ভারতের পার্লামেন্টে পাস হওয়া বিতর্কিত ওয়াক্ফ বিল নিয়ে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে মুসলমানদের বিক্ষোভ অব্যাহত আছে। ধর্মীয় সম্পত্তির ওপর হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিদিন প্রতিবাদ জানাচ্ছেন এবং কুশপুত্তলিকা দাহ করছেন। ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল পাসের জন্য দেশটির অনেক সচেতন নাগরিকও প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, ভারতে ক্ষমতাসীন এমন দল মুসলিম মুসলিম রব তুলে ওয়াক্ফ বিল সংশোধন করেছে, যাদের দলে একজনও মুসলমান এমপি নেই।

গতকাল মঙ্গলবার ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টে অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি সাগরিকা ঘোষ এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লেখেন, আত্মবিভ্রান্তিতে ভোগা বিজেপি নিজেদের বিশ্বাস করিয়েছে যে, মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করা এবং এই সম্প্রদায়ের কিছু অংশকে নিরাপত্তাহীনতা ও ভয়ের মধ্যে ঠেলে দেওয়া তাদের নিজেদের জন্যই ভালো। ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল ২০২৫ নিয়ে পার্লামেন্টে সাম্প্রতিক বিতর্কের সময় ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতারা হঠাৎ জোরেশোরে দাবি করেছেন, তাদের হৃদয়ে দরিদ্র মুসলমানদের জন্য রক্তক্ষরণ হচ্ছে। অথচ এটা যেন ছিল বিদ্রুপের চেয়েও বড় বিদ্রুপ। কারণ বিজেপি এমন একটি দল, যাদের কোনো মুসলমান লোকসভা সাংসদ নেই এবং তারা কখনও কোনো মুসলিম নারীকে মূলধারার রাজনীতিতে উৎসাহিত করেনি।

এমনকি বিজেপি নির্বাচনী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও মুসলিমদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব দেয় না। দলটির কোনো উচ্চ পদেও নাম নেই কোনো মুসলিম নেতার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্য ‘হিন্দুত্বের পরীক্ষাগার’খ্যাত গুজরাটে গত দুই দশক ধরে কোনো মুসলিম নেতাকে বিধানসভার টিকিট দেওয়া হয়নি। 
১৯৯৮ সালে গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হয়ে একজন মুসলিম নেতা নির্বাচনের টিকিট পেয়েছিলেন। ওয়াক্ফ সংশোধনী বিলটি পার্লামেন্টে জোর করে পাস করানোর পরও দলটি সাহস করে দাবি করছে, তারা মুসলমানদের কল্যাণের জন্য কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, বিজেপির দাবি ওয়াক্ফ সংশোধনী বিলটি ভারতের মুসলমানদের কল্যাণের জন্য করা হয়েছে। কিন্তু তা সম্পূর্ণ কল্পকাহিনি এবং ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। বিলটির আসল উদ্দেশ্য হিন্দুত্ববাদী ভোটব্যাংককে উৎসাহিত করা। সেই সঙ্গে দলটির অধস্তন এই বার্তা পাঠানো যে, মুসলমানদের আবার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। কারণ মুসলমানদের ওপর সরকারের এই নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগের ফলে নিঃসন্দেহে হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের ঝড় বইবে। তাদের ধারণা, অতীতের ‘দুর্বল’ সরকারগুলো, যারা মুসলমানদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছিল, তাদের এ বিল দিয়ে পর্যুদস্ত করা গেছে। এ ছাড়া বিজেপির গেরুয়া সেনাদের কাছেও এমন আনন্দের ইঙ্গিত পাঠায় যে, সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে কিনা, তা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়।

প্রধানমন্ত্রী মোদির তীব্র সমালোচনা করে সাগরিকা বলেন, মোদি সরকার নাগরিকদের সার্বভৌমত্ব সম্মান করে না। ওয়াক্ফ বিল ব্যক্তির ধর্ম পালনের অধিকার এবং সংবিধানের ২৫-২৮ অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার ধ্বংস করেছে। 

এদিকে ওয়াক্ফ বিল পাসের ধারাবাহিকতায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও সহিংসতা অব্যাহত আছে। পাঞ্জাবের জলন্ধরে গত সোমবার গভীর রাতে বিজেপি নেতা মনোরঞ্জন কালিয়ার বাড়িতে কে বা কারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। এর আগে গত ৬ এপ্রিল মণিপুর রাজ্যে ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল সমর্থন করার অভিযোগে বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার রাজ্য সভাপতি আসকার আলীর বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম সলম ন র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

এই সরকারও আমলাতন্ত্রের চাপে!

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান নতুন যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছে, সেখানে নিশ্চিত করেই জনপ্রশাসন সংস্কারের প্রশ্নটি নাগরিকদের কেন্দ্রীয় একটি চাহিদা। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মতোই পদ ছাড়া পদোন্নতি দিচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, আগের সরকার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিল যে কয়টা স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে, তার অন্যতম আমলাতন্ত্র।

জনপ্রশাসনকে রাজনীতিকরণের বৃত্ত ভেঙে জনবান্ধব করার একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছিল অভ্যুত্থান। কিন্তু শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার আমলাতন্ত্রের ওপর অতিনির্ভরশীল হয়ে ওঠায় সেই সুযোগ অনেকটাই হাতছাড়া হয়েছে। সরকারি কর্মকর্তাদের বিরোধিতার কারণে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের বড় কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। অন্যদিকে বেতন বাড়াতে গঠন করা হয়েছে বেতন কমিশন। কিছু মুখকে সরিয়ে দেওয়া ছাড়া জনপ্রশাসনে সেই পুরোনো চর্চা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ ছাড়া পদায়নের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসনে যেভাবে আগের সরকারের চর্চার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে, সেটা যারপরনাই দুঃখজনক।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, উপসচিব স্তরে যেখানে আগে থেকেই পদের চেয়ে ৬০০ কর্মকর্তা বেশি রয়েছেন, সেখানে আগস্ট মাসে নতুন করে ২৬৮ জনকে এই পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব পদেও পদোন্নতির আলোচনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক সরকারের আমলে জনপ্রশাসনে হরেদরে পদোন্নতি দেওয়ার অনেক নজির আছে। এর কারণ একটাই, আমলাতন্ত্রকে তুষ্ট রাখা। অন্তর্বর্তী সরকার এই চর্চায় ছেদ ঘটাতে পারবে, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করেছিল।

পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়ার পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকে আগের জায়গাতেই রেখে দেওয়া হয়। এর মানে হচ্ছে তাঁরা আগের দায়িত্বই পালন করেন, কিন্তু মাঝখান থেকে বেতন-ভাতা বাড়ে। উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা তিন বছর চাকরি পাওয়ার পর বিনা সুদে গাড়ি কেনার জন্য ঋণসুবিধা পান। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, তার দৃষ্টান্তও খুব বেশি নেই। অবসরে যাওয়া প্রশাসন ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও অন্য ক্যাডারের ‘বঞ্চিত’ ৭৮ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে।

জনপ্রশাসনের মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে পরের ধাপে যাবেন, সেটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু পদ না থাকার পরও কেন পদায়ন করা হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন, জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে পদ বাড়ানো যায় কি না। আবার যেখানে এমনিতেই পদের বিপরীতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংখ্যা বেশি, সেখানে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেওয়া কতটা যৌক্তিক?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও জনপ্রশাসনবিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন এম আমিনুজ্জামান বলেছেন, জনপ্রশাসনে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেওয়া যায় না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে মেধাবীদের পদোন্নতি দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এরপরও কেন এমন পদোন্নতি—সেই ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, সরকার সম্ভবত আমলাতন্ত্রের চাপে রয়েছে। এই ধারণা শুধু তাঁর একার নয়, নাগরিক পরিসরের
বিস্তৃত একটি ধারণাও। অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই এর পরিষ্কার ব্যাখ্যা হাজির করা উচিত।

মাথাভারী আমলাতন্ত্র সরকারি সেবা নাগরিকের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে বড় একটা বাধা। অন্যদিকে সরকারকে এখানে বিশাল ব্যয়ের বোঝা বহন করতে হয়। ফলে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ ও গতিশীল জনপ্রশাসনই সবাই প্রত্যাশা করে। জনপ্রশাসনের সব স্তরে পদোন্নতি রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, মেধার ভিত্তিতেই হতে হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ