মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী উত্থানের শঙ্কা নিয়ে ১ এপ্রিল প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যেসব নারী শিক্ষার্থী পথে নেমেছিলেন, তাদের জন্য মৌলবাদীদের এই বিশেষ উত্থান বিশেষভাবে বেদনাদায়ক। তারা তাঁর একদলীয় শাসনের পরিবর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ, গণতান্ত্রিক ও উন্মুক্ত পরিবেশ প্রতিষ্ঠা হবে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু তাদের এখন ধর্মীয় জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে।’ 

অন্তর্বর্তী সরকার তো বটেই, বিএনপি নেতৃবৃন্দ এই প্রতিবেদন খারিজ করে বলেছেন, একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি ও ভুল চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে (সমকাল, ৩ এপ্রিল, ২০২৫)। সরকার বা বিএনপি নেতৃবৃন্দ যা-ই বলুন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে ঘটে যাওয়া একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বা ‘উদ্দেশ্যমূলক’ আখ্যা দেবার উপায় নাই। হিন্দুসহ আহমদিয়া মুসলমানদের বাড়িঘর ভাঙচুর এবং দেশজুড়ে মাজার, মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনা, ভাস্কর্যের লাগাতার ভাঙচুরের ঘটনা আকস্মিক হতে পারে না। এসব ঘটনা নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া যেমন অতিরঞ্জন ও মিথ্যাচার করেছে; অন্যদিকে আমাদের সরকারও পূর্বাপর নির্বিকার থেকেছে। হামলা ও ভাঙচুরের জন্য দায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সরকারের দায়িত্ব; এ দায়িত্ব পালনে সরকারের আগ্রহে ঘাটতি দেখতে পেয়েছি।
৫ আগস্ট একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানুষের মহাবিস্ফোরণের পর কয়েক দিন দেশে সরকারই ছিল না; পুলিশ বাহিনী বিপর্যস্ত ও ভঙ্গুর; এর মধ্যে সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে পরিচালনা নিশ্চয়ই দুঃসাধ্য– এই যুক্তি মেনে নিয়েও বলতে হয়, সমাজের ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল শক্তির প্রতি সরকারের কোনো কোনো অংশের প্রশ্রয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুরাগ ও উৎসাহ কেবল উদ্বিগ্নই করে না; একই সঙ্গে এসবের পেছনে ক্রিয়াশীল মতবাদ ও উদ্দেশ্য অবশ্যই নানা প্রশ্ন ও সংশয় তৈরি করে। 

২.


শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রে দেশে সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের ন্যূনতম চর্চাও অবশিষ্ট ছিল না। এই সুযোগে সমাজে যুক্তিহীন আধিপত্যবাদ ও হিংস্রতার অবাধ চর্চা হয়েছে, তার ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নির্বিচার আক্রমণও চলে। বিরোধী পক্ষকে ‘জামায়াত-শিবির’ ট্যাগ দিয়ে কোণঠাসা করবার প্রবণতায় উগ্রবাদী রাজনীতি আরও ঘন হওয়ার সুযোগ করে নেয়। দশকের পর দশক এ দেশ থেকে হিন্দুদের ভিটাবাড়ি কেড়ে নিয়ে দেশছাড়া করবার যে রাজনৈতিক-সামাজিক প্রবণতা, তা থেকে মুক্ত থাকেনি ক্ষমতাসীন কোনো দলই। সংখ্যালঘুদের ভিটেমাটি ক্ষমতাসীনদের অভয়াশ্রম– 
এ ধরনের আচরণ হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমাগতভাবে হ্রাস করেছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পরপর আমরা সেই চিত্রের পুনর্দৃশ্যায়ন দেখি। এটি যেমন দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য, তেমনি অগ্রহণযোগ্য নারীর প্রতি অযৌক্তিক আচরণের পুনরাবৃত্তি। নারীর পোশাক, তার হাঁটাচলা, জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গকে আতশ কাচের নিচে নিয়ে ওয়াজ মাহফিলে নানা মতামত যেমন চলে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে ঘরে-বাইরে নারীর প্রতি নির্বিচার নির্যাতন। নারী ও শিশু ধর্ষণ যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গবেষণা জানিয়েছে, গত দশ বছরে দেশে অন্তত ৫ হাজার ৬০০ শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণসহ নারীর প্রতি অত্যাচারের হিসাব মেলানো যত কঠিন, তার চেয়েও কঠিন বুঝে ওঠা, গণঅভ্যুত্থানজয়ী একটি জাতির সামনে কোন উপায়ে বা কেন এক দল মানুষ নারীর জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণে উৎসাহী? এই প্রশ্রয় তারা কেন পায়?
কোটি কোটি নারীর দিনরাত্রির শ্রমে তিলে তিলে গড়ে ওঠা দেশের সমৃদ্ধির ওপর দাঁড়িয়ে কারা নারীর বন্দিত্বের কথা বলে? এই নিয়ে সামাজিক ন্যূনতম প্রতিরোধের কথা আমরা সরকারের পক্ষ থেকে শুনি না। আমরা শুনি না নিগৃহীত আদিবাসীর পক্ষে সরকারের সুস্পষ্ট অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধের গবেষণা, ম্যুরাল, ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে সরকারের ভঙ্গি দেখে মনে হয়, তাদের কোনো আগ্রহ নেই এসবে। যেন মুক্তিযুদ্ধ অন্য দেশের সম্পদ। কেন?

৩.
‘গাছের একটি পাতাও ছেঁড়া যাবে না’ মর্মে আদিবাসী লেখা গ্রাফিতি স্থান পায় স্কুল পাঠ্যবইয়ে। উগ্রবাদীদের আপত্তিতে পাঠ্যবই থেকে সেই গ্রাফিতি বাদ দেওয়া হয়েছে। বস্তুত ‘আদিবাসী’ ধারণাতেই একমত হতে পারছে না সরকারের একটি পক্ষ। গত জানুয়ারিতে এনসিটিবিতে যাওয়ার পথে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মিছিলে নিষ্ঠুর হামলায় অনেকে গুরুতর আহত হন। সচিবালয়ের পাশের এই ঘটনায় সরকারের ন্যূনতম তৎপরতাও চোখে পড়েনি। অথচ আসছে পহেলা বৈশাখে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রায় আদিবাসীদের অংশগ্রহণ নিয়ে সংস্কৃতি উপদেষ্টার সরব তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। জানা গেছে, এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার অগ্রভাগে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা যার যার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে হাজির থাকবেন।
মাননীয় সংস্কৃতি উপদেষ্টা, এ দেশের আদিবাসীরা আবহমান কাল ধরে বৈসাবির বর্ণাঢ্য আয়োজনে পহেলা বৈশাখ নিজেদের মতো উদযাপন করে আসছে। তাদেরকে সেখান থেকে তুলে এনে নাগরিক মঙ্গল শোভাযাত্রায় যুক্ত করার আদৌ প্রয়োজন নাই। জোর করে আর যাই হোক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তৈরি করা যায় না। এটা সরকারের কাজ হতে পারে না। তিল তিল করে সহস্র বছরের পরম্পরা ছিন্নভিন্ন করে উপস্থাপনের কোনো যৌক্তিকতা নাই।

চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্র-শিক্ষকদের আয়োজনে কেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মাথা গলাচ্ছে, সেটাও বুঝতে পারি না। এটা সরকারের কর্মক্ষেত্র নয়; সারাদেশে মাজার-মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে চুরমার করা হলো, নিরুপদ্রব সময়ক্ষেপণ করলেন; এখন নিজেদের মতো করে বাঙালি সংস্কৃতির নিত্যনতুন ব্যাখ্যা ও বয়ান দিচ্ছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মহোদয়! এই প্রশ্নও ওঠানো হয়েছে তাঁর পক্ষ থেকে, মঙ্গল শোভাযাত্রা কেন? কেন নয় আনন্দ শোভাযাত্রা? মঙ্গল নাকি হিন্দুত্ববাদী শব্দ! আওয়ামী লীগ যেমন সবকিছুতে জামায়াত-শিবির সন্দেহ করে এই ট্যাগ দিত; বর্তমান সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা সবকিছুতে হিন্দুত্ব ও ভারতীয় ট্যাগ বসিয়ে দিচ্ছেন। এমনকি এ-ও প্রশ্ন উঠেছে, ছায়ানট বা উদীচী কেন ঈদে, মহররমে, শবেবরাতে অনুষ্ঠান করে না? কেন তারা শুধু নববর্ষে বা রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তীতে অনুষ্ঠান করে? বাঙালি মুসলমানের অনুষ্ঠান কেন ছায়ানটে নেই? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এবার চাঁদরাতে শিল্পকলায় রীতিমতো ব্যান্ড শো-র আয়োজনও করে।
এ দেশে মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ নানা ধর্মের মানুষ বাস করে। সকল ধর্মের অনুষ্ঠানই তবে শিল্পকলায় অনুষ্ঠিত হবে নিশ্চয়ই। পূজা থেকে বড়দিন কিংবা বুদ্ধপূর্ণিমা– সব আয়োজন করতে হলে বছরভর এসবই হবে শিল্পকলায়! হা হতোস্মি!

নানা ধর্মের নানা অনুষ্ঠান থাকবে, আছে। আমাদের সমাজে অসাম্প্রদায়িক উৎসব পহেলা বৈশাখ। সব ধর্মের, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে উৎসবটি পালন করে। ষাট দশকে পাকিস্তানি দুঃশাসন যখন রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে, তখন ছায়ানট আনুষ্ঠানিকভাবে রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু করে। ছয় দশক সময়জুড়ে এর অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক অবয়ব গড়ে উঠেছে। উদীচীরও তাই। এই কারণেই হয়তো ছায়ানট ও উদীচী উগ্রবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়ে আসছে। হিংস্র বোমা হামলায় বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। 
আসন্ন পহেলা বৈশাখে তো বটেই; গণঅভ্যুত্থানজয়ী বাংলাদেশের সম্মিলিত মানুষের শক্তির সামনে উগ্রবাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। 
সংস্কৃতির শাক দিয়ে উগ্রবাদের মাছ বেশিদিন ঢেকে রাখা যায় না।

মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
[email protected]

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন অন ষ ঠ ন সরক র র ছ য় নট

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে: নাহিদ 

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “জুলাই সনদ হতে হবে, জুলাই সনদের ভিত্তিতেই নির্বাচন হবে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে। নির্বাচিত যে সরকার আসুক এই সদন বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতা থাকবে।”  

মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) সন্ধ্যায় গাজীপুরের রাজবাড়ি সড়কে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’র সমাবেশে এসব কথা বলেন তিনি। 

নাহিদ ইসলাম বলেন, “৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র হতেই হবে। এর বিকল্প আমরা দেখতে চাই না। সরকার সনদের খসড়া প্রকাশ করেছে। জুলাই সনদ শুধু সংস্কার হলে হবে না, এটি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে, সে বিষয়ে ঐক্যমত হতে হবে।” 

আরো পড়ুন:

ভাসানীরা না থাকলে শেখ মুজিব কখনো তৈরি হতেন না: নাহিদ

গণঅভ্যুত্থান না হলে নির্বাচনের স্বপ্নই দেখতে পারতেন না: নাহিদ

তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, ৫ আগস্টের আগেই অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং সব রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করতে পারবেন। আমরা সবাই মিলে আকাঙ্ক্ষিত গণঅভ্যুত্থানের একবছর উদযাপন করতে পারব।” 

সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন- এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, কেন্দ্রীয় সংগঠক আব্দুল্লাহ আল মুহিম, মো. মহসিন উদ্দিন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গাজীপুরের সাবেক আহ্বায়ক নাবিল আল ওয়ালিদ।

এনসিপির পথসভাকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার সকাল থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন মোড়ে ও সমাবেশস্থলে বিপুল সংখ্যক  আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রাতে সন্দেহভাজনদের তল্লাশি করা হয়। রাজবাড়ীর সড়কে বন্ধ থাকে সব ধরনের যান চলাচল। 

এর আগে, এনপিপির কেন্দ্রীয় নেতরা টাঙ্গাইলের পথসভা শেষে গাজীপুরে কালিয়াকৈরে উপজেলা হয়ে শ্রীপুর উপজেলার মাওনা যান। সেখানে বিকেলে পথসভা শেষে গাজীপুর শহরের রাজবাড়িতে আসেন তারা।

ঢাকা/রেজাউল/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘বিচার প্রক্রিয়া ও সংস্কারের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে’
  • তিতুমীর কলেজে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী
  • হাসিনাকে ১০ বার ফাঁসিতে ঝোলালেও তার অপরাধ কমবে না: নাহিদ 
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
  • নরসিংদীতে আজ এনসিপির পদযাত্রা 
  • এনসিপির অনুরোধে সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করল ছাত্রদল
  • পাবিপ্রবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে প্রজেক্ট শো
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের সংবর্ধনা দিল জাবি
  • জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি থাকতে হবে: নাহিদ 
  • নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পথে নেমেছি: নাহিদ ইসলাম