যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক কমাতে যেসব দেশ অনুরোধ জানিয়ে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, তাদের সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। গতকাল সোমবার নিজ মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে ট্রাম্প এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে এক খবরে জানিয়েছে এএফপি। হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকেও এএফপিকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে চীন নতুন করে মার্কিন পণ্যে যে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, তা প্রত্যাহার না করলে দেশটির ওপর আরও ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ট্রাম্প।

ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প লেখেন, চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আরোপ করা ৩৪ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার না করে, তাহলে ৯ এপ্রিল থেকে তাদের ওপর অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। 

আমার দাবির সঙ্গে বেইজিং যদি একমত না হয়, তাহলে বাতিল করা হবে চীনের সঙ্গে পরিকল্পনায় থাকা সব আলোচনা। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের বিরুদ্ধে কোনো দেশ প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিলে তাদের ওপর আরোপ করা প্রাথমিক শুল্কের ওপর দ্রুত নতুন এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শুল্ক আরোপ হবে। 
ট্রাম্প আরও লেখেন, চীনের অনুরোধের ভিত্তিতে যেসব বৈঠকের পরিকল্পনা করা হয়েছিল, সেগুলো বাতিল করা হবে। তবে অন্য যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ করেছে, শিগগির আলোচনা শুরু হবে তাদের সঙ্গে।

গত ২ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। চীনের ওপর আরোপ করা হয় ৩৪ শতাংশ শুল্ক। এর আগে দেশটির পণ্যে ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। জবাবে গত শুক্রবার মার্কিন পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয় চীন। 

এদিকে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপ নিয়ে নানা দেশে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়ার শেয়ারবাজারে গতকাল রেকর্ড দর পতন হয়েছে। ৫০টিরও বেশি দেশ ইতোমধ্যে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা শুল্কনীতির ব্যাপারে পারস্পরিক চুক্তি নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়। শুল্ক আরোপের প্রভাবে এ পর্যন্ত টানা তিন দিনে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার হারিয়েছে সাড়ে ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। এশিয়ার মতো মার্কিন শেয়ারবাজারেও সংকট অব্যাহত রয়েছে। 
ট্রাম্পের কর্মকর্তারা মনে করেন, শুল্ক আরোপের ফলে সৃষ্ট অস্থিরতার ফলে মন্দা আসবে– এমন কোনো কারণ নেই। এটি একটি সমন্বয় প্রক্রিয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইতোমধ্যে শুল্ক কার্যকর করা হয়েছে। ইউরোপীয় ও এশীয় দেশগুলো ট্রাম্পের সঙ্গে একটি চুক্তি করার জন্য মরিয়া হয়ে আছে।
গতকাল বিশ্বের প্রধান প্রধান পুঁজিবাজারে হোঁচট খেয়েছে শেয়ারদর। এ পর্যন্ত টানা তিন দিনে বৈশ্বিক পুঁজিবাজার হারিয়েছে সাড়ে ৯ ট্রিলিয়ন ডলারের শেয়ারমূল্য। গত সপ্তাহে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার হারায় মার্কিন পুঁজিবাজার। ২০২০ সালের পর থেকে দেশটির শেয়ারবাজারের জন্য এটি সবচেয়ে খারাপ সময় যাচ্ছে এবং শেয়ারের পতন অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের দাবি, অর্থনীতিতে আশঙ্কার চেয়ে কম প্রভাব পড়েছে।

এদিকে মন্দা দেখা দিলে পুঁজিবাজারের পতন আরও গভীর হওয়ার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বাজার কৌশলবিদরা। এর মধ্যেই মার্কিন বাজারের প্রভাবশালী পূর্বাভাসদাতা ওপেনহাইমার অ্যান্ড কোম্পানির বিশেষজ্ঞরা এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর জন্য তাদের এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা বড় আকারে হ্রাস করে ৫ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে নামিয়েছে। আগে সংস্থাটি ৭ হাজার ১০০ পয়েন্ট পূর্বাভাস দিয়েছিল সূচকটির। 
কাল বুধবার রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে তালিকায় থাকা প্রায় ৬০টি দেশের ওপর আরোপিত শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক জোর দিয়ে বলেছেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী সব দেশের ওপর শুল্ক কার্যকর করা হবে। প্রেসিডেন্ট রসিকতা করে কিছু করেননি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং জায়ান্ট জেপি মরগান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্র ও বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা ৬০ শতাংশ। 

বিভিন্ন দেশের প্রতিক্রিয়া 
রয়টার্সের তথ্যমতে, ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে না ইন্দোনেশিয়া ও তাইওয়ান। তাছাড়া ভিয়েতনাম পণ্য রপ্তানির ওপর ট্রাম্পের আরোপিত ৪৬ শতাংশ শুল্ক আদায় অন্তত ৪৫ দিন বিলম্বে শুরু করতে অনুরোধ করেছে। চীন ১০ এপ্রিল থেকেই সব মার্কিন পণ্য আমদানির ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইন বলেছেন, শুল্ক আরোপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত ইউরোপীয় ইউনিয়ন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার সতর্ক করে বলেছেন, তাঁর সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অর্থনৈতিক চুক্তি করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে, যাতে কিছু শুল্ক এড়ানো যায়। 
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তি হিসেবে মার্কিন পণ্যে শূন্য শুল্কের প্রস্তাব দিয়ে বলেছেন, তাইওয়ানের কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বাড়াবে। একজন ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ভারত ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে না। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, শুল্ক আরোপের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাগুলোকে তিনি রক্ষা করবেন।

এশিয়া ও ইউরোপের শেয়ারবাজারে বড় ধস
বিবিসি জানায়, ইউরোপের ব্যাংক ও প্রতিরক্ষা খাতের শেয়ারে ধস নামার পাশাপাশি এশিয়ার শেয়ারবাজারগুলোতে গতকাল রেকর্ড দর পতন হয়েছে। এই পতনের মাত্রা গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। সৌদি পুঁজিবাজার এক দিনে হারিয়েছে ৫০ হাজার কোটি রিয়াল। কাতার, কুয়েত, ওমান ও বাহরাইনের শেয়ারবাজারেও পতনের খবর পাওয়া গেছে। সাংহাই থেকে টোকিও, সিডনি থেকে হংকং– প্রায় সব বাজারের সূচকই রেকর্ড হারে পতন হয়েছে। সাংহাই কম্পোজিট সূচক এক পর্যায়ে ৮ শতাংশের বেশি নিচে নেমে যায়। হংকংয়ের হ্যাং সেং ১৩ দশমিক ২২ শতাংশ কমে যায়, যা ২০০৮ সালের পর সর্বোচ্চ পতন। জাপানের নিক্কেই ২২৫ সূচক ৭ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। বিশ্লেষকরা একে ‘রক্তস্নান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইউরোপের শেয়ারবাজারের প্রধান প্রধান সূচকে মার্কিন শুল্কনীতির ধাক্কা দৃশ্যমান ছিল গতকালও। ইউরোপের শেয়ারবাজারের মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা হয় প্যান-ইউরোপিয়ান স্টক্স ৬০০ সূচককে। গতকাল লেনদেন শুরুর পরপরই সূচক ৬ শতাংশ কমেছে। দিনের শুরুতে জার্মানির ডিএএক্স সূচকটি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ।
আমস্টারডাম স্টক এক্সচেঞ্জে দর পতন হয়েছে ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। এ ছাড়া বেলজিয়াম স্টক মার্কেটে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ এবং ফ্রান্সের শেয়ারবাজার সিএসি৪০-এ ৬ দশমিক ১৪ শতাংশ দর পতন হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে জোটটির শীর্ষ বাণিজ্য কর্মকর্তারা লুক্সেমবার্গে বৈঠকে বসেছেন। 

বিশ্বে তেলের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
সিএনএন জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার বাণিজ্য অংশীদারদের ওপর ব্যাপক শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় গতকাল তেলের দামে ধস নেমেছে। বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ৩ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৬৩ দশমিক ৩০ ডলারে লেনদেন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানদণ্ড ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেলও ৩ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ব্যারেলপ্রতি ৫৯ দশমিক ৮৪ ডলারে নেমে এসেছে। 


 
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ শ ল ক আর প র র শ য় রব জ র র ওপর আর প কর মকর ত ইউর প র র জন য র আর প অন র ধ বল ছ ন গতক ল দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

সরকারের ভেতরে একটা অংশ নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে: এনসিপি

সরকারের ভেতরের একটি পক্ষ ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বাইরে গিয়ে নিজেরাই ঐকমত্য কমিশন হওয়ার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, এই চেষ্টার কারণে নির্বাচন ঝুঁকিতে পড়বে।

আজ সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর বাংলামোটরে এনসিপির অস্থায়ী কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আখতার হোসেন এ কথা বলেন।

আখতার হোসেন বলেন, তাঁদের কাছে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যে সরকারের ভেতরের কোনো একটা অংশ সংস্কারকে ভন্ডুল করে নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা করছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ–আলোচনার ভিত্তিতেই কমিশন সুপারিশ উপস্থাপন করেছে উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্যসচিব বলেন, সেই সুপারিশের ভিত্তিতেই সরকার আদেশ জারি করবে, সেটাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যখন সরকারের তরফ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে আরও এক সপ্তাহ রাজনৈতিক দলগুলোকে আলাপ–আলোচনার কথা বলা হয়, তখন মনে হয় যে সরকার আসলে এই সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে সাপ-লুডো খেলছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ৯৬-তে পৌঁছে গিয়েছিলাম, সেটাকে আবার তিনে নিয়ে আসা হয়েছে সাপ কেটে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাতে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে।’

অতি দ্রুত সরকারকে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহ্বান জানিয়ে এনসিপির সদস্যসচিব বলেন, সরকারকে নিজেকেই দায়িত্ব নিয়ে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি করতে হবে। সামনের সংসদকে গাঠনিক ক্ষমতা প্রদান করার মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। গণভোটের মাধ্যমে অর্জিত জনগণের অভিপ্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে যেন বাস্তবায়িত হয়, সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ