ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হুমকির মুখে কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা, উত্তরাখন্ডে হিন্দু নেতার বিরুদ্ধে এফআইআর
Published: 25th, April 2025 GMT
পেহেলগামের ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কাশ্মীরি শিক্ষার্থীরা হুমকির মধ্যে পড়েছেন। কোনো কোনো জায়গায় তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন। কোথাও দ্রুত তাঁদের কাশ্মীরে ফিরে যেতে হুকুম জারি করা হয়েছে। কোথাও বাড়ি ছাড়া করা হচ্ছে। এই প্রবণতা রুখতে জম্মু–কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ থেকে শুরু করে সব রাজনৈতিক নেতা–নেত্রী গভীরভাবে চিন্তিত। পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতি গতকাল বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে অনুরোধ করেন এই প্রবণতা কড়া হাতে দমন করতে।
গত বৃহস্পতিবার শ্রীনগরে সর্বদলীয় বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবেও রাজ্যে রাজ্যে এই অরাজকতা বন্ধের দাবি জানানো হয়। দেশবাসীর উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘দয়া করে কাশ্মীরিদের শত্রু ভাববেন না। পেহেলগামের হামলার জন্য কাশ্মীরিরা দায়ী নন। ৩৫ বছর ধরে আমরাও হামলার শিকার। আমরা ভুক্তভোগী।’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, কোনো কোনো রাজ্যে এ ধরনের অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। কাশ্মীরি শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকারদের বলা হয়েছে কঠোর ব্যবস্থা নিতে।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন। দলের এক নেতা শুক্রবার প্রথম আলোকে জানান, রাজ্যনেতাদের এ বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, উত্তরাখন্ড পুলিশ ইতিমধ্যেই রাজ্যের এক হিন্দুত্ববাদী নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানিয়েছে, উত্তরাখন্ডের হিন্দু রক্ষা দলের নেতা ললিত শর্মার বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ এফআইআর দাখিল করেছে। শর্মা এক ভিডিও বার্তায় কাশ্মীরি শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের অবিলম্বে রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। হুমকি দিয়ে বলেন, না হলে তাঁদের হাল অকল্পনীয় হবে।
উত্তরাখন্ড পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এ পি অংশুমান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কাশ্মীরিদের নিরাপত্তায় তাঁরা তৎপর। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
নিরাপত্তা নিশ্চিয়তা সত্ত্বেও উত্তরাখন্ড থেকে অন্তত ২০ জন ছাত্র ইতিমধ্যেই অন্যত্র চলে গেছেন বলে দাবি করেছেন দুন কলেজ গোষ্ঠীর অ্যাডমিশন কো–অর্ডিনেটর মোহসিন আব্বাস। তিনি জানান, ওই ছাত্ররা দিল্লি চলে গেছেন।
উত্তরাখন্ডের মতো হাল হয়েছে উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাবেও। উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজ জেলায় এক বাড়িওলা কাশ্মীরি শিক্ষার্থী ও চাকরিজীবীদের বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। হিমাচল প্রদেশের কাংড়া উপত্যকায় আর্নি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাসের দরজা ভেঙে কাশ্মীরি ছাত্রদের নিগ্রহ করা হয়। পাঞ্জাবের রাজধানী চণ্ডীগড়ের ডেরা বসসিতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলেও কাশ্মীরি ছাত্ররা আক্রান্ত হন।
জম্মু কাশ্মীর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক নাসির খুয়েহামি অভিযোগ করেছেন, পেহেলগাম–কাণ্ডের পর বিভিন্ন রাজ্য থেকে কাশ্মীরি ছাত্রদের ওপর হামলা ও হুমকির অন্তত আটটি ঘটনার খবর তাঁর কাছে এসেছে। তিনি জানান, বিপন্ন ছাত্রদের জন্য তাঁরা বেশ কয়েকটা হেল্পলাইন নম্বর চালু করেছেন। নয়াদিল্লির জম্মু–কাশ্মীর রেসিডেন্ট কমিশনারও বেশ কিছু সর্বক্ষণের হেল্পলাইন চালু করেছেন। খুয়েহামি জানান, তাঁরা ইতিমধ্যে লোকসভার বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কংগ্রেস নেতার কার্যালয় থেকে খুয়েহামিকে জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে অমিত শাহর সঙ্গে রাহুল গান্ধী অবশ্যই কথা বলবেন। রাজ্যে রাজ্যে কাশ্মীরি পড়ুয়াদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলবেন।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
তিন কারণে ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে, অক্টোবরের বৃষ্টিও ভোগাবে
‘রোগতাত্ত্বিক ত্রিভুজ’ বলে জনস্বাস্থ্যে একটি পরিভাষার ব্যবহার আছে। এই ত্রিভুজের তিন বাহুর একটি হলো জীবাণু (ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মশা), একটি রোগী এবং তৃতীয়টি পরিবেশ। এই তিনটির একটিও যদি নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে রোগ বৃদ্ধির প্রবণতা কমানো যায়।
গতকাল শুক্রবার শেষ হলো অক্টোবর মাস। এ মাসে ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে, এডিস মশার বিস্তার কমেনি এবং জীবাণু সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ যেমন বৃষ্টিও ছিল। পরিবেশের অন্য উপাদান যেমন শহরাঞ্চলে নোংরা ও আবর্জনা। এ ক্ষেত্রেও কোনো উন্নতি হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু থেকে মুক্তির সম্ভাবনা নেই বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অক্টোবরের শেষ সময়ে এসে এই বৃষ্টি আমাদের ভোগাবে। নভেম্বরে ডেঙ্গুর বিস্তার কমার সম্ভাবনা কম। রোগতাত্ত্বিক ত্রিভুজ বলতে যা বোঝায়, তাকে রুখে দেওয়ার কোনো তৎপরতা তো দেখছি না। গ্রামে-গঞ্জে এডিস ছড়িয়ে পড়েছে। তার নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দৃশ্যমান কাজ দেখা যাচ্ছে না। ভীতির কারণ এটাও।’
অক্টোবরের শেষে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছিল। আর গত বুধবার দেখা যায়, এক মাসে বছরের সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়। সব মিলিয়ে অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২ হাজার ৫২০ জন। এ মাসে মৃত্যুর সংখ্যা ৮০। সংক্রমণ ও মৃত্যু—দুই দিক থেকেই ডেঙ্গুর আক্রমণে অক্টোবর ছিল বছরের শীর্ষে।
বৃহস্পতিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫০৩ জন। এ সময় কারও মৃত্যু হয়নি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ২৭৮ জন। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৮৬। গত বছর এ সময় রোগীর সংখ্যা ছিল ৬১ হাজার ৮১৭ আর মৃত্যু হয়েছিল ২৯৭ জনের।
দুই মাস ধরে বাড়ছে রোগ ও মৃত্যু
চলতি বছরের জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। এ সময় অনেক বিশেষজ্ঞই বলেছিলেন, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বড় আকারের হতে পারে। সরকার তাতে তেমন গা করেনি। গত জুলাই মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা জুনের দ্বিগুণ হয়ে যায়। আগস্টে মৃত্যু ও সংক্রমণ সামান্য কমে। কিন্তু সেপ্টেম্বরে তা আবার বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৫ হাজার ৮৬৬ জন। অক্টোবরে প্রায় ৭ হাজার রোগী বেড়েছে।
ঢাকা ও আশপাশে রোগী বাড়ছে
চলতি বছরের ডেঙ্গুর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এবার ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এবার মোট আক্রান্তের ২৮ শতাংশ ঢাকার। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ঢাকার বাইরে রোগী বৃদ্ধির প্রবণতা ছিল। কিন্তু অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ঢাকায় রোগী বাড়তে শুরু করে। শুধু ঢাকা নয়, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের মতো পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোয় রোগী ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অক্টোবরে ঢাকায় অন্তত ১৫ শতাংশ রোগী বেড়েছে সেপ্টেম্বরের চেয়ে। তবে ঢাকায় ভর্তি রোগীদের অন্তত ৫০ শতাংশ ঢাকার বাইরের বাসিন্দা।
নারায়ণগঞ্জে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৩০। অক্টোবরের শেষে এসে রোগীর সংখ্যা হয়েছে ১ হাজার ৩১০ জন। অর্থাৎ শুধু অক্টোবরে আগের নয় মাসের তুলনায় রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। গাজীপুরে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত রোগী ছিলেন ১ হাজার ৬৬১ জন। আর অক্টোবরের শেষ দিন পর্যন্ত রোগী হয়েছেন ২ হাজার ৯৯৩ জন।
তিন কারণে ডেঙ্গুর বড় বিস্তার
চলতি বছর এপ্রিল থেকে মোটামুটি বৃষ্টি হচ্ছে। জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টি হলেও পরের মাসগুলোয় স্বাভাবিক বৃষ্টি হয়। আর থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে গরম কিন্তু কমেনি। এই বৃষ্টি ও উচ্চ তাপমাত্রা চলতি বছর ডেঙ্গুর বিস্তারে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবীরুল বাশার। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরেই বর্ষা দেরিতে আসছে। এবারও অক্টোবরজুড়ে বৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নিষ্ক্রিয়তা ডেঙ্গুর বিস্তারে দ্বিতীয় কারণ। পৌরসভার মতো প্রতিষ্ঠানগুলো জনপ্রতিনিধিশূন্য করা ঠিক হয়নি। ঢাকার বাইরে এবার ডেঙ্গুর ব্যাপক বিস্তারে এসব ভঙ্গুর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান বড় কারণ। কবীরুল বাশার মনে করেন, ঢাকার বাইরে যেহেতু চিকিৎসা অবকাঠামো দুর্বল, তাই সেসব এলাকায় রোগ বেড়েছে।
অধ্যাপক কবীরুল বাশার বলেছিলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে শীতের ভূমিকা আসলে কম। কারণ, এখানে জানুয়ারি মাসে দিনের তাপমাত্রা ১৮ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। রাতে হয়তো তা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রির মধ্যে চলে আসে। কিন্তু এখানে এডিসের বংশ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখে বৃষ্টি।
অক্টোবরের শেষে যে বৃষ্টি হয়েছে, আবহাওয়া অধিদপ্তর গতকাল সতর্কবার্তায় জানিয়েছে, অন্তত ৩টি বিভাগে পরের ৪৮ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।এরই মধ্যে বৃষ্টির আরেক খবর আছে। ৬ থেকে ৭ নভেম্বর সাগরে লঘুচাপের ফলে আবারও বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে।
এভাবে বৃষ্টি হলে পাঁচ থেকে সাত দিন লার্ভা থেকে বাচ্চা মশা হয়। সেটি প্রাপ্তবয়স্ক হতে আরও ১১ দিনের মতো সময় লাগে। সব মিলিয়ে আরও ২০ থেকে ২৫ দিন এডিসের বংশবিস্তার ঘটতে থাকবে। ফলে নভেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে না। এর রেশ ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকতে পারে।