মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রধান রুট টেকনাফ স্থলবন্দর। এই বন্দর দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পণ্য আনা-নেওয়ার কার্যক্রম চলে আসছে। তবে গত এক বছর রাখাইন রাজ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর জান্তা সরকারকে পরাস্ত করে আরাকান আর্মি। সীমান্তে মিয়ানমারের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। নাফ নদের ওপারে মিয়ানমার অংশেও আরাকান আর্মি প্রায় একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করে। রাখাইন জান্তা সরকারের হাতছাড়া হওয়ার প্রভাব ধীরে ধীরে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে বাণিজ্যে পড়তে শুরু করে। এখন টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে পণ্য আনা-নেওয়া বন্ধ রয়েছে। বন্দরে পড়ে আছে ২০ হাজার বস্তা সিমেন্ট। গত মাসের শেষ পর্যায়ে সিমেন্টের শেষ চালান যায় মিয়ানমারে। গত ৯ মার্চের পর আর কোনো পণ্যের চালান প্রতিবেশী দেশটিতে যায়নি।
বন্দর থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমারের নানা ধরনের ৮ হাজার ৮০০ টন পণ্য এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসেছিল ৭৮ হাজার ৫২৭ টন। এর আগের অর্থবছরে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসেছে ১ লাখ ৯৯ হাজার ২২৫ টন পণ্য।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে জুন-নভেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ স্থলবন্দর হয়ে মিয়ানমারে পণ্য গেছে মাত্র ৩১০ কেজি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গেছে ১ হাজার ৪০৮ টন। আগের অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৫২৩ টন পণ্য।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের কাঠ, হিমায়িত মাছ, শুকনা সুপারি, পেঁয়াজ, আদা, শুঁটকি, নারকেল, ডাল, আচার প্রভৃতি পণ্য আমদানি হয়। বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে যায় আলু, প্লাস্টিক পণ্য, সিমেন্ট, তৈরি পোশাক, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস ও কোমল পানীয়।
গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ৪ হাজার ৮০০ টন (৯৫ হাজার ৭০০ বস্তা) সিমেন্ট রপ্তানি হয়েছে। অধিকাংশ সিমেন্ট গেছে আরাকান রাজ্যে।
সীমান্তকেন্দ্রিক একাধিক সূত্র জানায়, সিমেন্ট দিয়ে রাখাইনে কোনো বাঙ্কার ও সুড়ঙ্গ যাতে তৈরি হতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সতর্ক রাখা হচ্ছে। তাই বন্ধ আছে সিমেন্ট রপ্তানি।
সীমান্তে নজর রাখেন– এমন এক কর্মকর্তা বলেন, আরাকান আর্মি সীমান্ত ছাড়াও রাখাইনে নজরদারি বাড়িয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তে তাদের অভ্যন্তরে বাঙ্কার নির্মাণ করছে। এমনকি তাদের কাছে অত্যাধুনিক জ্যামারসহ নানা প্রযুক্তি রয়েছে। তারা হেলিকপ্টার ও এয়ারলাইন্সের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারে।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক জসিম উদ্দিন সমকালকে বলেন, বন্দরে সীমিতভাবে পণ্য আনা-নেওয়া চলছে। এটা এক ধরনের বন্ধ হওয়ার অবস্থা। গত সপ্তাহে কয়েক টন আলু গেছে। মার্চের পর কোনো সিমেন্ট যায়নি। ২০ হাজার বস্তার মতো সিমেন্ট বন্দরে পড়ে আছে। কবে পাঠানোর অনুমতি পাব জানি না। রাখাইনের পরিস্থিতির পর থেকে স্থলবন্দরের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের মধ্যে কথা বলে জানা গেছে, রাখাইনে সংঘাতের মধ্যেও মাঝে মাঝে কাঠ ও ডাল মিয়ানমার থেকে আসত। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমারের তিনটি পণ্যবাহী জাহাজ ইয়াঙ্গুন শহর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরের উদ্দেশে আসার পথে রাখাইনের নাইক্ষ্যংদিয়া সীমান্তে আটকে দেয় আরাকান আর্মি। এর পর থেকে ইয়াঙ্গুন থেকে পণ্য আমদানি প্রায় বন্ধ।
টেকনাফ স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী সাদ্দাম হোসেন রানা বলেন, স্থলবন্দর বন্ধ থাকায় ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা বাজে সময় পার করছেন। অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থা দীর্ঘ দিন চললে বন্দরের ওপর যারা নির্ভরশীল, তাদের সংসার চালানো সম্ভব হবে না।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি সিমেন্ট ব্যবহার করে বাঙ্কার তৈরি করছে। তাই এপার থেকে যাতে সিমেন্ট কোনোভাবে ওপারে না যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
টেকনাফ স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা সোহেল উদ্দিন বলেন, আরাকান আর্মি সীমান্ত দখলের পর প্রায় তিন মাস ধরে ইয়াঙ্গুন থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ। তাদের প্রতিবন্ধকতার কারণে এই অচলাবস্থা। যার ফলে রাজস্ব খাতে ধস নেমেছে। গত বছরের তুলনায় ২৪৭ কোটি ২৮ লাখ টাকার মতো রাজস্ব আদায় থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার। তবে আরাকান আর্মির দখলে থাকা রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে কিছু পণ্যে আমদানি-রপ্তানি চলমান থাকলেও আপতত বন্ধ রয়েছে সিমেন্ট রপ্তানি।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আর ক ন আর ম আর ক ন আর ম র খ ইন র আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
শেষে এসে ‘বিপদে’ ওয়াসা
একের পর এক জটিলতায় পড়ছে চট্টগ্রাম ওয়াসার পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পটি। অর্থ বরাদ্দের সংকট, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বকেয়া নিয়ে বিরোধ, কাজের ধীরগতি—সব মিলিয়ে প্রকল্পের নির্মাণকাজ বর্ধিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
প্রায় ৫ হাজার ২০৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পে ২২টি ওয়ার্ডের ২০ লাখ মানুষের জন্য আধুনিক পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা রয়েছে। প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৭০ শতাংশ। এই সময়ে এসে নানা জটিলতায় ‘বিপদে’ পড়েছে ওয়াসা।
‘চট্টগ্রাম মহানগরের পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা। এরপর প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। মেয়াদ বেড়েছে তিন দফা। ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি।
বর্তমানে অর্থ বরাদ্দের সংকট নিয়ে বিপাকে আছে ওয়াসা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি চেয়েছিল ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ৭৪৪ কোটি। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) দরকার ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৭৬ কোটি টাকা। প্রকল্পে খরচ হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত করা কাজের টাকা আমরা পাইনি। আগেও একই কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পরে আশ্বাস পেয়ে শুরু করেছিলাম। এবারও সেই পরিস্থিতি।প্রকল্প পরিচালক, এসএ ইঞ্জিনিয়ারিংসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এই নির্বাচনী মৌসুমে প্রকল্প বরাদ্দে আরও অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে। অর্থ না এলে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়বে। ২০২৭ সালের শুরুতে এ প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। কাজ শেষ না হলে এই পরিকল্পনা পিছিয়ে যাবে।
জানতে চাইলে ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, গত বছরই অর্থ বরাদ্দের অভাবে অনেক কাজ আটকে ছিল। এ বছরও চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ না পেলে সময়সীমা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের বিষয়ে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
বর্তমানে অর্থ বরাদ্দের সংকট নিয়ে বিপাকে আছে ওয়াসা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সংস্থাটি চেয়েছিল ১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ৭৪৪ কোটি। চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) দরকার ১ হাজার ৪০ কোটি টাকা, কিন্তু এখন পর্যন্ত পাওয়া গেছে ৬৭৬ কোটি টাকা।প্রকল্পের নথিতে বলা হয়, দৈনিক ১০ কোটি লিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পয়োশোধনাগার, দৈনিক ৩০০ ঘনমিটার পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন একটি সেপটিক ট্যাংকের বর্জ্য শোধনাগার, ২০০ কিলোমিটার পয়োনালা নির্মাণ করা হবে। এতে চট্টগ্রাম নগরের ২২টি ওয়ার্ডের ৩৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রকল্পের আওতায় আসবে। আর উন্নত পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সুফল পাবেন ২০ লাখ মানুষ।
এখনো কাজ বন্ধ, অর্থের টানাপোড়েন
প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ ১৫ দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাইয়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড উপঠিকাদারদের অর্থ পরিশোধ না করায় সাতটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান কাজ বন্ধ রেখেছে।
হালিশহর এলাকায় পাইপ বসানোর কাজ করছে মেসার্স নূর এন্টারপ্রাইজ, এসএ ইঞ্জিনিয়ারিং, জাহান এন্টারপ্রাইজ, দেশ কন্ট্রাক্টরস অ্যান্ড ডেভেলপার লিমিটেড, ইনাস এন্টারপ্রাইজ, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনাল ও পাওয়ার বাংলা করপোরেশন। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, তাদের প্রায় ৪৬ কোটি টাকা বকেয়া পড়ে আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার তাইয়ং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় উপঠিকাদাররা দুটি শর্তে কাজ শুরুতে রাজি হয়েছেন—আগামী সোমবারের মধ্যে ৫০ শতাংশ বকেয়া পরিশোধ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি অর্থ নিষ্পত্তি।
জানতে চাইলে এসএ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রকল্প পরিচালক আহাদুজ্জামান বাতেন বলেন, ‘চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিল পরিশোধ করা হয়েছিল। এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত করা কাজের টাকা আমরা পাইনি। আগেও একই কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল, পরে আশ্বাস পেয়ে শুরু করেছিলাম। এবারও সেই পরিস্থিতি।’
আহাদুজ্জামান জানান, ‘মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনায় আমরা দুটি শর্ত দিয়েছি—সোমবারের মধ্যে ৫০ শতাংশ বিল পরিশোধ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি অর্থ নিষ্পত্তি। এ দুই শর্তে কাজ আবার শুরু করছি।’