কুড়িগ্রাম জেলার প্রতি অবহেলার বিষয়টি নতুন নয়। জেলা হিসেবে বরাদ্দ থেকে শুরু করে সরকারি প্রকল্পের পরিকল্পনা ও অনুমোদনে বরাবরই কুড়িগ্রামের নাম থাকে পিছিয়ে। প্রান্তিক জেলা হিসেবে স্বাস্থ্যসেবায়ও নানা সংকট বিরাজমান। যেমন জেলাটির উলিপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি অকেজো হয়ে আছে। নেই প্রয়োজনীয় জনবলও। পাঁচ লক্ষাধিক বাসিন্দার জন্য মাত্র ৫০ শয্যার হাসপাতালটির এ করুণ অবস্থা হলে কীভাবে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হবে?
প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, উলিপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার মানুষের ভরসার স্থান ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। কিন্তু হাসপাতালটির পাঁচটি ইসিজি যন্ত্রের চারটি বিকল হয়ে পড়ে আছে। একমাত্র সচল পুরোনো ইসিজি যন্ত্রটি জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে। ডিজিটাল আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রটির প্রিন্টার নষ্ট। জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসকেরা আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট কম্পিউটারে দেখে রোগনির্ণয় করছেন। প্রিন্ট রিপোর্ট না পাওয়ায় সেটির কার্যকারিতা নিয়ে রোগীদের প্রশ্ন রয়েছে। এক বছরের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে সার্জারি চিকিৎসক না থাকায় সব ধরনের অপারেশন কার্যক্রমও বন্ধ।
সরকারি হাসপাতালটিতে চিকিৎসা কর্মকর্তা থাকার কথা ১৬ জন; কিন্তু আছেন মাত্র ৩ জন। ১০ জন জুনিয়র কনসালট্যান্টের বিপরীতে আছেন একজন। গাইনি, শিশু ও মেডিসিন, নাক, কান ও গলাবিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই একজনও। এ ছাড়া ল্যাব টেকনিশিয়ানের তিনটি, অফিস সহায়কের পাঁচটি পদ ফাঁকা। তিনজন ওয়ার্ড বয়ের বিপরীতে আছেন একজন। হাসপাতালে দুজন আয়া থাকার কথা থাকলেও একজনও নেই।
এত সমস্যা ও সংকট নিয়ে হাসপাতালটি কীভাবে রোগীর চিকিৎসাসেবা দেবে? ফলে সেবা নিতে আসা রোগীদের অনেকেই পরীক্ষার যন্ত্র না থাকায় ফিরে যাচ্ছেন। চিকিৎসক না থাকায় ধরনা দিচ্ছেন বাইরের প্রাইভেট চিকিৎসকের কাছে। ফলে চিকিৎসার পেছনে বাড়তি খরচ পড়ছে রোগীদের। এতে ভোগান্তি বাড়ছে গরিব বা নিম্ন আয়ের মানুষের। সামর্থ্য না থাকায় অনেকে হাসপাতালেই পড়ে থাকেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার বক্তব্য, দৈনিক বহির্বিভাগে ২৫০ থেকে ৩০০ জন এবং অন্তর্বিভাগে প্রায় ৫০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এত সংকট নিয়ে বিপুল জনসংখ্যার সেবায় নিয়োজিত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ছয় মাস আগে ইসিজি যন্ত্র মেরামতের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এখনো কোনো খবর নেই।
আমরা আশা করব হাসপাতালটির সমস্যাগুলো দ্রুত নিরসন করা হবে। যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসক ছাড়া এভাবে একটি হাসপাতাল চলতে পারে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার দিকে জোর দিন, বাড়তি মনোযোগ দিন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ক ৎসক
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ