প্রায় ১৪১ কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ চীন যেকোনো দেশের জন্যই একটি বড় বাজার। কিন্তু বাজারটি ভালোভাবে ধরতে পারছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত কোনো অর্থবছরেই এক বিলিয়ন অর্থাৎ ১০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে পারেনি চীনে। অথচ চীন ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারও দিয়েছে বাংলাদেশকে। এ সুযোগও বাংলাদেশ নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ চীনের বাজার ধরতে না পারলেও দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে। সেটি হচ্ছে মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ব্যবসা বৃদ্ধির কারণে। এতে গত ১০ বছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বেড়ে তিন গুণ ছাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বাণিজ্যের ব্যবধান। কারণ, চীন থেকে আমদানি বাড়লেও সেভাবে রপ্তানি বাড়ছে না দেশটিতে। দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশই আসে চীন থেকে। যদিও মোট রপ্তানির মাত্র ১ দশমিক ২২ শতাংশ যায় চীনে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীন থেকে দুই হাজার ১১২ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে দেশটিতে বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। অর্থাৎ রপ্তানির তুলনায় বাংলাদেশ ৩১ গুণ বেশি আমদানি করেছে চীন থেকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩৫ বছরের আমদানি পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরে ১১ কোটি ডলারের পণ্য আসে চীন থেকে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে চীন থেকে আসে প্রায় ২০৮ কোটি ডলারের পণ্য। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯-১০ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয় প্রায় ৩৮২ কোটি ডলারের পণ্য। এভাবে চলতে চলতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসে চীন থেকে আসে ১ হাজার ৫৫৮ কোটি ২০ লাখ ডলারের পণ্য। কোভিড-১৯ মহামারি শুরু হলে পণ্য আমদানি আগের অর্থবছরের তুলনায় কমে যায়। ওইবার চীন থেকে আমদানি হয় ১ হাজার ৪৩৬ ডলারের পণ্য।

তবে কোভিড একটু দুর্বল হয়ে এলে চীন থেকে ব্যাপকভাবে বাড়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি। ২০২১-২২ অর্থবছরে চীন থেকে আমদানি হয় ২ হাজার ৪২৫ কোটি ডলারের পণ্য, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। বিপরীতে ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় ওই অর্থবছরে।

প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর

দুই দেশের এমন বাণিজ্য বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ২৬ মার্চ থেকে চীন সফরে রয়েছেন। তাঁর চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফর আজ শনিবার শেষ হয়েছে।

সফরে তিনি গতকাল শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বাসসকে জানান, বাংলাদেশে বিনিয়োগে চীনা বিনিয়োগকারীদের এবং শিল্প কলকারখানা স্থানান্তরে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার আশ্বাস দিয়েছেন সি চিন পিং।

আগের দিন গত বৃহস্পতিবার চীনের হাইনানের উপকূলীয় শহরে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া বার্ষিক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেন চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং শ্যুয়েসিয়াংয়ের সঙ্গে। মুহাম্মদ ইউনূস এ বৈঠকে চীনের তৈরি পোশাক কারখানা, বৈদ্যুতিক যানবাহন, হালকা যন্ত্রপাতি, উচ্চপ্রযুক্তির ইলেকট্রনিকস, চিপ উৎপাদন এবং সৌর প্যানেল-শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তর সহজ করতে বেইজিংয়ের সহায়তা চান।

উপপ্রধানমন্ত্রী ডিং শ্যুয়েসিয়াং জানান, ২০২৮ সাল পর্যন্ত চীনে বাংলাদেশি পণ্য শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে, যা বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের দুই বছর পর পর্যন্ত বহাল থাকবে।

চীনা পণ্যের দাপট বাংলাদেশে

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পণ্য আমদানির উৎস হিসেবে একসময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দের দেশ ছিল ভারত, তবে এক যুগ আগেই তা পাল্টে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে চীনা পণ্যের যে দাপট চলছে বাংলাদেশের বাজারে, এখনো তা বজায় আছে। অর্থাৎ পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের প্রথম পছন্দের দেশ এখন চীন। এর পরেই ভারতের অবস্থান।

বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ঠিক যে দুই দেশের বাণিজ্য ব্যবধান অনেক বড়। তবে আশা করছি, প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের মাধ্যমে ভালো কোনো খবর পাব। তবে চীনে রপ্তানি বাড়াতে গেলে আমাদের দেশটি যে ধরনের পণ্য চায়, সে ধরনের পণ্য প্রস্তুত করতে হবে।’

মামুন মৃধা জানান, কোভিড-১৯-এর পর কাঁকড়া ও কুঁচিয়া রপ্তানি অনেক কমে গেছে। আগে যেখানে ১৫০টি প্রতিষ্ঠান এ দুটি পণ্য রপ্তানি করত, এখন করে ১৬টি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া কম দামের টি-শার্ট ও ট্রাউজার রপ্তানিরও ভালো বাজার আছে চীনে। চামড়ার জন্যও চীন একটি গন্তব্যস্থল। নেপাল, পাকিস্তান, ভারত এমনকি ভুটানও যদি চীনে ভালো রপ্তানি করতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না—প্রশ্ন তাঁর।

চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতিই বেশি। বাংলাদেশ অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ আর পোশাক তৈরির বেশির ভাগ কাঁচামালও আসে চীন থেকে। এ ছাড়া বয়লার, তুলা, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, সুতা, লৌহ, ইস্পাত ইত্যাদি পণ্যও আমদানি করা হয় চীন থেকে।

রপ্তানি ও বিনিয়োগ চিত্র

ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রচলিত পণ্য দিয়ে চীনের বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধি করা কঠিন। ভালো মানের কোম্পানিই পারবে প্রতিযোগিতায় টিকে রপ্তানি করতে। উচ্চহারে মূল্য সংযোজিত পণ্যের চাহিদা দেশটিতে বাড়তে থাকবে। রপ্তানি বাড়াতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের সেদিকে জোর দিতে হবে। দেশটির প্রধান ২০ আমদানি পণ্যের একটির তালিকায়ও যদি বাংলাদেশি কোনো পণ্য ঢুকতে পারে, তাহলেও বাণিজ্যের ব্যবধান অনেক কমে আসবে।

এদিকে চীনা বিনিয়োগও খুব বেশি নয় দেশে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে চীনা বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৫২ কোটি ৫৮ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলারে। অথচ ২০১৮ সালেই বিনিয়োগ ছিল দ্বিগুণ অর্থাৎ ১০৩ কোটি ডলার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনীতির বৈচিত্র্যের অংশ হিসেবে চীন যখন প্রতিযোগিতামূলক দামে বিভিন্ন মানের পণ্য উৎপাদনের দিকে গেল, বাংলাদেশ তখন মূলধনি যন্ত্রপাতি বেশি আনা শুরু করল চীন থেকে। আগে বাংলাদেশ এগুলো আনত জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া—এসব দেশ থেকে। একসময় যত দূর সম্ভব বাংলাদেশের শিল্পায়নেও গতি এল। তখন চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি বেড়ে গেল। শুধু মূলধনী যন্ত্রপাতি নয়, মধ্যবর্তী পণ্য ভোগ্যপণ্যও আসতে থাকে চীন থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নে চীনা প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত পণ্য।

চীনা বিনিয়োগ এত কম কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শুধু চীন কেন, সার্বিক বিনিয়োগ চিত্রই তো আশাব্যঞ্জক নয়। কারণও আছে। একজন বিনিয়োগকারী আমাকে বললেন, আধা মিনিটের জন্যও যদি বিদ্যুৎ চলে যায়, তাহলে তাঁর মিলিয়ন ডলারের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবে। চীন কেন ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় বিনিয়োগ বাড়িয়েছে, এর জবাব খুঁজতে গেলেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ কম হওয়ার কারণ স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ

‎পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চারটি কোম্পানির সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও তা নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন না করায় সাত নিরীক্ষক (অডিটর) প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ বছরের জন্য অডিট এবং অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সেইসঙ্গে ওই নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষকদের কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না, সেই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে তাদের শুনানিতে ডাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।

আরো পড়ুন:

সোনালী পেপারের শেয়ার কারসাজি: ১১ কোটি ৮২ লাখ টাকা জরিমানা

পুঁজিবাজার উন্নয়নে ডিএসই ও ডিসিসিআইয়ের যৌথ সভা

‎গত মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে ৯৭৩তম কমিশন সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ‎বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিএসইসির পরিচালক ও মুখপাত্র আবুল কালাম স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

‎সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক এ হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; রিংসাইন টেক্সটাইল লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক যথাক্রমে: আহমেদ অ্যান্ড আক্তার, মাহফেল হক অ্যান্ড কোং, আতা খান অ্যান্ড কোং এবং সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস; আমান কটন ফাইব্রাস লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক ইসলাম কাজী শফিক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস এবং ফারইষ্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের ৩০ জুন, ২০১৮ ও ২০১৯ সমাপ্ত অর্থবছরের নিরীক্ষা ফার্ম ও নিরীক্ষক মাহফেল হক অ্যান্ড কোং চার্টার্ড এ্যকাউন্ট্যান্টস আর্থিক প্রতিবেদনে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম ও সিকিউরিটিজ আইনের লঙ্ঘন থাকা সত্ত্বেও নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উত্থাপন করেনি। 

এ সকল নিরীক্ষা ফার্ম এবং নিরীক্ষককে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানি, সকল ধরনের বিনিয়োগ স্কিম (যথা- মিউচ্যুয়াল ফান্ড, অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড ও এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড) এবং পুঁজিবাজারে মধ্যস্থতাকারী সকল প্রতিষ্ঠানের অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রম পরিচালনার উপর নিষেধাজ্ঞা তথা পাঁচ বছরের জন্য অডিট ও অ্যাসিউর‍্যান্স কার্যক্রমে অংশগ্রহণে কেন অযোগ্য ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে ব্যাখ্যা তলব করে শুনানি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। 

‎ঢাকা/এনটি/বকুল 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ৪ কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে অনিয়ম: ৭ অডিটর নিষিদ্ধ
  • সেপ্টেম্বরের ১৬ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২০ হাজার কোটি টাকা
  • বাংলাদেশ ব্যাংক এক দিনে ২৬ ব্যাংক থেকে ৩৫ কোটি ডলার কিনল কেন