দিনাজপুরের বনতাড়া গ্রামে ৭ দিন আতঙ্কের পর এল সম্প্রীতির বার্তা
Published: 8th, April 2025 GMT
‘হিন্দু সম্প্রদায়ের ভাইয়েরা আপনারা দোকান খোলেন, বাড়িতে থাকেন। যাঁর যা পেশা, সেই অনুযায়ী কাজকর্ম করেন। ভয়ের কিছু নাই। আতঙ্কিত হবেন না।’
আজ মঙ্গলবার সকালে দিনাজপুর সদর উপজেলার বনতাড়া গ্রামে মসজিদের মাইক থেকে এমন ঘোষণা আসছিল। ঘোষণার পরেও বনতাড়া গ্রামে ছিল সুনসান নীরবতা। আতঙ্ক কাটছিল না পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের। অবশেষে বেলা ১১টার দিকে পাড়ায় সশরীর আসেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, মসজিদের ইমাম, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের শতাধিক নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে দেওয়া হয় সম্প্রীতির বার্তা।
দিনাজপুরে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.
যে তরুণের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ঢাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। যে আইডি দিয়ে তিনি কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেছেন বলে অভিযোগ, সেটি ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কটূক্তির অভিযোগটি প্রথম যে আইডি থেকে ছড়ানো হয়েছে, সেটির ব্যবহারকারী সম্পর্কে কোনো তথ্য বা ছবি ওই আইডিতে নেই।
আজ সকালে অভিযুক্ত তরুণের মা গ্রামের বাড়িতে বসে প্রথম আলোকে বলেন, ২৮ মার্চ ঈদের ছুটিতে তাঁর ছেলে বাড়িতে এসেছিলেন। ঈদের পর তিনি স্ত্রীসহ শ্বশুরবাড়িতে যান। এ ঘটনার পর থেকে ছেলের সঙ্গে তাঁদের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। এমনকি ওই দিন থেকে তাঁর স্বামীও বাড়িতে নেই। তিনি বলেন, ‘হামার ছেলে অপরাধ করছে, আমি ছেলের পক্ষ হইয়ে সবার কাছোত মাফ চাওছি। আমাদের জন্য গ্রামবাসী সবারে অন্যায় অত্যাচার, ভয়তে বাড়িত থাকতে পারছে না। মেলাজন আপদ-বিপদে আছে। তে আমার ছেলে অপরাধ করছে আমাদেরকে শাস্তি দেন, জনগণ কেনে শাস্তি পাবে? হাঁরা হাত-পা ধরিয়া ক্ষমা চাই।’
স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জালিয়াপড়া, ক্ষত্রিয়পাড়া, বালুপাড়া, মুদিপাড়া, গিলাবাড়ি মিলে বনতাড়া গ্রাম। বসবাস সাড়ে সাত শ পরিবারের। এর মধ্যে দুই শতাধিক হিন্দু পরিবার। পাড়ার প্রায় মধ্যভাগে ১২ থেকে ১৪টি দোকান আছে। এর মধ্যে একটি সেলুনসহ ছয়টি দোকান হিন্দুদের। ১১ জন হিন্দু ইজিবাইক–চালক আছেন এখানে। জেলে পেশায় আছেন ১৫-২০ জন। অন্যরা কৃষিশ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশায় আছেন। ঘটনার পর থেকে এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা ইজিবাইক চালানো ও দোকানপাট বন্ধ রেখেছিলেন। এমনকি কোনো কাজকর্মেও বের হননি। অর্ধাহার, অনাহার ও আতঙ্কে দিন কেটেছে তাঁদের। সর্বশেষ ৬ এপ্রিল অভিযুক্ত তরুণের মন্তব্যে সমর্থন জানানোর অভিযোগে বনতাড়া স্কুলের একজন শিক্ষককে পুলিশ গ্রেপ্তার করলে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। এর পর থেকে গ্রামের অন্তত ১০ জন যুবক আতঙ্কে বাড়ি ছেড়েছেন।
আরও পড়ুনদিনাজপুরে মহানবী (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ, তরুণের গ্রেপ্তার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ০৬ এপ্রিল ২০২৫জালিয়াপাড়া জেলে সমিতির নেতা মানিক চন্দ্র দাস (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজনের অপরাধে সবারে ভোগান্তি হলো। এই গ্রামে হিন্দু-মুসলমান আমরা দীর্ঘদিন ধরে মিলেমিশে আছি। কারও সঙ্গে কোনো ঝগড়া–বিবাদ নাই। ঘটনার দিন বিকেলে স্থানীয় যুবকেরা আমাদেরকে দোকানপাট বন্ধ করতে বলেছেন। বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। কেউ যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করতে পারে এ জন্য। এই কয়েক দিন কষ্ট হয়েছে, তবে আজকে সবাই বসে আমরা মিল হয়ে গেছি। ওই ছেলের (অভিযুক্ত তরুণ) শাস্তি হউক। কাজটা সে ঠিক করেনি।’
স্থানীয় হরিসভা মন্দিরের সভাপতি মনো দাস (৪৫) বলেন, ‘আমাদের হরিসভা ছিল। বিশৃঙ্খলা এড়াতে আমরা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটাও বন্ধ করেছি।’
মঙ্গলবার সকালে বনতাড়া গ্রামে কথা হয় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) শহিদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই কয়েক দিন তাদের (হিন্দুদের) দোকানপাট বন্ধ ছিল, এটা ঠিক। কাজকর্মে বের হতে পারেনি, এটাও ঠিক। তবে গ্রামে যেন কোনো হামলা কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, এসব বিবেচনায় স্থানীয় যুবকেরাই বন্ধ রাখতে বলেছিল। মূলত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই এটা করা হয়েছে। একজনের দোষে তো সবাই দোষী হতে পারে না। তবে আজকে আমরা সবাইকে নিয়ে বসেছি। অভিযুক্ত তরুণের পরিবারসহ অন্যদের সামান্য খাদ্যসামগ্রী ও আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। আর কোনো সমস্যা হবে না।’
বোচাগঞ্জে এক তরুণ গ্রেপ্তার
এদিকে দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় ইসলাম ধর্ম ও মুসলমানদের নিয়ে কটাক্ষ করে ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্যের অভিযোগে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ সকাল সাড়ে আটটার দিকে বীরগঞ্জ উপজেলা বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে তাঁকে আটক করা হয়।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সোমবার ফিলিস্তিন বিষয়ে এক ব্যক্তির দেওয়া পোস্টে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করেন ওই তরুণ। এটি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় লোকজন। স্থানীয়দের একটি দল ওই তরুণের বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়। তাঁর শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন। পরে বোচাগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মারুফ হাসান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে অভিযুক্তকে আইনের আওতায় আনার আশ্বাস দেন। এরপর মঙ্গলবার সকালে তাঁকে আটক করে বোচাগঞ্জ থানায় নিয়ে আসে পুলিশ।
বোচাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদ হাসান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টে হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তিমূলক কমেন্ট করায় এলাকাবাসী বিক্ষোভ করেন। এক ব্যক্তি এ বিষয়ে বোচাগঞ্জ থানায় একটি মামলাও করেন। আজ সকালে অভিযুক্তকে বীরগঞ্জ থানার বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং বিকেলে তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম দ র পর ব র আতঙ ক উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
ব্যালটে মামদানি, অদৃশ্য ‘প্রার্থী’ ট্রাম্প
নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন আগামীকাল মঙ্গলবার। ‘বিশ্বের রাজধানী’ হিসেবে পরিচিত এই শহরে প্রথমবার এমন একজন মেয়র পদে নির্বাচিত হতে পারেন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির চলতি ধারার একদম বিপরীতমুখী। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর রিপাবলিকান পার্টি এক ‘শ্বেতকায়, খ্রিষ্টান ও রক্ষণশীল’ আমেরিকার কথা বলছেন।
জোহরান মামদানি শ্বেতকায় নন, তিনি বাদামি রঙের দক্ষিণ এশীয়। তিনি খ্রিষ্টান নন, একজন মুসলিম। তিনি অবশ্যই রক্ষণশীল নন, তিনি খোলামেলাভাবে একজন প্রগতিশীল, যিনি নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলতে দ্বিধা করেন না।
‘মামদানি একজন ভয়ানক মানুষ’, সাবধান করে বলেছেন অ্যান্ড্রু কুমো, মঙ্গলবারের নির্বাচনে যিনি মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বী। সারা জীবন ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য থাকলেও বাছাইপর্বে পরাজিত হয়ে তিনি এখন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন।
ব্যালটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নাম না থাকলেও এই নির্বাচনে তিনি একজন অদৃশ্য প্রার্থী। কুমোর পক্ষ নিয়ে তিনিও এই নির্বাচনের একজন অংশগ্রহণকারী। বড় ব্যবধানে মামদানির বিজয় হলে অনেকেই তা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অনাস্থা হিসেবেই দেখবেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিউইয়র্কের আদি বাসিন্দা। তিনি কোনোভাবেই চান না মামদানি এই শহরের মেয়র নির্বাচিত হোন। তাঁর বিবেচনায় মামদানি শুধু একজন পাক্কা কমিউনিস্টই নন, রীতিমতো উন্মাদ। এমন একজনকে নির্বাচিত করা হলে তিনি নিউইয়র্ক সিটির জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল আটকে দেবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, মামদানি একজন অবৈধ অভিবাসী। তা প্রমাণিত হলে তাঁকে বহিষ্কার করা হবে। মেয়র নির্বাচিত হয়ে মামদানি যদি অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের চলতি অভিযানে বাধা দেন, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে, এমন হুমকিও দিয়েছেন ট্রাম্প।
শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি।ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়
শুধু নিউইয়র্কে নয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে আরও অন্তত তিনটি রাজ্যে নির্বাচন হবে আগামীকাল, যার ফলাফল ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের ব্যাপারে একটি রেফারেন্ডাম বা জনরায় হবে ভাবা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নিউ জার্সি ও ভার্জিনিয়ায় গভর্নর পদে নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে প্রতিনিধি পরিষদ ও উচ্চ পরিষদেও ভোট গ্রহণ করা হবে। উভয় রাজ্যই ডেমোক্রেটিক রাজনীতির সমর্থক, বা ‘ব্লু স্টেট’। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই দুই রাজ্যেই ট্রাম্পের হার হয়, কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় তিনি অনেক ভালো ফল করেন। দেখার বিষয়, দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে এই দুই রাজ্যে ট্রাম্পের জনসমর্থন এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে।
এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গেভিন ন্যুসাম নির্বাচনী ম্যাপ পরিবর্তনের অনুমতি চেয়ে একটি গণভোটের আয়োজন করেছেন। আগামী বছরের নভেম্বরে মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল হিসেবে রিপাবলিকান পার্টি বড় রকমের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। তা ঠেকাতেই ট্রাম্পের নির্দেশে টেক্সাসের নির্বাচনী ম্যাপ ঢেলে সাজানো হয়েছে, যার ফলে রিপাবলিকান দল কংগ্রেসে আরও পাঁচটি আসন নিজেদের দখলে আনতে সক্ষম হবে ভাবা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ‘ব্লু স্টেট’ ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ন্যুসামের নির্দেশে নির্বাচনী ম্যাপ বদলানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যার ফলে সেখানে ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি আসনে বিজয়ের সম্ভাবনা তৈরি হবে।
এই তিনটি নির্বাচনের প্রতিটিতেই ভোটারদের মনে থাকবেন ট্রাম্প, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আইনি বাধা উপেক্ষা করে বিভিন্ন ডেমোক্রেটিক শহরে অবৈধ অভিবাসনবিরোধী অভিযানের নামে সেনাসদস্যদের পাঠাচ্ছেন তিনি। যেসব ডেমোক্রেটিক নেতাকে শত্রু মনে করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করেছেন। কোনো যুক্তি বা কারণ ছাড়াই ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাঁর পক্ষে ভোট দেয়নি এমন ডেমোক্রেটিক রাজ্যের কেন্দ্রীয় অনুদান বাতিল করছেন। কংগ্রেসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই একাধিক সরকারি দপ্তর আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচলিত আইনের তোয়াক্কা না করে মাদক পাচার বন্ধের নামে ভেনেজুয়েলার সমুদ্রসীমায় সামরিক হামলা চালাচ্ছেন। আমদানি শুল্কের নামে যে বাণিজ্যযুদ্ধ তিনি শুরু করেছেন, তার ফলে নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়া শুরু হয়েছে।
গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।এসব কার্যকলাপের ফলে সারা দেশে ট্রাম্পের জনসমর্থন কমেছে। অধিকাংশ জনমত জরিপে তাঁর প্রতি সমর্থন ৪২ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি নয়। সাম্প্রতিক সময়ে মাত্র ১০ মাসের মাথায় অন্য আর কোনো প্রেসিডেন্টের জনসমর্থনে এমন ধস নামেনি।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প কোনো রাজ্যেই ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি প্রচারে আসেননি। এমনকি রিপাবলিকান প্রার্থীদের পক্ষে সরব সমর্থনও জানাননি। এর একটা সম্ভাব্য কারণ, জয়ী হবেন এমন প্রার্থীর সমর্থন দিতেই ট্রাম্প ভালোবাসেন। আগামীকালের নির্বাচনে তেমন সম্ভাবনা কম।
এই নির্বাচন যে ট্রাম্পের ব্যাপারে জনরায়, তার আরেক প্রমাণ নির্বাচনী প্রচারণায় সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অংশগ্রহণ। ডেমোক্রেটিক পার্টিতে জাতীয় নেতা বলতে তিনিই সবেধন নীলমণি। শনিবার নিউ জার্সির ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী মাইকি শেরিলকে পাশে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। একই দিন ভার্জিনিয়ায় ডেমোক্রেটিক গভর্নর পদপ্রার্থী এবিগেইল স্প্যানবার্গারের পক্ষেও প্রচারণায় অংশ নেন তিনি। উভয় রাজ্যেই ওবামা কঠোর ভাষায় ট্রাম্পের সমালোচনা করে বলেন, ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী নীতির কারণেই আমেরিকা আজ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি।
জনমতে এগিয়ে মামদানি
ওবামা মামদানিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেননি। তবে তিনি যে মামদানির পাশে আছেন, সে কথাও গোপন রাখেননি। মামদানির ক্যাম্পেইন থেকে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি ওবামা নিজেই ফোন করে জানিয়েছেন, তাঁর (মামদানির) বিজয়ের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তিনি বলেছেন, মামদানির নির্বাচনী প্রচার ‘ইম্প্রেসিভ’ বা নজরে পড়ার মতো।
কুমো ক্যাম্প থেকে অহোরাত্রি তাঁকে ‘কমিউনিস্ট’ ও ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ হিসেবে প্রচার সত্ত্বেও মামদানি যেসব জনমত জরিপে এগিয়ে, তার একটি বড় কারণ মাঠপর্যায়ে তাঁর এই ‘ইম্প্রেসিভ’ প্রচারণা। শহরের প্রতিটি প্রধান কেন্দ্র হেঁটে জনসংযোগ সেরেছেন মামদানি। ৫০ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবক, যাঁদের অধিকাংশই নবীন, শহরের প্রতিটি বাসায় কড়া নেড়েছেন। টিকটক ও ইউটিউবে তাঁর উপস্থিতি অভূতপূর্ব। মামদানির এই ‘মাঠপর্যায়ের খেলা’ ঠেকাতে কুমো বেছে নিয়েছেন একদিকে ঘৃণা, অন্যদিকে ভীতি। এতে তিনি ফল পাচ্ছেন, গত দুই সপ্তাহে মামদানির সঙ্গে তাঁর ব্যবধান ১০ শতাংশের মতো কমে এসেছে। নিউইয়র্কের চলতি মেয়র নির্বাচন থেকে এরিক অ্যাডামস সরে দাঁড়ানোয় কুমোর লাভ হয়েছে সন্দেহ নেই, তবে এখনো মামদানির সঙ্গে যে ১৬-১৭ পয়েন্টের ব্যবধান রয়েছে, তা অতিক্রম করা কার্যত অসম্ভব, এই মত অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের।
ভূমিধস পরিবর্তন
একটা বিষয় স্পষ্ট। মেয়র নির্বাচনে মামদানি জয়ী হলে তা মার্কিন রাজনীতিতে প্রজন্মগত ও নীতিগত পরিবর্তনের সূচনা করবে। ভূমিধস পরিবর্তন আসবে ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিতে। মধ্যপন্থী ও ডানঘেঁষা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে এই দল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে কম জনপ্রিয়। এই দলে যাঁরা নেতৃত্বে, তাঁদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ, করপোরেট আমেরিকার কাছে এদের হাত-পা বাঁধা। ইসরায়েল প্রশ্নে তাদের সমর্থন এখনো আগের মতো নতজানু।
পিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ইসরায়েল প্রশ্নে এখন নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে এমন আমেরিকানের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, যা তিন বছর আগের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একইভাবে ধনতন্ত্রের প্রতিও আমেরিকানদের সমর্থন নিম্নগামী। গ্যালপ জানাচ্ছে, ২০২১ সালে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ ধনতন্ত্রের সমর্থক ছিল, তা এখন কমে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এই যে পরিবর্তিত আমেরিকা, ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা সে কথা জানেন না বা জানতে চান না। গাজা প্রশ্নে তাঁদের রক্ষণশীল অবস্থান দলটির প্রতি নবীন প্রজন্মের ভোটারদের অবজ্ঞার জন্ম দিয়েছে।
অন্যদিকে ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান পার্টি খোলামেলাভাবে অভিবাসনবিরোধী, দক্ষিণপন্থী, খ্রিষ্টবাদী ও রক্ষণশীল। চলতি সপ্তাহের নতুন উদ্বাস্তু নীতিতে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতকায় ও ইউরোপীয় আশ্রয়প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেবে। এই অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতকায় নাগরিকবৃন্দ, ট্রাম্প প্রশাসনের চোখে যারা সে দেশের সরকারের বৈষম্যের শিকার।
এই প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির বিপরীতে একটি আধুনিক ও প্রগতিশীল ডেমোক্রেটিক আন্দোলন গড়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স ও কংগ্রেস সদস্য ওকাসিও-কর্তেজ ইতিমধ্যে এই আন্দোলনের প্রধান মুখপাত্র হয়ে উঠেছেন। সবাই মানেন, মামদানির মতো তরুণ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব এই আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে।
এই সম্ভাবনার কথা খুব স্পষ্ট করে বলেছেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর কথায়, এই দেশ করপোরেট আমেরিকার নির্দেশে চলবে, না তার রাজনীতির কেন্দ্রে থাকবে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ—এ মুহূর্তে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ‘যদি আমরা দ্বিতীয় পথটি বেছে নিতে চাই, করপোরেট আমেরিকার বদলে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিই, তাহলে আমাদের মামদানির পাশে দাঁড়াতে হবে।’
কোন পথ বেছে নেবে নিউইয়র্ক, মঙ্গলবারেই তা নিশ্চিত হবে।