যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্ক আরোপে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে। বিশেষ করে চীন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় চটেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চীনকে শায়েস্তা করার হুমকি দিয়ে বলেছেন, প্রয়োজনে চীনের ওপর আরও ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এতে ঘাবড়ে যায়নি বেইজিং। চীনা কর্মকর্তারা বলেছেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপে আমাদের ওপর প্রভাব পড়বে; কিন্তু আকাশ ভেঙে পড়বে না। দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়ে দিয়েছে, মার্কিন শুল্কের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শেষ দেখতে চায় তারা এবং ওয়াশিংটনের এই ‘ব্ল্যাকমেইলিং আচরণ’ কখনোই মেনে নেবে না বেইজিং। 

ট্রাম্পের হুমকিকে ‘ভুলের ওপর ভুল’ আখ্যায়িত করে চীন জানিয়েছে, শুল্ক আরোপের এই পরিকল্পনা প্রত্যাহার করে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার মতপার্থক্যের সমাধান করা হোক। গত সোমবার ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এক বক্তব্যে বলেন, শুল্ক স্থগিত করার ব্যাপারে তিনি ভাবছেন না। এমনকি এ নিয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে দর কষাকষি করতেও আপাতত ইচ্ছুক নন তিনি। এ সময় দেশগুলোর ওপর আরোপিত শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করা হতে পারে– এমন খবরকে গুজব উল্লেখ করেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, অনেক দেশ আমাদের সঙ্গে চুক্তি করতে আসছে, আর এগুলো হবে ন্যায্য চুক্তি।
যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, কিছু শুল্ক স্থায়ী হতে পারে, আবার কিছু কিছু নিয়ে আলোচনা সম্ভব। আমরা চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ন্যায্য ও ভালো মানের চুক্তি করার ব্যাপারে আলোচনা করব। আমেরিকা ফার্স্টনীতি বাস্তবায়নের এখনই সময়। 

মার্কিন ট্রেজারি সচিব স্কট বেসেন্ট বলেছেন, শুল্ক আলোচনা টেবিলে আছে। ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে আলোচনায় জড়িত থাকবেন। তিনি স্বীকার করেন, চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় সুবিধা রয়েছে। তাঁর দাবি, চীন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে যা রপ্তানি করে, তার এক-পঞ্চমাংশ আমরা তাদের কাছে রপ্তানি করি, তাই এটি তাদের জন্য ক্ষতিকর। 
ট্রাম্প নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া এক পোস্টে চীনের ওপর ওই বাড়তি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। গত শুক্রবার চীন যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ৩৪ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। গত ২ এপ্রিল ট্রাম্প অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেন। গত মার্চে চীনের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করাই ছিল। ফলে হুমকির ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ হলে চীনা পণ্যে শুল্ক দাঁড়াবে ১০৪ শতাংশ, যা দেশটির জন্য বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। 
হেনরিখ ফাউন্ডেশনের ডেবোরা এলমস মনে করেন, ‘মার্কিন শুল্ক আরোপের ঘটনা বিশ্বায়নের সমাপ্তি ঘটাতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা বাণিজ্য বন্ধ করে দেব। উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যকলাপের পুনর্বিন্যাসের ফলে অস্থিরতা দেখা দেবে, যা সরকারগুলোকে অতিরিক্ত চাপের মধ্যে ফেলবে।’ 

শুল্ক প্রত্যাহারের আবেদন মাস্কের 
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন বলছে, প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্ক সরাসরি ট্রাম্পের কাছে শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছেন। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই ব্যক্তি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাস্ক যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে একটি ‘শূন্য শুল্ক’ ব্যবস্থাকে সমর্থন করেছেন। এমনকি হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারোর সঙ্গে বাগ্‌যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বাণিজ্য নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে মাস্কের এটিই প্রথম দ্বিমত নয়। ২০২০ সালে শুল্ক নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন মাস্ক। এ ঘটনা ট্রাম্পবিরোধীদের জন্য সমালোচনার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। 

বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে ফিরল স্বস্তি 
বিশ্বের অন্যান্য দেশের শেয়ার সূচকের মতো সোমবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে প্রায় দুই হাজার পয়েন্ট পড়ে যায় মার্কিন বাজারের সূচক। ফলে আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সেদিন লেনদেন শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজে শুরু হয় চরম অস্থিরতা। প্রথমেই ১ হাজার ৭০০ পয়েন্ট নেমে যায় এই সূচক। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে ৮০০ পয়েন্ট লাফিয়ে ওঠে সেটি। এর পর আবার ৪১৪ পয়েন্ট নেমে যায় ওই শেয়ারের লেখচিত্র। এসঅ্যান্ডপি ৫০০-তে লেনেদেন ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। নাসডাক কম্পোজিটে বেড়েছে ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। 
ধাক্কা কাটিয়ে মঙ্গলবার সকালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সোমবার ১০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ পতন হয়েছিল ভারতের শেয়ার সূচক সেনসেক্স ও নিফটির। সেই দুই সূচক বেশ ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গতকাল সকালে সেনসেক্স বেড়েছে ১ হাজার ২০৬ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ; নিফটি বেড়েছে ৩৬৫ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গতকাল সকালে জাপানের নিক্কিই এশিয়া সূচক ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। হংকংয়ের হ্যাং সেং সূচকের উত্থান হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। চীনের মূল ভূখণ্ডের ব্লি চিপস সূচকের উত্থান হয়েছে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। 

মার্কিন পণ্যে শুল্ক আরোপ করবে ইইউর দেশগুলো 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় এবার পাল্টা শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইউরোপের ২৭টি দেশের এই জোট মার্কিন পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, সোমবার লুক্সেমবার্গে অনুষ্ঠিত এক জরুরি বৈঠকে ইইউ নেতারা এই প্রস্তাব দিয়েছেন। আগামী ১৬ মে থেকে মার্কিন পণ্যের ওপর ইইউর এই নতুন শুল্কনীতি কার্যকর হতে পারে। ট্রাম্প ইইউভুক্ত দেশগুলোর ওপর ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছেন। 
ইইউর প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিনের শুল্ক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চান। তিনি বলেছেন, আলোচনা ব্যর্থ হলে আমরা শুল্কযুদ্ধ চালিয়ে যাব। যুক্তরাষ্ট্রে পরিকল্পিত বিনিয়োগ স্থগিত করতে ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।


 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ ল ক আর প র শ শ ল ক আর প চ ন র ওপর ইউর প র র জন য কর ছ ন স মব র বল ছ ন দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 

বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না।  মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন  করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও  এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?

ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো।  বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে। 

আরো পড়ুন:

রাশিয়ার ‍বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ

রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা 

রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে। 
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। 

১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত। 

জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। 

বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই। 

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।  

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরদের কাজ কি শুধু ভাইভা নেওয়া
  • কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস 
  • চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী-গ্রামবাসীতে বিদ্বেষ কেন
  • চার্লি কার্ক হত্যাকাণ্ড: ট্রাম্প কি দাঙ্গা–ফ্যাসাদকেই নীতি হিসেবে নিয়েছেন