ভোট দেওয়ার ন্যূনতম বয়স দীর্ঘ সময় ধরে ১৮ থাকলেও সম্প্রতি এটি কমানোর কথা উঠছে। এ বছরের জানুয়ারিতে প্রধান উপদেষ্টা যখন এটি ১৭ বছর করা উচিত বলে মন্তব্য করেন, তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সম্প্রতি ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করার প্রস্তাব করেছে। একই সঙ্গে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম বয়স ২৫ থেকে কমিয়ে ২৩ করারও প্রস্তাব দিয়েছে এনসিপি। দলটির যুক্তি, ভোটার হওয়ার বয়স কমালে গণঅভ্যুত্থান প্রধানত যাদের ভূমিকায় সফল হয়েছে, ভোটের মাঠেও সেই জেন-জিদের অংশগ্রহণ থাকবে।

এটা সত্য যে, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ভোট দেওয়ার প্রাথমিক বয়স ১৮ বছর। তবে ১৭ বছর, এমনকি কোথাও ১৬ বছর বয়সেও ভোট দেওয়া যায়। লাতিন আমেরিকা, অস্ট্রিয়া এমনকি জার্মানিতেও ১৬ বছর বয়সে নাগরিকরা ভোট দিয়ে থাকে। তবে বাংলাদেশে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, দুই বছর না কমিয়ে ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ করা যেতে পারে। এতেও গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ চলে আসবে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে যাদের বয়স ১৬ বছর ছিল, তারা তো বটেই, এমনকি যাদের ১৫ বছর পাঁচ-ছয় মাস ছিল; ডিসেম্বরে বা এর পর নির্বাচন হলে ১৭ বছর বয়সে তারাও ভোট দিতে পারবে। অবশ্য তাদের ভোটার করতে হলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নতুন করে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার প্রয়োজন হবে। আমরা জানি, জানুয়ারিতে এ তালিকা ইতোমধ্যে হালনাগাদ করা হয়েছে ১৮ বছর হিসাব করেই।

ভোটের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ করেন। এ মত দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির বয়স ও পরিপক্বতা গুরুত্বপূর্ণ। ভোট দেওয়ার জন্য ১৮ বছর বয়স নির্ধারণের যুক্তি হলো, এ বয়সে মানুষের বিচার-বুদ্ধির ক্ষমতা থাকে। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এখানে শিক্ষাও জরুরি বিষয়। ঝরে না পড়লে ১৮ বছরের মধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনা শেষ হয়ে যায়। যেসব যুক্তিতে ভোটার হওয়ার বয়স ১৮ করা হয়েছে, সেই যুক্তিতে এখন তা ১৭ বছর করা যেতে পারে। অর্থাৎ আগে ১৮ বছরে ব্যক্তির মধ্যে নানা কারণে যে পরিপক্বতা আসত; এখন ১৭ বছরেই তা সম্ভব হচ্ছে। ইন্টারনেট-প্রযুক্তির কারণে ব্যক্তির চোখ-কান আগেই খুলে যায়। পারিপার্শ্বিকতা ও  শিক্ষার হার বৃদ্ধির ফলে ১৬-১৭ বছরেই ব্যক্তির মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা জন্মে। সে জন্য ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ বছর করা যেতেই পারে। ১৭ বছর হলে কী প্রভাব পড়তে পারে আগামী নির্বাচনে? ভোটার বাড়তে পারে ৫ শতাংশ। তাতে অর্ধকোটি নতুন ভোটার যুক্ত হবে। খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশের ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৬ লাখ। দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ বলে এক বছর কমালেই তা বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে। সর্বশেষ ২০২৩ সালে যে জনশুমারি হয়েছিল, তাতে দেখা যায়, মোট জনসংখ্যার ৫৭ শতাংশই তরুণ। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীর সংখ্যা বেশি। তবে এই বয়স ১৭ করার ক্ষেত্রে সামান্য যে জটিলতা আছে, তার সমাধান আগে করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে শিশুর সর্বোচ্চ বয়স ধরা হয় ১৮ বছর। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ীও ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। শিশুর এ বয়স কমাতে হবে। ২০২২ সাল থেকেই শিশুর বয়স কমানোর পরিকল্পনা চলছে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক কমিটি এ বয়স কমানোর প্রস্তাব দিয়েছিল। তাদের যুক্তি ছিল, ১৪-১৫ বছরেই অনেককে গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। তার মানে, ১৮ পর্যন্ত সবাই শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিংবা অপরিপক্ব থাকছে না। অবশ্য বিতর্কের মুখে সে প্রস্তাব তখন গৃহীত হয়নি।

ভোটারের বয়স নির্ধারণ যেহেতু নির্বাচন-সংক্রান্ত কাজ, সেহেতু নির্বাচন কমিশনই এ সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। জানুয়ারিতে এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর যে আলোচনা হয়েছে, তাতে দেখা গেছে, বিএনপি বয়স কমানোর বিষয়টি নাকচ করেছে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত সংস্কার কমিশন অবশ্য ভোট দেওয়ার বয়স কমানোর সুপারিশ করেনি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বয়স ন্যূনতম ২১ বছর করার সুপারিশ করলে বিএনপি তা ২৫ বছরেই রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টি ২৩ বছর করার পরামর্শ দিয়েছে।

বাস্তবতার আলোকে এবং সময়ের প্রয়োজনে পরিবর্তনই প্রকৃতির নিয়ম। ভোট দেওয়ার বয়স ন্যূনতম ১৮ বছর সাধারণ নিয়ম দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু এখানেও সংস্কার আসতে পারে। পরিবর্তন আসতে পারে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বয়সেও। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে বলে তা-ই আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে– এমন নয়। আমাদের তরুণরা অল্প বয়সেও অনেক সাফল্য এনেছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের গল্পও তারুণ্যের। তারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের বিষয়টিও রাষ্ট্রীয়ভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি।

মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.

manik@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ ট র র বয়স ভ ট র হওয় র বয়স গণঅভ য ত থ ন বছর বয়স প রস ত ব র বয়স ও র বয়স ন র র বয়স ন য নতম ১৭ বছর ১৮ বছর বছর কর বছর ক বছর ব বছর ই

এছাড়াও পড়ুন:

কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 

বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না।  মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন  করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও  এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?

ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো।  বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে। 

আরো পড়ুন:

রাশিয়ার ‍বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ

রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা 

রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে। 
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত। 

জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। 

বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই। 

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।  

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের কাজ কি শুধু ভাইভা নেওয়া
  • কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-গ্রামবাসীতে বিদ্বেষ কেন
  • চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি দাঙ্গা–ফ্যাসাদকেই নীতি হিসেবে নিয়েছেন