আজ, বুধবার, রাজধানীর জিগাতলা থেকে তেজগাঁও আসতে সময় লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা! তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা এলাকায় পলিটেকনিকের একদল শিক্ষার্থী ৬ দফা দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে। সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা ৯ ঘণ্টা পর সড়ক ছাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই, এতে যানজট সাতরাস্তার আশপাশ ছেড়ে রাজধানীর অন্যান্য এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে, জনভোগান্তি বেড়ে যায়।
  
প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ করা নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। কিন্তু কোন নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আমরা সমাবেশ কিংবা বিক্ষোভ করি– সেটিও ভেবে দেখা দরকার। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেগটাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেসন ব্রেনানের নাগরিক অধিকার ও বিক্ষোভ বিষয়ক একটি বই প্রকাশ পেয়েছিল। বইটির শিরোনাম ‘হোয়েন অল এলস ফেইলস– দ্য এথিক্স অব রেজিস্ট্যান্স টু স্টেট ইন জাস্টিস’। এতে ব্রেনান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকারের অন্যায্য আচরণের পাল্টা জবাব হিসেবে জার্মান অর্থনীতিবিদ ও তাত্ত্বিক আলবার্ট হার্সমেন প্রদত্ত তত্ত্বের বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। 

হার্সমেনের মতে, নাগরিকরা সরকারের অন্যায্য আচরণে তিনটি পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এক.

সরকারকে অসহযোগিতা বা ত্যাগ করা; দুই. অভিযোগ তোলা; তিন. সম্মতি দেওয়া। ব্রেনান তার বইটিতে নতুন করে আরেকটি জবাব যুক্ত করেন। তাঁর মতে, যখন কোনো সরকার আমাদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে তখন আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারি। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান ব্রেনান প্রস্তাবিত জবাবের যথাযথ দৃষ্টান্ত।
 
দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে প্রায়শই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের নামে জনভোগান্তির ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকেই আমরা এ ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা দেখে আসছি। কিন্তু যেসব দাবি-দাওয়া টেবিলে বসে মীমাংসা করা যায়, সেগুলোর ব্যাপারে নাগরিকদের অবস্থান কী হবে? এ ব্যাপারে আলবার্ট হার্সমেনের দেওয়া প্রস্তাবগুলো গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রয়োগ হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে তেমন কাজে লাগে না। এ কারণে প্রায়শই যে কোনো দাবি তুলে জনগণ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে। কখনও কখনও তা সহিংসতায় রূপ নেয়। সেই প্রেক্ষিতে জেসন ব্রেনানের দেওয়া পাল্টা জবাব হিসেবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রশ্নটি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। হার্সমেনের প্রস্তাবিত জবাবগুলো আমাদের দেশে কাজে না লাগার অন্যতম প্রধান কারণ সরকার নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে না। ফলে জনগণ সহসাই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে।  

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সোয়াসের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুশতাক খান দেখিয়েছেন, বিশেষ বিশেষ নীতি ভিন্ন ভিন্ন দেশে আলাদা আলাদা ফল নিয়ে আসে। একে তিনি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ সামাজিক প্রেক্ষিতের ওপর ভিত্তি করে একেকটা দেশে একই নীতি ভিন্ন ফলাফল দেয়। এ কারণে হার্সমেনের প্রস্তাবিত নাগরিক-জবাব কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা সুইডেনে কাজে লাগলেও বাংলাদেশে কার্যকর ফল দেয় না।   

সড়ক অবরোধ করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়িয়ে দাবি তোলার সমস্যাটি প্রধানত আমাদের রাজনৈতিকভাবে মীমাংসা করতে হবে। সরকার যখন ওয়াদা দিয়ে তা পূরণ করে না, তখনই এ ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। নিশ্চয় এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, প্রশাসনিকসহ বিচিত্র বিষয় জড়িত থাকে। সেজন্য সরকার যত বেশি নাগরিক অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, তত বেশি সমস্যার নিরসন সম্ভব হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়নে বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলও ভয়াবহভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই তখন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামা যেত না। গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের হার অনেক বেড়ে যায়। এতে নাগরিকদের দাবি-দাওয়া তোলার পরিসর বিস্তৃতিরই প্রমাণ বহন করে। কিন্তু দাবি তুলে সড়ক অবরোধের কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। এটা কোনোভাবে কাম্য নয়। 

নাগরিক অধিকার ও অন্যান্য দাবিগুলো আমাদের সামষ্টিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। আমরা বহু সমস্যায় জর্জরিত। আরও হতাশার ব্যাপার, সমস্যাগুলো দিন দিন বাড়ছে, কোনোভাবেই কমছে না। এটা আমাদের সামষ্টিক দুর্বলতা ও অক্ষমতার প্রমাণ। বিশেষ কোনো পয়েন্টে যানজট লাগলে পুরো শহরে তার প্রভাব পড়ে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে প্রশাসক, ডজন ডজন বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। অথচ পাঁচ দশকেও একটা জাতি তার রাজধানী শহরের যানজটের মতো মৌলিক সমস্যার সমাধান দিতে পারল না। কত দুর্ভাগ্য আমাদের! 

সাতরাস্তা এলাকায় পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ এই রাষ্ট্রের বহু অব্যবস্থাপনার একটি মাত্র! এসব ছোট ছোট সমস্যা মিলে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বিস্ফোরণ ঘটেছে। সুতরাং, অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দাবি-দাওয়া নিরসন করা। 

ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
iftekarulbd@gmail.com 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সড়ক অবর ধ সড়ক অবর ধ ব ক ষ ভ কর র জন ত ক প রস ত ব সরক র র র অন য আম দ র সমস য

এছাড়াও পড়ুন:

শাবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর সেমিনার

জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের করা তদন্ত প্রতিবেদন ও সুপারিশের ওপর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুর ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনি অডিটোরিয়ামে এ সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

আরো পড়ুন:

শাকসুর নির্বাচন কমিশন ঘোষণা

শাকসুর রোডম্যাপের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচি

অনুষ্ঠানের আয়োজন করে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এবং সহযোগিতায় ছিলেন ইউএন রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটরস অফিস (ইউএনআরসিও)।

সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এএম সরওয়ার উদ্দিন চৌধুরী।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাজেদুল করিম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন, রাজনৈতিক অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক ও অধ্যাপক ড. দিলারা রহমান।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস অফিসার জাহিদুল হোসেন।

তিনি বলেন, “ইউএন ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে আমরা বাংলাদেশ সরকারকে মোট ৪৩টি সুপারিশ করেছি। এ সুপারিশগুলো সবার পড়া উচিত। পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত যা ঘটেছে, জাতিসংঘ সেটিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছে।”

তিনি আরো বলেন, “আমরা এই আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে করছি, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক। রাষ্ট্র হলো শরীর, আর ছাত্ররা দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। বাংলাদেশের দুই ধরনের অপরাধ আছে— দেওয়ানী ও ফৌজদারি। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, কিন্তু রাষ্ট্র যখন জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালায়, তখনই মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটে। রাষ্ট্র যদি কোনো সিস্টেমকে দমন বা হরণ করে, তখন তা মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়।”

জাহিদুল হোসেন আরও বলেন, “জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হেলমেট বাহিনী যে সহিংসতা ঘটিয়েছে, তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, কারণ রাষ্ট্র তাদেরকে সহযোগিতা দিয়েছে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্ট আকাশ থেকে পড়েনি—বাংলাদেশে যা ঘটেছে, সেটিই এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই এই রিপোর্ট সবাইকে পড়া উচিত।”

উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ. এম. সরওয়ারউদ্দিন চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশে এক অদ্ভুত ধরনের সরকারের বিরুদ্ধে এই বিপ্লব হয়েছিল— আয়নাঘর সরকার, রাতের ভোটের সরকার। যারা এ সরকারের পতনে ভূমিকা রেখেছেন, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই। জুলাই চেতনা ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। শেখ হাসিনার ভুয়া ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার জনগণের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।”

এছাড়া অনুষ্ঠানে জুলাই বিপ্লবে শহীদ নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান তুরাবের বড় ভাই আবদুল জাবের উপস্থিত থেকে স্মৃতিচারণ ও বক্তব্য রাখেন।

সেমিনার শেষে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টভিত্তিক প্রকাশনা, মানবাধিকার সংক্রান্ত বই, নীতিমালা ও স্মারক টি-শার্ট বিতরণ করা হয়।

ঢাকা/ইকবাল/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • রূপগঞ্জে ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষে লিফলেট বিতরণ 
  • শাবিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর সেমিনার