বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পরেও সাংবাদিকেরা হামলার শিকার হচ্ছেন। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে তাঁদের নিশানা করা হচ্ছে। অনেক সাংবাদিকের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। কয়েকটি গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের (আইজেনেট) এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আইজিনেট যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টের (আইসিএফজে) একটি প্রকল্প। সোমবার বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পরিস্থিতি নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তারা।

আইজিনেটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম জগতে বড় পরিবর্তন এসেছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা, তাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা ছাড়াও ১৬৭ সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশের শীর্ষ দুই গণমাধ্যম—প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। বিষয়টি আইজেনেটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি খ্যাতিমান গণমাধ্যমে মালিকানার কাঠামোয় বদল এসেছে বলে উল্লেখ করেছে আইজিনেট। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় ছিলেন আওয়ামী লীগ–সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকেরা। ওই পদগুলোয় এখন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী–সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকেরা বসেছেন। সরকার পতনের পর সংবাদপত্র, টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন নিউজ পোর্টালে ২৯টি নেতৃত্বস্থানীয় পদে এমন বদল এসেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি দল সাংবাদিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা শুরু করেন। তাঁরা মনে করেন, ওই সাংবাদিকেরা ‘সাংবাদিকতার আড়ালে রাষ্ট্র ও জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত।’ এসব সাংবাদিকের অনেকে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, আত্মগোপন করেছেন অথবা পেশাগত কার্যক্রম বন্ধ করেছেন। আর অন্যরা আইনি পদক্ষেপের মুখে পড়েছেন ও গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের (সিপিজে) এশিয়া কর্মসূচি সমন্বয়ক বেহ লিহ ই বলেন, ‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত ভিত্তিহীন ফৌজদারি মামলা ও তাদের আটক, বিভিন্ন মিডিয়া গ্রুপকে নিশানা করা ও ভাংচুরের ঘটনায় আমরা বিরক্ত। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর এই হামলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে বেহ লিহ ই আরও বলেন, ‘নতুন এই রাজনৈতিক যুগে পূর্ববর্তী সরকারের পদ্ধতিগুলো পুনরাবৃত্তি করা যাবে না; সমালোচক ও সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু করতে আইনকে ব্যবহার করা যাবে না। একই সময়ে গণমাধ্যমগুলোকে নৈতিকতার সঙ্গে সাংবাদিকতা করতে হবে এবং প্রতিশোধের ভয় ছাড়াই তাদের সংবাদ প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আইজ ন ট

এছাড়াও পড়ুন:

নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাক

লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকটি নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যে জটিলতা তৈরি হয়েছিল, তার অবসান হবে আশা করা যায়। নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়ে দুই পক্ষই নীতিগতভাবে একমত হয়েছে যে ২০২৬ সালের রোজার আগে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। 

সাম্প্রতিক কালে নানা বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপি নেতৃত্বের বিরোধ লক্ষ করা যাচ্ছিল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে বিএনপি–দলীয় প্রার্থী ইশরাক হোসেনের শপথ ইস্যু সেই বিরোধকে আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সর্বশেষ বৈঠকে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি ও আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করে।

কিন্তু ঈদুল আজহার আগের রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন। প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণার ব্যাপারে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানায়। এর আগে বিএনপির নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনে তিনজন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করে। 

এমনই একটি পরিস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরের সময় লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বৈঠকের ঘোষিত যৌথ বিবৃতিতে নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়টি সামনে এলেও দুই পক্ষের আলোচনা কেবল এর মধ্যে সীমিত ছিল না। প্রধান উপদেষ্টার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি সুন্দর নির্বাচন অনুষ্ঠান ও সংস্কারের ধারাবাহিকতার ওপরও জোর দেন তঁারা। 

বৈঠকের ফলাফলকে প্রায় সব দলই স্বাগত জানিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণার ধরন নিয়ে আপত্তি জানালেও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সরাসরি বিরোধিতা কেউ করেনি। আমরাও মনে করি, কোনো বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদ দেখা দিলে আলোচনার মাধ্যমেই তা সমাধান করতে হবে।

জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ যারা সংস্কার ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। লন্ডন বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার ও বিচারকাজ দৃশ্যমান করার ওপর জোর দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যাতে দেশে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরাগমন না ঘটে, সে জন্য রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি ত্বরান্বিত করা জরুরি। আবার অপরাধ করে যাতে কেউ পার না পায়, সে জন্য জুলাই-আগস্টের হত্যার বিচারও অপরিহার্য। কিন্তু এই দুটি বিষয়কে কোনোভাবে নির্বাচনের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা সমীচীন হবে না।

যেসব সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নির্বাচন ও সংবিধানের বিষয়টি জড়িত নয়, সেগুলো সরকার নির্বাহী আদেশেও বাস্তবায়ন করা যায়। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে তেমন বাধা আসার কথা নয়। তবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার অর্থ এই নয় যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। এখন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা না থাকলে সরকার একা কাজটি করতে পারবে না। 

ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তর্দলীয় ও আন্তদলীয় সংঘাতের যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনে না চললে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। আমরা আশা করি, দিন-তারিখের বিষয়ে সমঝোতার পর নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবেন। রাজনীতিতে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে; তাই বলে একে অপরকে ‘শত্রুজ্ঞান’ করার পুরোনো সংস্কৃতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ