খাঁচার ভেতরে এক জোড়া কালো ভালুক। এর মধ্যে একটি ভালুকের পেছনের বাঁ পা অবশ হয়ে পড়েছে। ওই পায়ের সব লোম উঠে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষত। স্ত্রী ভালুকটিও সুস্থ নেই। ঝিমিয়ে কাটে দিন। বান্দরবানের মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রের ‘মিনি চিড়িয়াখানায়’ রয়েছে এই দুটি ভালুক। কেবল ভালুক নয়, পর্যটনকেন্দ্রটিতে থাকা ১৩টি মায়া হরিণের মধ্যে ৩টি অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছে।

বন বিভাগ এসব বন্য প্রাণী তাদের কাছে হস্তান্তরের জন্য একাধিকবার চিঠি দিয়েছে পর্যটনকেন্দ্রটির পরিচালনার দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসনকে। এত দিন রাজি না হলেও সম্প্রতি জেলা প্রশাসন মেঘলা পর্যটনকেন্দ্রের মিনি চিড়িয়াখানায় থাকা ২৩টি বন্য প্রাণী বন বিভাগকে হস্তান্তর করতে সম্মত হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের লোকজন এসে প্রাণীগুলো নিয়ে যাবে বলে গত বৃহস্পতিবার বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বান্দরবান জেলা শহরে প্রবেশমুখে মেঘলা পর্যটনকেন্দ্র। সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, একটি ছোট ঘরে ভালুক দুটি রাখা। পুরুষ ভালুকটি চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছে। মেয়ে ভালুকটিও চুপচাপ বসে রয়েছে খাঁচার কোনায়। ভালুকের ঘরের পাশে মায়া হরিণের খাঁচা। সেখানে চারদিকে লোহার বেষ্টনী দিয়ে ছোট–বড় ১৩টি হরিণ রাখা। সব কটি হরিণ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। চলাচল ও আচার-আচরণে স্বভাবগত চাঞ্চল্য নেই। হরিণের খাঁচার ওপরে পৃথক খাঁচায় ছয়টি বানর রয়েছে, কিন্তু বাঁদরামি নেই তাদের। সব কটি বানর শ্রান্ত-ক্লান্ত।

আশপাশের দোকানিরা জানান, আগে চিত্রা হরিণ, অজগরসহ আরও কয়েক প্রজাতির বন্য প্রাণী ছিল। এখন চিত্রা হরিণ নেই, শুধু খাঁচাটি রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে মায়া হরিণ ছিল ১৬টি। গত মাসে তিনটি মারা যাওয়ায় এখন রয়েছে ১৩টি। সেখান থেকেও রোগাক্রান্ত হরিণ তিনটি যেকোনো সময় মারা যেতে পারে। অজগরেরও মৃত্যু হয়েছে।

পর্যটনকেন্দ্রটি পরিচালনা করে জেলা প্রশাসন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মিনি চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো বন বিভাগে হস্তান্তরের জন্য জেলা প্রশাসককে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে বলা হয়, মিনি চিড়িয়াখানায় রাখা পাঁচ প্রজাতির ২৬টি প্রাণী বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে তফসিলভুক্ত। লাইসেন্স বা পারমিট ছাড়া তফসিলভুক্ত বন্য প্রাণী দখলে রাখা, শিকার ও বেচাকেনা আইনের পরিপন্থী এবং তাদের জব্দকরণের বিধান আছে।

বন্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, এসব বন্য প্রাণী হস্তান্তরের জন্য চিঠিটি একবার নয়, আগেও কয়েকবার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জেলা প্রশাসন প্রাণীগুলো হস্তান্তরে রাজি হচ্ছিল না। যেভাবে রাখা হয়েছে, তা কোনোমতেই বন্য প্রাণীর বেঁচে থাকার পরিবেশ নয়। এ জন্য প্রাণীগুলো অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

পায়ের লোম উঠে গেছে পঙ্গু ভালুকটির.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: বন য প র ণ

এছাড়াও পড়ুন:

সেন্ট মার্টিন ভালো নেই, সেন্ট মার্টিনের মানুষ ভালো নেই

অমাবস্যা ও সমুদ্রের নিম্নচাপ একই সময় হওয়ার কারণে উপকূলজুড়ে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে। সেখানকার জনজীবনে দুর্ভোগ ও ক্ষতির পরিমাপ এতটা বেশি যে অনুমান করাও কঠিন।

প্রতিবছর বর্ষায় মোটামুটি দু-তিনটি ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু এত ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস কখনো হয়নি। এত তাণ্ডব কখনো দেখেননি দ্বীপের মানুষ।

২৬ ও ২৭ জুলাই সমুদ্রের নিষ্ঠুর লীলাখেলা দেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। দ্বীপের প্রায় চারপাশ থেকে হু হু করে ঢুকেছে সমুদ্রের পানি। অনেক দিন এমন পানির তোড় দেখেননি দ্বীপের মানুষ।

দ্বীপে যা সামান্য কৃষিকাজ হয়, বিশেষ করে ধান চাষ ও সবজি চাষে এবার জলোচ্ছ্বাসের থাবা পড়েছে। লোনাপানি ঢুকে চাষাবাদের ব্যাপক ক্ষতি করেছে।

সমুদ্রের পাড়ের বাড়ি ও দ্বীপের মাঝখানের নিম্নাঞ্চলে (স্থানীয় ভাষায় মরং বলে) সাগরের পানি ঢোকার কারণে অনেক এলাকায় পানি লবণাক্ত হয়ে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে।

অনেক বাড়ি ও রিসোর্ট সমুদ্রের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের সীমানাপ্রাচীর ভেঙে গেছে।

দ্বীপে কোনো বেড়িবাঁধ না থাকায় এবার জলোচ্ছ্বাস পূর্ণমাত্রায় আঘাত করতে পেরেছে! ফলে পুরোপুরি অনিরাপদ দ্বীপটিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে।

দ্বীপের ভাঙন শুরু মূলত ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে। ওই দুই ঘূর্ণিঝড় দ্বীপের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ আশপাশের পাথরের স্তূপ নড়বড়ে করে দেয়। ফলে দ্বীপের চারপাশের সমুদ্রের স্রোত সমুদ্রগর্ভের পরিবর্তে সৈকত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়।

এতে দ্বীপের উত্তর ও উত্তর–পূর্ব পাশে ব্যাপক ভাঙন হয়। উত্তর পাড়া ও ডেইল পাড়া নামের দুটি পাড়া বিলীন হয়ে যায়। বাসিন্দাদের ১৯৯৭ সালে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় গুচ্ছগ্রাম করে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়।

সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?

সেই ১৯৯১ সাল থেকে আজ অবধি দ্বীপের ভাঙন চলমান। কিন্তু কোনো বেড়িবাঁধ নেই। আবার নতুন করে অপরিকল্পিত রিসোর্ট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণেও সৈকতের বালিয়াড়ি ও কেয়া ঝোপ উজাড় হয়েছে। এতে দ্বীপের ঢেউ প্রতিরোধক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মুরব্বিদের কথায় এবারের মতো জলোচ্ছ্বাস তাঁদের জীবনে দেখেনি। তাঁরা দ্বীপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত। আদৌ দ্বীপে অদূর ভবিষ্যতে বসবাস করতে পারবেন কি না, সেটা নিয়ে তাঁদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দা মনে করেন, এ রকম আর দু–তিনটি জলোচ্ছ্বাস সহ্য করার মতো শক্তি সেন্ট মাটিনের নেই। দ্রুত স্রোতপ্রতিরোধী বাঁধ নির্মাণ করতে না পারলে সেন্ট মার্টিন ইতিহাসের অংশ হয়ে যাবে!

দ্বীপবাসী মনে করে, একটা টেকসই বেড়িবাঁধ যেটা সচরাচর উপকূলীয় অঞ্চলের বেড়িবাঁধের মতো না। কারণ, এখানে কচ্ছপের ডিম দেওয়ার জন্য উপযুক্ত স্থান। ফলে কাছিমের ডিম দিতে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয়, সেভাবে সৈকত থেকে সমুদ্রের দিকে লম্বালম্বি করে বাঁধ দিয়ে স্রোত সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিতে হবে। দক্ষিণ ভারতে এ রকম বাঁধ অনেক কার্যকর প্রমাণিত।

পাশাপাশি দ্বীপের মানুষের আয়ের বিকল্প কর্মসংস্থান বা আয়ের উৎস সৃষ্টি করে পর্যটননির্ভরতা কমাতে হবে। একটা আবাসন নীতিমালা করে দ্বীপে পরিবেশবান্ধব বাড়ি ও ইকো রিসোর্ট করতে উৎসাহিত করতে হবে। যত্রতত্র রিসোর্ট করা বন্ধ করতে হবে। অতিরিক্ত রিসোর্ট কমিয়ে ফেলতে হবে আর যেসব রিসোর্টের বিরুদ্ধে আইনি বাধা আছে, সেগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।

সৈকত, জঙ্গল, খাল ও জলাভূমি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। প্রয়োজনে কিছু জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে বা ক্ষতিপূরণ হলেও সৈকতের ১০০ ফুট পর্যন্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং সে জমিতে বনায়ন করতে হবে। ঝাউগাছের পরিবর্তে ভাঙনপ্রতিরোধী কেয়াগাছ, নারকেল ও সাগরলতা রোপণ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সেন্ট মার্টিন নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক। নানা রাজনীতি। দেশের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র বলতে মানুষ সেন্ট মার্টিনই বোঝেন। কিন্তু সেই সেন্ট মার্টিনের দুর্যোগ ও ভবিষ্যতের শঙ্কা নিয়ে দেশের মানুষের কোনো ভাবনা নেই, এটি খুবই হতাশাজনক। দ্বীপের সুরক্ষা যদি নিশ্চিত করা না হয়, আমরা দ্বীপবাসী কোথায় যাব?

তৈয়ব উল্লাহ, আন্দোলনকর্মী ও সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় বাসিন্দা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সেন্ট মার্টিন ভালো নেই, সেন্ট মার্টিনের মানুষ ভালো নেই