মোমেনা আক্তার। ৪৫ বছর বয়সী এ নারী বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের এক প্রতিচ্ছবি। তাঁর দিন শুরু হয় ভোরে, রান্নাঘরে চুলার ধোঁয়ার মাঝে। সকালের খাবার তৈরি শেষে তিনি স্বামী ও ছেলের সঙ্গে মাঠে যান। সেখানে ধান, আলু, ভুট্টা, ডাল– এসব চাষের কঠোর পরিশ্রমে তিনি সমানভাবে অংশ নেন। মাঠের কাজ শেষ হলে ঘরে ফিরে আবার শুরু হয় রান্না, মাড়াই, পানি আনা– এমন অসংখ্য কাজের ধারাবাহিকতা। মোমেনা একজন নারী কৃষক, যাঁর জীবন-সংসার আর কৃষির শ্রমের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। তিনি বলেন, ‘স্বামী ও ছেলের সঙ্গে আমি মাঠে কাজ করি। তারপরও ঘরের কাজ, রান্না সবই করি। যদি তারা অন্য কৃষকের কাছ থেকে কাজ নিত, তাহলে তাঁকে অনেক মজুরি দিতে হতো। আমি তো প্রতিদিন মাঠে পুরুষের মতো কাজ করি। আমার কাজের মূল্য কেউ দেয় না।’
মোমেনার স্বামী ও ছেলে মাঠের কাজ শেষে আড্ডায় মেতে ওঠেন বা বাজারে চা খেতে যান। মোমেনার জন্য এমন কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ঈদ ছাড়া কখনোই আমাকে নতুন জামাকাপড় কিনে দেয় না। শুধু পুরুষদের শ্রমকেই সম্মান করা হয়। আমাদের শ্রমের দাম নেই।’
এ অভিজ্ঞতা মোমেনার একার নয়। বাংলাদেশের লাখো নারী কৃষকের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতা এমন। তারা মাঠে পুরুষের সমান কাজ করেন। মজুরি ও সম্মানে পিছিয়ে থাকেন। তবুও মোমেনার একটি স্বপ্ন আছে– একদিন নারীর কৃষি শ্রমের জন্য সমান মূল্যায়ন হবে এবং তাদের জীবনযাত্রা আরও ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারবেন।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘স্ট্যাটাস অব উইমেন ইন এগ্রিকালচার সিস্টেম-২০২৩’ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ছিল ৪৫.
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, কৃষি খাতে জড়িত প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৮৪ লাখই নারী, যা মোট কৃষি শ্রমশক্তির প্রায় ৫৮ শতাংশ। নারী শুধু ধান চাষেই নয়, পোলট্রি, ডেইরি এবং বাণিজ্যিক সবজি চাষেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ১০ লাখ ক্ষুদ্র খামার রয়েছে, যার ৬০ শতাংশ গ্রামীণ নারীর দ্বারা পরিচালিত। এ ছাড়া বিশ্বব্যাপী ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের ৯০ শতাংশ পালন নারীর হাতে, যার বড় অংশ বাংলাদেশে।
তবে এ অবদানের পরও নারী কৃষকের শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষ কৃষি শ্রমিকরা দৈনিক গড়ে ৪৫০ টাকা মজুরি পান, যেখানে নারীরা একই কাজের জন্য মাত্র ৩০০ টাকা পান। এ বৈষম্যের পেছনে রয়েছে সামাজিক ধারণা, যেখানে নারীর শ্রমকে পুরুষের তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ফলে পুরুষ শ্রমিকরা শহরমুখী হচ্ছেন। ফলে নারীর কৃষিকাজে অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। এ বর্ধিত অংশগ্রহণের সঙ্গে তাদের আর্থিক ও সামাজিক মর্যাদা বাড়েনি। নীতিনির্ধারণ, প্রশিক্ষণ, কৃষিঋণ বা জমির মালিকানায় নারীর অংশগ্রহণ এখনও অনেক কম। এ অবমূল্যায়ন এবং ক্ষমতায়নের অভাব তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘সকাল থেকে রাত পর্যন্ত নারী ঘরের কাজ করে, এটা এখন পুরোনো কথায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান গ্রামবাংলায় অধিকাংশ নারী ধান মাড়াই, বিজ রোপণসহ সব কৃষিকাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। তবে নারীর শ্রমের মূল্যায়ন ততক্ষণ পর্যন্ত থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের অংশগ্রহণ থাকে। যখন শ্রমের বিনিময়ে অর্থ উপার্জিত হয়, তখন নারীর সেই অর্থের অধিকার বা দেখভাল করার সুযোগ থাকে না। ফলে অপ্রাপ্তি ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি উন্নয়নের জন্য নারীর কাজের স্বীকৃতি জরুরি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ২০১২ সাল থেকে গৃহকর্মী ও নারীর সংসারের কাজের স্বীকৃতি দাবি করছে। এ স্বীকৃতি মিললে কিষানির কাজের স্বীকৃতি আদায়ও সম্ভব হবে, যা কৃষি খাতের উন্নয়নে সহায়ক হবে।’
মোমেনা আক্তারের মতো নারী কৃষকরা বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড। নারীর কৃষি শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করা শুধু সামাজিক ন্যায়বিচার নয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর চেষ্টা সিনেটে ব্যর্থ
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক নিন্দার মধ্যে, ইসরায়েলের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি আটকাতে মার্কিন সিনেটে তোলা একটি বিল পাস হতে ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যর্থ হলেও, বুধবারের ভোটে দেখা গেছে, মার্কিন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভেতরে ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরোধিতা জোরদার হয়ে উঠেছে।
আজ বৃহস্পতিবার কাতারভিত্তিক আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি ঠেকানোর প্রচেষ্টায় এবারের ভোটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যাক ডেমোক্র্যাট যোগ দিয়েছেন।
ইসরায়েলের কাছে ২০ হাজার স্বয়ংক্রিয় অ্যাসল্ট রাইফেল বিক্রি বন্ধ করার প্রস্তাবের পক্ষে ২৭ জন ডেমোক্র্যাট ভোট দিয়েছেন, আর ৬৭৫ মিলিয়ন ডলারের বোমার চালান বন্ধ করার পক্ষে ২৪ জন ভোট দিয়েছেন।
অন্যদিকে, ভোটদারকারী সব রিপাবলিকান সিনেটররা প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের চলমান হামলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির দুটি চুক্তি আটকে দিতে প্রস্তাবগুলো সিনেটে আনেন ভার্মন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। তিনি প্রগতিশীল ঘরানার স্বতন্ত্র সিনেটর।
ভোটের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে স্যান্ডার্স বলেন, “ওয়াশিংটন ইসরায়েলের ‘বর্ণবাদী সরকার’কে এমন অস্ত্র সরবরাহ করা চালিয়ে যেতে পারে না, যা নিরীহ মানুষদের হত্যা করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।”
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে একজন ‘জঘন্য মিথ্যাবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করে স্যান্ডার্স ‘এক্স’ পোস্টে আরো বলেন, “গাজায় শিশুরা না খেয়ে মারা যাচ্ছে।”
প্রথমবারের মতো স্যান্ডার্সের প্রস্তাবকে সমর্থনকারী আইন প্রণেতাদের মধ্যে, ওয়াশিংটন রাজ্যের সিনেটর প্যাটি মারে বলেছেন, প্রস্তাবগুলো ‘নিখুঁত’ না হলেও, তিনি গাজার নিষ্পাপ শিশুদের অব্যাহত দুর্ভোগকে সমর্থন করতে পারেন না।
মারে এক বিবৃতিতে বলেন, “ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও আমি প্রস্তাবের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিচ্ছি এই বার্তা দিতে: নেতানিয়াহু সরকার এই কৌশল চালিয়ে যেতে পারবে না।”
তিনি বলেন, “নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকার জন্য প্রতিটি পদক্ষেপে এই যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করেছেন। আমরা গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ প্রত্যক্ষ করছি- সীমান্তের ওপারে যখন প্রচুর পরিমাণে সাহায্য ও সরবরাহ পড়ে আছে, তখন শিশু এবং পরিবারগুলোর অনাহার বা রোগে মারা যাওয়া উচিত নয়।”
মার্কিন জনগণের মধ্যে গাজা যুদ্ধের বিরোধিতা ক্রমবর্ধমান হওয়ার পাশাপাশি ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আকারে বিভক্তি দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত গ্যালাপের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ আমেরিকান বলেছেন, তারা গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সমর্থন করেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৪২ শতাংশ আমেরিকান ইসরায়েলের অভিযান সমর্থন করেছিলেন।
গ্যালাপের মতে, পরিচয় প্রকাশ করে মাত্র ৮ শতাংশ ডেমোক্র্যাট বলেছেন যে তারা ইসরায়েলের অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, যেখানে ৭১ শতাংশ রিপাবলিকান বলেছেন জানিয়েছেন যে, তারা ইসরায়েলি পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন।
ঢাকা/ফিরোজ