অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা গুছিয়ে চলতে শুরু করেছে বললে ভুল হবে না। আট মাস অতিক্রান্ত; এর মধ্যে গুছিয়ে ওঠা স্বাভাবিকও। সময় বরং বেশি নিয়ে ফেলেছে। এই সরকারের অবশ্য নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। ড. ইউনূস শুরুতে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক আলোচনা’তেই স্থির হবে, কতদিন তারা থাকবেন। এর মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের এক ধরনের রোডম্যাপও দিয়েছেন তিনি। সে অনুযায়ী আগামী বছর জুনের পর কোনোভাবেই এ সরকারের থাকার কথা নয়। ইতোমধ্যে অবশ্য চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বেশি করে সামনে এসেছে। পাশাপাশি সরকার প্রশাসনকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছে বলেও প্রতীয়মান। 

সরকারের গুছিয়ে চলার একটা প্রমাণ– গেল রমজান ও ঈদ ভালোভাবে ‘ম্যানেজ’ করতে পারা। নিত্যপণ্যের দাম থেকে ঈদযাত্রা– সবখানেই পারফরম্যান্স ভালো। ঈদের আগ দিয়ে রেমিট্যান্স প্রাপ্তি উঠেছে নতুন উচ্চতায়। তাতে গ্রামাঞ্চল এবার ছিল বেশি উৎসবমুখর। ঈদের পর ক’দিন আমিও একটি ‘রেমিট্যান্স পল্লি’ দেখেছিলাম। দেখেছি, রমজানে পণ্যবাজার সহনীয় থাকা নিয়ে মানুষজন সন্তুষ্ট। প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিবর্তনে অখুশি ভারতকে মোকাবিলায় তাঁর সরকারের ভূমিকাসহ বিভিন্ন কাজ নিয়ে মানুষের প্রশংসাই দেখলাম বেশি। সেখানকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মন্দ নয়। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে অপরাধ বাড়ার খবরে তারা একই সঙ্গে বিচলিত। এ অবস্থায় নির্বাচিত সরকার এলে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে বলে দু-তিনজন মত দিলেন। তাদের একজন আবার বললেন ‘ইউনূস সরকার’কে দীর্ঘদিন রেখে দেওয়ার কথা! 

ঈদের আগ দিয়ে এমন আলাপ কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনেও তোলা হয়েছে। হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী জটিল পরিস্থিতিতে ড.

ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সময়ও কথাটি ভেসে বেড়াচ্ছিল। তার কারণ, এর আগে এক-এগারোর সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব গেলে তিনি নাকি এই বলে সেটা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন– অল্প সময়ে শুধু একটা নির্বাচন আয়োজনে তিনি অনাগ্রহী। মানুষ তাই ধরে নেয়, এবার নিশ্চয় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার শর্তেই তিনি রাজি হয়েছেন। নির্বাচনের আগে ক্ষমতাচ্যুতদের বিচারের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি সামনে আসায় এ ধারণা আরও জোরালো হয়। তবে মাঠে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘দ্রুত নির্বাচন’ করে গণতন্ত্রে উত্তরণের দাবিতে শুরু থেকেই সোচ্চার। শুরু থেকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাহিল হওয়ার কারণেও দ্রুত নির্বাচন করে ইউনূস সরকারের সহজ প্রস্থানের পক্ষে জনমত ক্রমে জোরালো হয়েছে। এর পক্ষে ‘আন্তর্জাতিক প্রত্যাশা’ও দৃশ্যমান। এ অবস্থাতেই প্রধান উপদেষ্টাকে জানাতে হয়েছিল, সর্বোচ্চ কত দিন তারা ক্ষমতায় থাকবেন। সংস্কার বিষয়ে তাদের পরিকল্পনাও স্পষ্ট করতে হয়। 

ঈদের ছুটির পর সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপ আবার শুরু হওয়ার কথা। নির্দিষ্ট সময়ে এ প্রক্রিয়া শেষ করে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘জুলাই চার্টার’ প্রকাশের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কতখানি সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করবে আর কতখানি নির্বাচিত সরকার– সেটাও এরই মধ্যে স্থির হবে। ‘অধিকতর সংস্কার’ করতে না হলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন– এটাও ড. ইউনূসের ঘোষণা। নভেম্বর-ডিসেম্বর নির্বাচনের উপযুক্ত সময় বটে; যদিও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় জুনে ইতোপূর্বে নির্বাচন হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তীকালে তেমন বাধ্যবাধকতা না থাকলেও নির্বাচন বেশি দূরে ঠেলে দেওয়ার সুযোগ নেই। ১৮ মাসের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারকে সহায়তা জুগিয়ে ব্যারাকে ফিরতে চায় সেনাবাহিনী– এটাও বাস্তবতা। উন্নয়ন সহযোগীরাও সুনির্দিষ্ট মেয়াদের জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার চাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরাও চান সুস্পষ্ট নীতিগত নির্দেশনা, যা আসতে পারে নির্বাচিত সরকার থেকেই। কর্মসংস্থান ও আয় পরিস্থিতি খারাপ– এটা অন্তর্বর্তী সরকারও গোপন করছে না। রমজান ও ঈদে ‘চাহিদার চাপ’ কম থাকাতেও পরিস্থিতি ইতিবাচক ছিল বলে মত রয়েছে। 

সন্দেহ নেই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সরকার আন্তরিক। সময় লাগলেও মনোবলহীন পুলিশকে তারা সক্রিয় করে তুলেছে। সেনাসদস্যরাও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোয় সক্রিয়। ‘মব ভায়োলেন্স’ কমে এসেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সরকার স্বাভাবিক রাখতে পেরেছে এ পর্যন্ত। কৃষি উৎপাদনে সংকট দৃশ্যমান নয়। ‘অতি উৎপাদনের সংকট’ বরং কিছু ক্ষেত্রে দৃশ্যমান। সংকটগ্রস্ত ব্যাংকগুলো রক্ষায় সচেষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংক। আইএমএফ মিশন এসেছে প্রতিশ্রুত ঋণের কিস্তি ছাড়ের আগে শর্ত বাস্তবায়ন পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে। 
চীনে আলোচিত সফরের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রত্যাশিত বৈঠকও হয়ে গেছে প্রধান উপদেষ্টার। তাতে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা সহজ হওয়ার আশা দু’দিক থেকেই বেড়েছে। আমেরিকার ‘পাল্টা শুল্কনীতি’তে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকলেও এটা প্রতিযোগী দেশগুলোর ক্ষেত্রেও কমবেশি প্রযোজ্য। প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন সহকর্মীদের সঙ্গে। এসব মিলিয়ে সরকারের মধ্যে গুছিয়ে ওঠার পাশাপাশি তৎপর হওয়ার প্রবণতা স্পষ্ট। তার কঠোর সমর্থকরাও এতে উজ্জীবিত। এ অবস্থায় তাদের ভেতর থেকেই উঠেছে ইউনূস সরকারকে দীর্ঘদিন রেখে দিয়ে দেশ পুনর্গঠনের দাবি। 

‘দীর্ঘদিন’ মানে কতদিন? আগামী বছরের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকারের দু’বছর পূর্ণ হবে। এর আগে এক-এগারোর সরকার প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় ছিল। সেই সময় অতিক্রম করেও ইউনূস সরকারকে রেখে দেওয়ার দাবি কোনো কোনো মহল থেকে উঠছে। তাদের মত, বিচারসহ ‘প্রয়োজনীয় সব সংস্কার’ সেরে নির্বাচন দিয়ে তবেই বিদায় নিক সরকার। তাতে একটা ‘কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ’ মিলবে। প্রধান উপদেষ্টার তরফ থেকে এ বিষয়ে স্বভাবতই কোনো বক্তব্য মেলেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ সময়সীমা থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ কি রয়েছে? নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা যাচাই এবং জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার বিকল্পও কি আছে– এসব প্রশ্ন নতুন করে সামনে আসার কথা নয়। কিন্তু মহলবিশেষের কারণে এসব বিষয়ে নতুন করে আলোচনায় যেতে হচ্ছে অনিচ্ছুকদের। ইসি অবশ্য ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে নিয়েই গ্রহণ করছে তার প্রস্তুতি। সংস্কার আলোচনাও চলমান। বিচার প্রক্রিয়ায় গতি সঞ্চারের দাবি বাড়ছে। এর কোনোটাই তো নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কথা নয়। 
শেষ কথা, জনগণই দেশের মালিক ও গণতন্ত্রের রক্ষক। নির্বাচনসহ সব গণতান্ত্রিক অধিকারই তার প্রাপ্য। তবে সবকিছু একযোগে অর্জনের চেষ্টায় সব ভণ্ডুল হওয়ার শঙ্কাতেও জনগণ নিশ্চয় থাকতে চাইবে না। একটা নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে ইউনূস সরকার কিছু ব্যতিক্রমী কাজে তার ‘পদচ্ছাপ’ রেখে যাচ্ছে, সন্দেহ নেই। এ অবস্থায় অধিকতর সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্য হলে ২০২৬ সালের মধ্যভাগ পর্যন্তও সময় নেওয়া যেতে পারে। নির্বাচন ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কারে স্পষ্ট কিছু অগ্রগতি হলেও সেটা কম প্রাপ্তি হবে না। অবশিষ্ট সংস্কার সাধনে জনগণের লড়াইও থাকবে অব্যাহত। গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজ তো দু-চার বছরে শেষ হওয়ার নয়। রক্তক্ষয়ী আন্দোলন আর সংস্কারের মাধ্যমে অর্জন করা গেলেও সেটি রক্ষার কাজে কিন্তু বিরাম নেই। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় রাজনৈতিক পশ্চাদপসরণও কি আমরা দেখি না? তাদেরও নতুন করে কি দাঁড়াতে হচ্ছে না গণতন্ত্রের সপক্ষে? 

হাসান মামুন: সাংবাদিক, কলামিস্ট

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ইউন স সরক র পর স থ ত ড স ম বর র জন ত ক সরক র র সরক র ক এ অবস থ ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তর্বর্তী সরকার না চাইলে ‘মব সন্ত্রাসের’ ঘটনাগুলো ঘটতে পারত না: বাম গণতান্ত্রিক জোট

গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে যে ‘মব’ সন্ত্রাসের শুরু হয়েছিল, সেটা এখনো চলছে এবং নগ্ন রূপ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। অন্তর্বর্তী সরকার না চাইলে এমন ঘটনাগুলো ঘটতে পারত না বলেও মন্তব্য করেছেন তাঁরা। জোটের নেতারা বলেছেন, মব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাব এমন যে খারাপ কিছু তো করছে না।

আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা এ কথা বলেন। মব সন্ত্রাস ও মাজার-খানকায় হামলা বন্ধসহ সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যথাসময়ে নির্বাচনের দাবিতে এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বাম জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর যে মব শুরু হয়েছিল, সেই মব এখনো দূর হয়নি। বরং নগ্ন রূপ নিয়েছে।...তাহলে ইউনূস সাহেব (প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস) তখন কী করলেন?’

সরকার না চাইলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না মন্তব্য করে রুহিন হোসেন বলেন, মব নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা আকারে-ইঙ্গিতে যা বলেন, তাতে ভাবটা এ রকম যে খারাপ কিছু করছে না। অন্তর্বর্তী সরকার এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারবে না।

দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংস্কারের নামে শ্রমিক–কৃষক–মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষা করছেন না, কিন্তু সংবিধানের চার মূলনীতি পরিবর্তন করতে চান। অবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

‘মব’ সন্ত্রাস ও মাজার-খানকায় হামলা বন্ধসহ সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যথাসময়ে নির্বাচনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতা–কর্মীরা। আজ সোমবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সংগীতশিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি বাতিলের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়: আসক
  • রাকসু নির্বাচন: ৬ দফা দাবিতে ছাত্রদলের স্মারকলিপি
  • অন্তর্বর্তী সরকার না চাইলে ‘মব সন্ত্রাসের’ ঘটনাগুলো ঘটতে পারত না: বাম গণতান্ত্রিক জোট