পবিত্র ঈদ ও স্বাধীনতা দিবস সামনে রেখে যখন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিলেন, তখন ধারণা করা গিয়েছিল যে অপরাধের মাত্রা কমবে।
কিন্তু ঈদের দুই দিন আগে চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের হাতে দুই ব্যক্তির নিহত হওয়া এবং খুলনায় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষের ঘটনা আমাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, শনিবার রাতে খুলনার বানরগাতী আরামবাগ এলাকায় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে গিয়ে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় তিন পুলিশ, নৌবাহিনীর এক সদস্য এবং বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থল থেকে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ পলাশসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদিকে শনিবার দিবাগত রাত পৌনে তিনটার দিকে চট্টগ্রামের বাকলিয়া এক্সেস রোডে মোটরসাইকেলে আসা সন্ত্রাসীরা একটি প্রাইভেট কারে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে দুজনকে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, ১৫ মার্চ ‘সন্ত্রাসী’ সাজ্জাদকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়ার জের ধরেই এই হত্যাকাণ্ড হয়। কয়েক দিন আগে ঢাকায় ধানমন্ডির ৮ নম্বর সড়কে একদল সন্ত্রাসী র্যাবের পোশাক পরে ডাকাতি করে বিপুল পরিমাণ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। ২৩ মার্চ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আশুলিয়ায় অফিস শেষে বাসার উদ্দেশে রওনা হয়ে আর ফিরে আসেননি। পাঁচ দিন পর উত্তরা থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ঈদের সময় নিরাপত্তার বিষয়ে নাগরিকদের সচেতন থাকার কথা বলা হয়েছিল। যেখানে সন্ত্রাসীদের হাতে যৌথ বাহিনীর সদস্যরা আহত হন কিংবা কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ধরিয়ে দেওয়ার জেরে দুজন মানুষকে জীবন দিতে হয়, সেখানে জনগণ সজাগ থাকলেই নিরাপদ থাকবে, এ কথা ভাবার কারণ নেই।
খুলনা ও চট্টগ্রামের ঘটনায় শীর্ষ সন্ত্রাসী জড়িত থাকার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা যে তথ্যই দিন না কেন, গত সাড়ে সাত মাসে অপরাধের মাত্রা মোটেই কমেনি; বরং বেড়েছে। সংবাদমাধ্যমে অপরাধের খবর এলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে আগের সরকারের আমলের তুলনা দেওয়া হয়। আগের সরকারটি তো জবরদস্তিভাবে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে দেশ চালিয়েছে। সেই সরকারের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের তুলনা কোনোভাবে সমীচীন নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা স্তরে এত রদবদল, এত পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা হলো, তারপরও পরিস্থিতি উন্নয়নের কোনো লক্ষণ নেই।
গত বছর আগস্টের পটপরিবর্তনের পর অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গি নানা কায়দায় জেলখানা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তঁাদের বাইরে রেখে আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন কোনোভাবেই আশা করা যায় না। জেলে যাওয়ার আগে তাঁরা যে কাজ করেছেন, এখন সেটাই করছেন। অতএব অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণ খুঁজে বের না করে অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না, এটা হলফ করে বলা যায়।
আমরা আশা করব, বিলম্বে হলেও সরকার জেলপালানো শীর্ষ সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা দেখাবে। ঈদের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নজরদারি বাড়াবে। বিশেষ করে ঈদের জামাত ও অন্যান্য আয়োজনকে কেন্দ্র করে যাতে কেউ নাশকতা করতে না পারে, সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
অজ্ঞাতনামা লাশ আর কারা হেফাজতে মৃত্যু বেড়েছে, শৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকায় জনমনে সন্দেহ: এমএসএফ
চলতি অক্টোবর মাসে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশ এবং কারা হেফাজতে মৃত্যু সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় বেশ খানিকটা বেড়েছে। এ তথ্য তুলে ধরেছে মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। প্রতিষ্ঠানটির অক্টোবর মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এমএসএফ বলেছে, এসব ঘটনায় জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ দুই ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে জনমনে সন্দেহ আছে।
এমএসএফ প্রতি মাসে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরে। আজ শুক্রবার অক্টোবর মাসের প্রতিবেদন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নিজস্ব তথ্যানুসন্ধানের ওপর ভিত্তি করে এমএসএফ মানবাধিকার প্রতিবেদন তৈরি করে।
বেড়েছে অজ্ঞাতনামা লাশএমএসএফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবর মাসে মোট ৬৬টি অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিতই নয়; বরং নাগরিক জীবনে নিরাপত্তাহীনতার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মাসে (সেপ্টেম্বর) এর সংখ্যা ছিল ৫২। এসব অজ্ঞাতনামা লাশের বেশির ভাগই নদী বা ডোবায় ভাসমান, মহাসড়ক বা সড়কের পাশে, সেতুর নিচে, রেললাইনের পাশে, ফসলি জমিতে ও পরিত্যক্ত স্থানে পাওয়া যায়। অল্পসংখ্যক মৃতদেহ গলাকাটা, বস্তাবন্দী ও রক্তাক্ত বা শরীরে আঘাতের চিহ্নসংবলিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
এমএসএফ বলেছে, অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েই চলেছে এবং তা জনজীবনের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি জোরালোভাবে সবার সামনে প্রতিফলিত হচ্ছে। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় উদ্ধারে অপারগতায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১টি শিশু, ১ কিশোর, ১১ জন নারী ও ৫৩ জন পুরুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৭ বছর বয়সী শিশু; ১৫ বছর বয়সী কিশোর; ২০ থেকে ৩০ বয়সী ১৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী; ৩১ থেকে ৪০ বয়সী ১৯ জন পুরুষ ও ৬ জন নারী; ৪১ থেকে ৫০ বয়সী ১ নারী ও ৫ জন পুরুষ এবং ৫০ বছর বয়সের বেশি ১১ জন পুরুষ ও ১ নারী রয়েছেন। এর মধ্যে অজ্ঞাতনামা তিনজনের বয়স শনাক্ত করা যায়নি।
এমএসএফ বলেছে, শুধু অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না; বরং পরিচয় জানার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। পরিচয় উদ্ধার করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
কারা হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছেইএমএসএফের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে কারা হেফাজতে মোট ১৩ জন বন্দীর মৃত্যু হয়েছে। গত মাসে এ সংখ্যা ছিল মোট ৮। এ মাসে ছয়জন কয়েদি ও সাতজন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চারজন কয়েদি ও দুজন হাজতি, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন কয়েদি ও শেরপুর জেলা কারাগারে একজন কয়েদি মারা যান। এ ছাড়া খুলনা জেলা কারাগারে, টাঙ্গাইল জেলা কারাগারে, চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে, সিরাজগঞ্জ কারাগারে ও মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে একজন করে হাজতি বন্দী মারা যান। সব বন্দীর মৃত্যু হয় কারাগারের বাইরে হাসপাতালে।
এমএসএফের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কারা হেফাজতে মৃত্যু এবং অজ্ঞাতনামা লাশ উদ্ধারের সংখ্যা বৃদ্ধি মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতির চিত্র তুলে ধরে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই লাশ উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হচ্ছে। কিন্তু এসব লাশ উদ্ধার করে তার পরিচয় শনাক্ত করা এবং সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করে মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করাই শুধু নয়, এসব লাশ আত্মীয়-পরিজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া এসব বাহিনীর কাজ। কিন্তু একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু মামলা করা ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর কোনো কাজ নেই।
সাইদুর রহমান বলেন, অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং হেফাজতে মৃত্যু বৃদ্ধি জনমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
গণপিটুনিতে হত্যা চলছেই, বেড়েছে রাজনৈতিক সহিংসতাঅক্টোবর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার শিকার হয়েছেন ৫৪৯ জন। এর মধ্যে ২ জন নিহত এবং ৫৪৭ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন গুলিবিদ্ধ এবং নিহত ব্যক্তিরা বিএনপির কর্মী–সমর্থক। সেপ্টেম্বর মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৩৮টি ঘটনা ঘটেছিল।
সহিংসতার ৪৯টি ঘটনার মধ্যে ১১টি ঘটনায় রাজনৈতিক বিরোধ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে পার্টি অফিস, বসতবাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিকাণ্ড এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তবে এসব ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
অক্টোবর মাসে মোট গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে ৪৪টি। আগের মাসে এ ঘটনা ঘটেছিল ৪৩টি। এ মাসে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১২। আগের মাসে নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন।