ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় কাশ্মীর হত্যাকাণ্ডের ঘি
Published: 24th, April 2025 GMT
কাশ্মীরে ২৬ জন পর্যটকের একটি দল হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার এক দিন পর ভারত সরকার বুধবার দেশটির জনমের শত্রু পাকিস্তানের দিকে আঙুল তুলেছে। তারা প্রতিবেশী দেশটির বিরুদ্ধে একের পর এক শাস্তিমূলক বিবৃতি দিয়েছে, যেখানে আরও জোরালো প্রতিশোধ নেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। ভারত সরকার এরই মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে একটি পানিচুক্তি বাতিল করেছে, যে চুক্তি ১৯৬০ সালে কার্যকর হয়। তখন থেকে ভারত নদীপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে, যার ওপর পাকিস্তানের সেচ ব্যবস্থা নির্ভরশীল। ভারত দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থল সীমান্ত বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিল। দেশটি ঘোষণা করেছিল, তারা নয়াদিল্লি মিশন থেকে পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টাদের বহিষ্কার এবং নাগরিকদের জন্য ইতোমধ্যে সীমিত ভিসা আরও সীমিত করে কূটনৈতিক সম্পর্ক কমিয়ে আনছিল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে ভারতবর্ষকে বিভক্ত এবং পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আলাদা করা হয়। এর পর থেকে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই কাশ্মীর দাবি করে আসছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর অঞ্চলে এই দুটি দেশ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি দেশ একটি অংশ পরিচালনা করলেও উভয়ে পুরো অঞ্চলটি দাবি করছে।
মঙ্গলবারের মতো হামলার নেপথ্যে জঙ্গিদের আশ্রয় ও মদদ দেওয়ার জন্য ভারত সরাসরি পাকিস্তানকে দোষারোপ করে। ২০১৯ সালে একটি জঙ্গি হামলায় কয়েক ডজন ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মী নিহত হয়। ফলে দেশ দুটির মধ্যে বিমানযুদ্ধ শুরু হলেও সর্বাত্মক যুদ্ধ না বেধে তার সমাপ্তি হয়।
‘আমার মনে হয়, এই হামলার পেছনে পুরো ধারণাটি ছিল এই ভাষ্য ভেঙে দেওয়া– আপনি জানেন, এখানে সবকিছু স্বাভাবিক।’ কাশ্মীরে অবস্থিত ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় কমান্ডের নেতৃত্ব দানকারী অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনা জেনারেল ডি.
পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য মোদি বিশ্বমঞ্চে ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক শক্তির ওপর মনোযোগ দেন। এমনকি দেশটি পাকিস্তানি শিল্পীদের বলিউড থেকে এবং পাকিস্তানি ক্রীড়াবিদদের ভারতীয় ক্রিকেট লিগ থেকে দূরে রেখেছে। অঞ্চলটির জন্য এ দুটি শিল্প অত্যন্ত লাভজনক। মোদি এর আগে পাকিস্তানের এস্টাবলিশমেন্টকে জঙ্গিদের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করতে চাপ দেওয়ার কৌশল হিসেবে পানি সরবরাহ সীমিত করার হুমকি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ সিন্ধু নদ ব্যবস্থা থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানির ওপর নির্ভরশীল।
‘রক্ত ও জল একসঙ্গে প্রবাহিত হতে পারে না’– ২০১৬ সালে আরেকটি হামলার পরপরই এক সভায় মোদি পাকিস্তানে নদীপ্রবাহের যুক্ততার কথা উল্লেখ করে সতর্কবাণী হিসেবে এ কথা বলেছিলেন। ২০১৯ সালে ভারত সরকার পানি বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল, কিন্তু তা কার্যকর করেনি। ২০১৯ সালে মোদি কাশ্মীরের আধা স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়েছিলেন এবং নয়াদিল্লির সরাসরি শাসনাধীনে আনার জন্য স্থানীয় গণতন্ত্র ভেঙে দেন।
বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ছোট আকারের আক্রমণ অব্যাহত থাকলেও মোদির কর্মকর্তারা ক্রমবর্ধমানভাবে মনে করছিলেন, তাদের কৌশল কাজ করছে। তারা বলেছেন, কাশ্মীর অধ্যায় পাল্টে গেছে এবং তারা এর উন্নয়নের ওপর মনোযোগ দিতে পারে। উন্নতির প্রধান সূচক ছিল সারাদেশ থেকে উপত্যকায় পর্যটকদের আগমন বৃদ্ধি।
মঙ্গলবারের গণহত্যার ঘটনাটি সেই কৌশলের সীমা উদোম করে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত তার উত্তর সীমান্তে আরও বড় হুমকির মুখোমুখি ছিল। কারণ ২০২০ সালে আরও উগ্র চীনারা হিমালয় অঞ্চল লাদাখে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল এবং তারা এ সময় ভারতীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করেছিল।
ভারত ও চীনের সেনাবাহিনী চার বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধাবস্থা পরিস্থিতিতে ছিল। সম্প্রতি তারা নিজেদের সেনা প্রত্যাহার করেছে। সেই সময় ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে দুই ফ্রন্টের সংঘর্ষের আশঙ্কা এড়াতে চেয়েছিল। যদিও তখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ ছিল ন্যূনতম এবং ভারতে জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকলেও যুদ্ধবিরতি বহাল ছিল।
মুজিব মাশাল ও সুহাসিনী রাজ: সাংবাদিক; নিউইয়র্ক টাইমস থেকে সংক্ষেপিত
ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন য প রব হ র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।