বাংলা নতুন বছরের প্রথম সকালে মা হয়েছেন রুহেনা বেগম (২২)। নির্ধারিত তারিখের আগে স্বাভাবিকভাবে প্রসব হয়েছে তাঁর ছেলেসন্তানের। সমকালের প্রজন্ম বরণের কথা শুনে লজ্জায় তিনি মুখ লুকিয়ে ফেলেন ওড়নায়। সেই কক্ষে কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে বিষয়টি শুনে আপ্লুত হয়ে ওঠেন নবজাতকের বাবা হাবিবুর রহমান। তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা শুনে রুহেনা বলে ওঠেন, ‘আইজ কিতা পয়লা বৈশাখ নি? বড়ো ভালা দিনে পুয়া (ছেলে) জন্ম নিছে।’

আগের রাতটি মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডে তীব্র যন্ত্রণায় কেটেছে এই গৃহবধূর। তাঁর বাবার বাড়ি সিলেটের বালাগঞ্জের পূর্ব পৈলনপুর ইউনিয়নের কিচ্যা জালালপুর। গত বছর রুহেনার বিয়ে হয় একই ইউনিয়নের ঐয়া গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বরিশালের একটি চীনা পাওয়ারপ্লান্টে কর্মরত। সন্তান প্রসবের আলামত শুনে দ্রুত বাড়িতে ফেরেন রোববার। কুশিয়ারা নদীপথ ও সড়ক পাড়ি দিয়ে এদিন বেলা ৩টার দিকে মৌলভীবাজার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রুহেনাকে।

রুহেনার সঙ্গে এসেছিলেন তাঁর মা আলিমা বেগম (৫২)। তিনি জানান, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মেয়ের প্রসবব্যথা তীব্র হতে থাকে। কখনও কমে, কখনও বাড়ে– এমন অবস্থা চলে ভোর পর্যন্ত। সোমবার ৫টার দিকে ব্যথা মাত্রা ছাড়ায়। তখন দুই নার্স রুহেনাকে নিয়ে যান প্রসূতি কক্ষে। অস্ত্রোপচার ছাড়াই স্বাভাবিক প্রসবের চেষ্টা শুরু করেন। বাইরে দাঁড়িয়ে সুরা তেলাওয়াত করতে করতে আল্লাহর কাছে দয়াপ্রার্থনা করে যাচ্ছিলেন আলিমা ও জামাতা হাবিবুর।

অবশেষে সোমবার সকাল ৫টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালের এক আয়া তাদের জানান, ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন রুহেনা। এ সময় সব আতঙ্ক ছাপিয়ে আনন্দরেখা ফুটে ওঠে আলিমার মুখে। সকাল ৭টার দিকে নাতি কোলে নিয়ে আগের রাতের বর্ণনা দেন তিনি। পানখাওয়া ঠোঁটে তখন তৃপ্তির চিত্র।

কিছুক্ষণ পরই বিছানায় ফিরিয়ে দেওয়া হয় রুহেনাকে। সেখানে সাংবাদিক দেখে লজ্জায় মুখ লুকান তিনি। তাঁর স্বামী হাবিবুর রহমানকে সমকালের প্রজন্ম বরণের কথা জানালে তিনি বলেন, ‘এতো আমাদের সৌভাগ্য। বছরের পহেলা দিন ফজরের আজান শুনে পুবাকাশে সুরুজ ওঠার লগে লগে আমাদের ছেলে দুনিয়ার আলোর মুখ দেখেছে।’ স্ত্রীকে সংকোচ-লজ্জা সামলে নেওয়ার অভয় দিলে প্রসবযাতনা সামলে ওঠেন রুহেনা। লাজুক হাসিতে বলেন, ‘আইজ কিতা পয়লা বৈশাখ নি? বড়ো ভালা দিনে পুয়া (ছেলে) জন্ম নিছে। তার জন্মতারিখ ভুল পরবো না কোনোদিন।’

রুহেনা বলে ওঠেন, ‘সমকাল পত্রিকার ইতা রেকর্ডিং তো নেটে সারা দুনিয়ার মাইনষে দেখতে পারবো। গরিবের পোয়া জন্মায়াই পত্রিকার খবর হই গেছে।’ বলেই লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরেন সদ্যপ্রসূতি এই তরুণী।

এরই মধ্যে রুহেনার চোখমুখে কিছুটা যন্ত্রণার চিহ্ন দেখে স্বামী হাবিব বলেন, তাঁর স্ত্রী মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছে। যে কারণে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে বেড়ে উঠেছে। তাই সে স্বভাবেও লাজুক। গত বছর পারিবারিকভাবেই পাশের গ্রামে বিয়ে করেন। কমিউনিটি ক্লিনিকের এক স্বাস্থ্যকর্মী তাদের জানিয়েছিলেন, কয়েকদিন পরই সন্তান প্রসব করবেন রুহেনা। তবে আগেই ব্যথা অনুভব হওয়ায় ঝুঁকি না নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেন। হাবিব বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে সিজার লাগেনি, শরীরে কাটাকাটি না লাগায় আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।’

ভিডিওচিত্র ধারণের সময় একবারের জন্যও চোখ খোলেনি নবজাতক। আচ্ছন্ন ছিল গভীর ঘুমে। এরই মধ্যে তোয়ালে পেঁচানো অবস্থায় কখনও বাবার কোলে, কখনও নানুর কোলে যাচ্ছিল শিশুটি। দুই নার্স মিলু পাল ও তাহমিনা আক্তার তাদের সার্বিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন। মিলু পাল বলেন, সোমবার ৫টা ৫০ মিনিট ও সোয়া ৬টার দিকে তারা দুটি স্বাভাবিক প্রসব করিয়েছেন। রুহেনা বেগম ও তাঁর নবজাতক সুস্থ আছে। নববর্ষের ছুটি থাকায় শিশুটিকে এদিন জন্মের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া যায়নি।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শ শ র জন ম প রসব

এছাড়াও পড়ুন:

‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’

এবারের বাবা দিবস আমার কাছে একটু অন্যরকম। চারপাশ যেন কিছুটা বেশি নিস্তব্ধ, হৃদয়ের ভেতর যেন একটু বেশি শূন্যতা। কারণ এবার প্রথমবারের মতো আমার আব্বাকে ছাড়াই কাটছে দিনটি। আব্বা চলে গেছেন গত জানুয়ারিতে। ফলে বাবা দিবস এখন আর কেবল উদযাপনের দিন নয়– এটি হয়ে উঠেছে স্মরণ, অনুধাবন ও আমার জীবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উপলক্ষ। আব্বা না থেকেও আছেন, তবে এক ভিন্ন অনুভবে– আমার নীরব নিঃশব্দ অভিভাবক হয়ে।    

আমাদের সমাজে কিংবা বলা যায় পারিবারিক সংস্কৃতির বাবারা সবসময় প্রকাশের ভাষায় ভালোবাসা বোঝান না। তাদের স্নেহ, দায়িত্ববোধ ও নিবেদন অনেক সময়েই নীরব থাকে, তবে গভীরভাবে অনুভব করা যায়। আমার আব্বাও ছিলেন তেমনই একজন। আব্বা ছিলেন আমার দিকনির্দেশক, আমার রক্ষাকবচ, আমার জীবনপথের চুপচাপ ভরসা। 

আব্বার অ্যাজমা ছিল, তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যসচেতন। নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিতেন, আমাদের প্রতিও ছিল তাঁর সজাগ দৃষ্টি। আমি কিংবা আমার মেয়ে সামান্য অসুস্থ হলেই তিনি অস্থির হয়ে যেতেন। তাঁর যখন ৭৯ বছর বয়স, তখনও আমি ডাক্তারের কাছে একা যেতে গেলে বলতেন, ‘তুমি একা যাবে কেন? আমি যাচ্ছি।’ এই কথা বলার মানুষটাকে প্রতি পদে পদে আমার মনে পড়ে, যেন দূর থেকে দেখছেন সবই। আর আমিও তাঁর কনুই-আঙুল ধরে হেঁটে যাচ্ছি জীবনের পথে।    

আব্বা ছিলেন একজন পুরোদস্তুর ধার্মিক মানুষ। শৈশব থেকে নামাজের গুরুত্ব তিনি আমার মধ্যে গভীরভাবে বপন করার চেষ্টা করে গেছেন। কখনও নরম সুরে, আবার কখনও খুব জোর গলায়। তখন মনে হতো তিনি চাপ দিচ্ছেন; কিন্তু এখন তাঁর অনুপস্থিতির নিস্তব্ধতায় আমি সেই কণ্ঠস্বরের জন্য আকুল হই।

অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে কিংবা আত্মীয়ের বা বন্ধুর বাসায় গেলে বাবার ফোন আসত, ‘কোথায়? কখন ফিরবি?’ সেসব ফোন একসময় মনে হতো আব্বার বাড়াবাড়ি। এখন মনে হয়, একটাবার হলেও যদি ফোনে তাঁর নামটা দেখতাম! ছোট ছোট এসব প্রশ্ন– এই উদ্বেগই তো ছিল নিঃশব্দ ভালোবাসা। এগুলোই ছিল বাবার নিজের মতো করে যত্ন নেওয়ার ভাষা। সেই ভাষাটাই আজ আর শোনা যায় না। আব্বা নেই, এখন জীবনযাপনে এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।

আব্বা ছিলেন একজন ব্যাংকার। হয়তো চেয়েছিলেন আমি তাঁর পেশার ধারাবাহিকতা বজায় রাখি। কিন্তু কোনোদিন চাপ দেননি। বরং নিজের ইচ্ছেমতো পথ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন; ছায়ার মতো পাশে ছিলেন। আব্বাই আমাকে নিজের ওপর আস্থা রাখতে শিখিয়েছেন। বিয়ে করেছি, বাবা হয়েছি, নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়েছি– তবুও বাবার সেই গাইডেন্স কখনও ফুরায়নি। আব্বা কখনও অর্থ বা অন্য কোনো সহায়তার কথা বলেননি; বরং সবসময় নিজে থেকেই পাশে থেকেছেন। মনে পড়ে, একবার মেয়ের অসুস্থতার সময় আমি অর্থকষ্টে ছিলাম, কিছু বলিনি তাঁকে। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝে গিয়েছিলেন, পাশে থেকেছেন।

এখন অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় মনে হয়, ‘বাবা হলে কী করতেন?’ তাঁর শিক্ষা, অভ্যাস, স্নেহ– সবকিছু এখন আমার আচরণে, আমার সিদ্ধান্তে, আমার ভালোবাসায় প্রতিফলিত হয়। তাঁকে ছুঁতে না পারলেও আমি প্রতিদিন তাঁর উপস্থিতি অনুভব করি– স্মৃতিতে, নৈঃশব্দ্যে, নানা রকম ছোট ছোট মুহূর্তে।

এই বাবা দিবসে আব্বার কোনো ফোন আসবে না, থাকবে না কোনো উপহার বা আলিঙ্গনের মুহূর্ত; যা আছে সেটি হলো আব্বার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা আর অপার ভালোবাসা। যিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সন্তানদের শুধু দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চাননি কখনোই। তাঁর জীবনদর্শন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি– এগুলোই নিজের জীবনে ধারণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি, হয়তো পুরোপুরি পারছি না; কিন্তু আমার মনে হয় এ চেষ্টাটাই আমার জীবনে শৃঙ্খলা এনেছে।

বাবাকে হারানোর শোক যেমন গভীর, তেমনি গভীর তাঁর রেখে যাওয়া ভালোবাসা। নিজের অনুভবকে চাপা না দিয়ে, বরং বাবাকে নিজের ভেতরে জায়গা দিন। বাবার কথা বলুন, তাঁর শেখানো পথে হাঁটুন। কারণ প্রিয় মানুষরা চলে যান বটে, কিন্তু তাঁদের ভালোবাসা থেকে যায় সবসময়।

লেখক: কমিউনিকেশনস প্রফেশনাল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘ভালোবাসার আসল রূপটাই যেন ছিলেন আব্বা’
  • বর্ষার শুরুতেই সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টির বার্তা
  • টানা সাত দিন সারাদেশে বৃষ্টি ঝরবে
  • অর্ধশত বছরের চামড়ার মোকাম রাজারহাট
  • সিদ্ধিরগঞ্জে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে সোর্স ইকবালের ডাকাতি