যুক্তরাষ্ট্রের ধনীরা দেশটি থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন। বিনিয়োগকারী ও বিভিন্ন ব্যাংকের সূত্রে সিএনবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনী মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে সুইজারল্যান্ডে বিনিয়োগ সরিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। আর সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের সুইজারল্যান্ডে বিনিয়োগ হিসাব খোলার প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ধনীদের এভাবে সুইজারল্যান্ডে সম্পদ সরিয়ে নেওয়ার কারণ মূলত একটি। সেটা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি। সুইজারল্যান্ডের আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আলপেন পার্টনার্স ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পিয়েরে গ্যাব্রিস সিএনবিসিকে বলেছেন, বিষয়টি অনেকটা ঢেউয়ের মতো; সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন প্রথম নির্বাচিত হন, তখন এই দৃশ্য দেখা গেছে। এরপর কোভিডের সময় আরেক ঢেউ দেখা গেছে। এখন ট্রাম্পের শুল্কের কারণে আরেক ঢেউ শুরু হয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে গ্যাব্রিস বলেন, অনেক বিনিয়োগকারী ডলারভিত্তিক বিনিয়োগের মধ্যে আটকে থাকতে চান না। তাঁরা মনে করছেন, ট্রাম্পের এই শুল্কনীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান সরকারি ঋণের চাপে ডলার আরও দুর্বল হবে। এই বাস্তবতায় সুইজারল্যান্ড বিনিয়োগকারীদের গন্তব্য হয়ে উঠেছে। কারণ, সুইজারল্যান্ডের নিরপেক্ষ রাজনীতি, স্থিতিশীল অর্থনীতি, শক্তিশালী মুদ্রা ও নির্ভরযোগ্য আইনি ব্যবস্থা।
অনেক বিনিয়োগকারী আবার রাজনৈতিক কারণে অনুপ্রাণিত হয়ে সুইজারল্যান্ডে বিনিয়োগ করছেন। তাঁরা মনে করছেন, ট্রাম্প শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের শাসনের অবক্ষয় হয়েছে। অনেকে আবার সোনা কেনার জন্য সুইজারল্যান্ডে হিসাব খুলছেন। এর কারণ হলো স্বর্ণ মজুত ও পরিশোধনের জন্য সুইজারল্যান্ড বিখ্যাত। অনেকে আবার ভিন্ন পরিকল্পনা থেকে এই কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন গ্যাব্রিস। গ্যাব্রিসের মতে, অনেক মার্কিন বিনিয়োগকারী ইউরোপে বা সুইজারল্যান্ডে দ্বিতীয় নাগরিকত্ব নিতে চান; সেই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তাঁরা সুইজারল্যান্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
শুধু সুইজারল্যান্ড নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছেন মার্কিন ধনীরা। সুইজারল্যান্ডের আর্থিক খাতবিষয়ক সংবাদমাধ্যম ফিননিউজের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১ লাখ ৪২ হাজার অতি ধনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অভিবাসনের সুবিধা নিতে পারেন। হারভে ল করপোরেশন নামের এক আইনি প্রতিষ্ঠানের তথ্যানুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩ শতাংশ মিলিয়নিয়ার অর্থাৎ যাঁদের সম্পদ ১০ লাখ ডলারের বেশি, তাঁরা দেশত্যাগের পরিকল্পনা করছেন। এই প্রবণতা মিলেনিয়াল (জন্ম ১৯৮২ থেকে ১৯৯৬) ও জেন–জি (১৯৯৭-২০১২) প্রজন্মের ৬৪ শতাংশের মধ্যে দেখা গেছে। এই প্রজন্মের ধনীদের মধ্যে বিভিন্ন দেশের গোল্ডেন ভিসা নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫৩ শতাংশ মিলিয়নিয়ার অর্থাৎ যাঁদের সম্পদ ১০ লাখ ডলারের বেশি, তাঁরা দেশত্যাগের পরিকল্পনা করছেন।সিএনবিসির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের দেশত্যাগের পেছনে আর্থিক বিভিন্ন কারণও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে কর ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা অন্যান্য দেশে যাচ্ছেন। মার্কিন নাগরিকেরা অবশ্য বিশ্বের যে দেশেই থাকুক না কেন, তাঁদের আয়কর বিবরণী দেওয়া বাধ্যতামূলক। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় বসবাস করলে কিছু সুবিধা অবশ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া আরও কিছু বিবেচনা থেকে মার্কিন ধনীদের দেশত্যাগের প্রবণতা বেড়েছে। যেমন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বৃদ্ধি, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক কম খরচে বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ, কাজ ও ব্যক্তিগত জীবনের ভারসাম্য, পরিবারের জন্য আরও বেশি সময় ব্যয় করা, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের সুযোগ, সামাজিকতার বোধ।
মার্কিন ধনীদের যাওয়ার প্রিয় জায়গা হচ্ছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, গ্রানাডা, অ্যান্টিগা ও বারবুডা, সেন্ট লুসিয়া, ডোমিনিকা। সেই সঙ্গে ইউরোপের যেসব দেশ গোল্ডেন ভিসা দিচ্ছে, যেমন পর্তুগাল, স্পেন, মাল্টা ও গ্রিসেও যাচ্ছেন মার্কিন ধনীরা।
ডলারের দরপতন
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কনীতির কারণে মার্কিন মুদ্রা ডলারের শক্তিও কমতে শুরু করেছে। সামগ্রিকভাবে মার্কিন অর্থনীতিতে মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। যার আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে পরিচিত মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের চাহিদা কমে যাওয়া। যে কারণে বন্ডের সুদহার বাড়াতে হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মার্কিন ট্রেজারির সুদহার বেড়ে যাওয়ায় সম্ভবত ট্রাম্প শেষমেশ শুল্ক স্থগিত করেছেন। শুল্ক বাধার কারণে সামগ্রিকভাবে ডলারে বাণিজ্য আরও কমে যেতে পারে। সেই সঙ্গে মার্কিন ধনীরা যেখানে নিজ দেশ থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে নিতে শুরু করেছেন, তাতে ডলারের শক্তি আরও কমার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আইনি প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের একটি নতুন প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১১ হাজারের বেশি বিত্তবান ব্রিটিশ রাজধানী লন্ডন ছেড়েছেন। ধনীদের লন্ডন ছাড়ার প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই চলছে। তবে তা এখন উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ শত য গ র প র প রবণত করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলের অংশগ্রহণের প্রতিবাদে ইউরোভিশনের ট্রফি ফেরত দিচ্ছেন সুইস সংগীতশিল্পী নেমো
আন্তর্জাতিক গানের প্রতিযোগিতা ইউরোভিশনে ইসরায়েলের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সুইজারল্যান্ডের সংগীতশিল্পী নেমো নিজের পুরস্কার ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল অনবরত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরও দেশটিকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার নেমো পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
নেমো তাঁর গাওয়া ‘দ্য কোড’ গানটির জন্য ২০২৪ সালে ইউরোভিশন পুরস্কার জিতেছেন। তাঁর মতে, ইউরোভিশন প্রতিযোগিতায় ইসরায়েলের অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রতিযোগিতার আদর্শিক জায়গার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর সে আদর্শিক জায়গাটি হলো সব মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও সবার মর্যাদা বজায় রাখা।
ইউরোভিশনের আয়োজক সংস্থা ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন (ইবিইউ)–এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পদক্ষেপের সর্বশেষ সংযোজন এটি। গত সপ্তাহে ইবিইউ ইসরায়েলকে আগামী বছর অস্ট্রিয়ায় অনুষ্ঠেয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার পর পাঁচটি দেশ প্রতিযোগিতা থেকে সরে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে নেমো বলেন, ‘ইউরোভিশন বলে যে তারা ঐক্য, অন্তর্ভুক্তি ও সব মানুষের মর্যাদার পক্ষে দাঁড়ায়। এই মূল্যবোধগুলোর কারণেই এ প্রতিযোগিতাটি আমার কাছে এত অর্থবহ। কিন্তু যখন কিনা জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে (অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চল, পূর্ব জেরুজালেম ও ইসরায়েল বিষয়ক তদন্ত) গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তখন বোঝা যায়, ওই আদর্শগুলোর সঙ্গে ইবিইউর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্টত সাংঘর্ষিক।’
আরও পড়ুনগাজায় ইসরায়েলের জাতিহত্যামূলক যুদ্ধের প্রতিবাদে ইউরোপজুড়ে লাখো মানুষের বিক্ষোভ৩০ নভেম্বর ২০২৫ইসরায়েল বারবার গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ইসরায়েলের দাবি, তারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে সীমান্ত পেরিয়ে হামাসের নেতৃত্বে হামলার পর নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার তাদের রয়েছে। ওই হামলার কারণেই এই যুদ্ধের সূচনা হয়েছে।
গত বুধবার আইসল্যান্ডের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম আরইউভির খবরে বলা হয়েছে, দেশটি ২০২৬ সালে অনুষ্ঠেয় ইউরোভিশন গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না। গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। এর আগে স্পেন, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও স্লোভেনিয়াও একই ধরনের ঘোষণা দেয়।
আরও পড়ুনইসরায়েলিদের বাধায় নিজেদের জমিতে যেতে পারেন না ফিলিস্তিনিরা, বিপর্যয়ে জলপাইশিল্প০৪ ডিসেম্বর ২০২৫