শনিবার রংপুরে আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বিচার বিভাগ পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে।’ তাঁর এ মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। পৃথক সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হলে সেটি আমাদের জন্য একটি ‘মাইলফলক’ হবে।
প্রধান বিচারপতি বলেছেন, ‘পৃথক সচিবালয় বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। প্রস্তাবিত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় বিচারিক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে।’ পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এ রকম আরও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হবে, সেটা অনেকেরই প্রত্যাশা।
রুলস অব বিজনেস অনুসারে, বিচার–কর্ম বিভাগসংক্রান্ত কাজগুলো প্রধানত সরকারের আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় সম্পাদন করে থাকে। আর কিছু অংশ করে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি, যা কেবল সুপ্রিম কোর্টের দাপ্তরিক কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ফলে বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগ তথা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ থেকেই যায়।
স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকার পৃথক সচিবালয় স্থাপনের বদলে বিচার-কর্ম বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক বিষয়গুলো সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন বা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে; এমনকি মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরও এ বিষয়ে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসেনি। একাধিক সাবেক প্রধান বিচারপতি বিচার-কর্ম বিভাগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন, এমনকি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনও করেছেন। কিন্তু তাঁরা সফল হননি ক্ষমতাসীনদের অনাগ্রহ ও অসহযোগিতার কারণে।
অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য কমিশনের পাশাপাশি বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে বিচার বিভাগ সংস্কারেও একটি কমিশন গঠন করে। গত ৩১ জানুয়ারি সরকারের কাছে জমা দেওয়া কমিশনের প্রতিবেদনেও সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য আইন বা অধ্যাদেশ জারির সুপারিশ করা হয়েছে।
‘অ্যালোকেশন অব বিজনেসে’ বিচার বিভাগের পৃথক্করণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করাসংক্রান্ত বিষয়গুলো সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়ের ওপর অর্পণ করতে হবে। বিচার-কর্ম বিভাগ ও বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালন করা ম্যাজিস্ট্রেটদের আর্থিক বিষয়াবলিকে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৮৮(চ) অনুসারে ‘সংযুক্ত তহবিল’–এর ওপর দায়যুক্ত বলে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়।
১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এটিকে পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের অধীনে নিয়ে নেওয়া হয়। সে সময় যাঁরা চতুর্থ সংশোধনীর কঠোর সমালোচনা করেছেন, তাঁরাও ক্ষমতায় এসে পুরোনো পথে হেঁটেছেন।
মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ১২ নম্বর নির্দেশনা অনুসারে বিচার বিভাগের বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো রকম কর্তৃত্ব থাকতে পারবে না। এতে বিচার বিভাগের বাজেটের প্রাক্কলন বিচার বিভাগ নিজেই প্রস্তুত করার, প্রাক্কলন অনুসারে সরকার বিচার বিভাগের জন্য তহবিল বরাদ্দ দেওয়া এবং তা ব্যয়ে সরকারের খবরদারি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি আশাবাদ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা কখনো ক্ষমতার পূর্ণ পৃথক্করণের লক্ষ্যের এতটা কাছাকাছি আসিনি। যদি এই সুযোগ কোনোভাবে নষ্ট হয়, তবে তা বিচার বিভাগের মর্যাদা, অখণ্ডতা এবং প্রাসঙ্গিকতার জন্য চরম ক্ষতিকর হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের পৃথক সচিবালয় আলাদা কোনো বিষয় নয়; এটি বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করার একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। প্রধান বিচারপতির অভিপ্রায় অনুযায়ী যাতে অবিলম্বে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার অবিলম্বে আইনি ব্যবস্থা নেবে আশা করি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব চ র কর ম ব ভ গ ন শ চ ত কর স ব ধ নত সরক র র র জন য অন স র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্তাবিত রাজস্ব নীতি বিভাগে সচিব হিসেবে শুল্ক ও কর কর্মকর্তা পদায়নের দাবি
উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদিত রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশের চূড়ান্ত খসড়ার কিছু অংশে আপত্তি জানিয়ে মতামত দিয়েছে ঢাকার বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন। প্রস্তাবিত রাজস্ব নীতি বিভাগে লোকবল নিয়োগের শর্ত নিয়ে তাদের এই আপত্তি। গতকাল রোববার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তারা এই আপত্তি জানিয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটি সাতটি বিষয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, ১৭ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদের সভায় রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর চূড়ান্ত খসড়া অনুমোদিত হয়।
গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন অধ্যাদেশের যেসব বিষয়ে নিজেদের মতামত দিয়েছে, সেগুলো হলো—এক, বিসিএস (কর) অ্যাসোসিয়েশন ও বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য হতে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব নিয়োগের মতামত প্রদান করেছিল। কিন্তু খসড়ার অনুচ্ছেদে (৪২৩) ‘উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন যে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে’ রাজস্ব নীতি বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব নিযুক্ত করার বিধান রাখা হয়েছে। এতে রাজস্ব নীতি প্রণয়নে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যক্ষভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতাকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি মর্মে প্রতীয়মান। রাজস্ব নীতি প্রণয়নে কর রাজস্ব আহরণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে রাজস্ব নীতি বিভাগের শীর্ষ পদে পদায়ন করা হলে রাজস্ব বিভাগকে পৃথক করার মূল উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হবে।
দুই, রাজস্ব নীতি বিভাগের মৌলিক পদগুলো বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ও বিসিএস (কর) ক্যাডার থেকে পূরণের প্রস্তাব করা হলেও খসড়ায় আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, গবেষণা পরিসংখ্যান, প্রশাসন, নিরীক্ষা, আইনসংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তা থেকে পূরণের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। রাজস্ব আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের রাজস্ব নীতি বিভাগে সুনির্দিষ্টভাবে পদায়নের সুযোগ রাখা হয়নি।
তিন, খসড়ার অনুচ্ছেদ ৯-এ রাজস্ব নীতি বিভাগে জনবল পদায়নের সুপারিশের লক্ষ্যে একটি কমিটির কথা উল্লেখ থাকলেও ধারা ৪(৪)–এ এমন কোনো কমিটির উল্লেখ নেই। উক্ত কমিটির গঠন উল্লেখ করা প্রয়োজন।
চার, খসড়ায় রাজস্ব নীতি বিভাগের কার্যপরিধিতে কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ যুক্ত করা হয়েছে। এ বিধান রাখায় নীতি বিভাগকে ব্যবস্থাপনা বিভাগের কার্যক্রম তদারকির সুযোগ থেকে যায়। এক বিভাগের কার্যক্রম সমমর্যাদাসম্পন্ন অপর বিভাগ কর্তৃক পরিবীক্ষণের বিধান রাখা হলে তা আইনের দৃষ্টিতেও সাংঘর্ষিক বিবেচিত হয়।
পাঁচ, খসড়ার অনুচ্ছেদ ৭(৩)–এ বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থেকে রাজস্ব আহরণে ন্যূনতম ২০ বছরের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাকে পালাক্রমে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সিনিয়র সচিব বা সচিব হিসেবে নিয়োগ প্রদান—এই ধারা পরিবর্তনে রাজস্ব আহরণে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব বা সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদানের বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এতে কর-রাজস্ব আহরণে দীর্ঘদিনের অর্জিত বিশেষায়িত জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ সীমিত করবে।
ছয়, খসড়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রশাসনিক পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে পদায়ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তারা পদস্থ রয়েছেন, যা তাঁদের নির্ধারিত পদ।
সাত, সরকার গঠিত রাজস্ব সংস্কারবিষয়ক পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন অন্য সংস্কার কমিশনের মতো জনসমক্ষে প্রকাশ করা সমীচীন বলে বিসিএস (কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট) অ্যাসোসিয়েশন মনে করে।
এর আগে ২৬ এপ্রিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাল্টিপারপাস হলে বিসিএস কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অ্যাসোসিয়েশনের বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) অনুষ্ঠিত হয়। অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে সভায় সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাট অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাকাএভ) নির্বাহী কমিটির একটি প্রতিনিধিদল উপস্থিত ছিল।