ দ ঘর ন র ম ণ র প রকল প সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।

সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।

ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ