১৯৫৬ সালে সেবার খুব কলেরার প্রকপ হয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছিল ওলাওঠায়। হামিদা বেগম রেখার ৮ মাস বয়সে তার স্কুলশিক্ষক বাবা মারা যান সেরকম এক রাতে কলেরায়। ২ বছর পর তার কিশোরী মায়ের অন্যত্র আবার বিয়ে হয়ে যায়। রেখার দাদাবািড় এবং নানাবাড়ি একই উঠানের এপার-ওপার হলেও তিনি নানাবাড়িতে লালিত-পালিত হতে থাকেন। শরিয়া আইন অনুযায়ী যেহেতু দাদার সামনে বাবা মারা গেলে তার সন্তানাদি দাদার সম্পত্তির উত্তরাধিকার বঞ্চিত হয়, ফলে তৎকালীন অন্য সব শিশুর মতোই তার ঠাঁই দাদাবাড়ি হয়নি। ১৯৬৩ সালে দাদা ইসমাইল সরদার মারা যাওয়ার ২ বছর আগে ১৯৬১ সালে একটি যুগান্তকারী আইন পাশ করে আইয়ুব খান সরকার-  মুসলিম পারিবারিক আইন! এই আইনের বলে মৃত পিতার সমপরিমাণ সম্পদের উত্তরাধিকার স্বত্ব পেয়ে যান তার সন্তানেরা। হামিদা বেগম রেখা অবশ্য এই আইন সম্পর্কে জানতে পারেন আরো পরে এসে আশির দশকে এবং এরপর তিনি মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ ৬ বছরের আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৯২ সালে আদালত তার পক্ষে রায় দেন এবং তিনি তার দাদার সম্পত্তির বাবার অংশ পুরোটাই লাভ করেন। এই সম্পত্তি তাকে নানাভাবে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। সন্তানের লেখাপড়া চালিয়েছেন এই সম্পত্তি বিক্রি করে। সেই লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম বলেই হয়তো আজকে এই লেখার সুযোগ পাচ্ছি! 

জি, এটি আমার মায়ের গল্প। পাকিস্তানের সময় আমাদের মনে নানাভাবে ক্ষত সৃষ্টি করলেও আমি মনে করি, এই একটি আইন একটি বিরাট দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে। লক্ষ লক্ষ অকালপ্রয়াত বাবার সন্তানদের মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আইন।

আমরা একটা যুগের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। ফলে দীর্ঘ দিনের অন্যায্যতা, বৈষম্য সারিয়ে নতুন করে সমাজ বিনির্মাণের সময় এসেছে। সম্প্রতি নারী সংস্কার কমিশন নারীর বিবাহ, তালাক, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সম-অধিকারের বিষয়ে সুপারিশ করছে। সেই সুপারিশ সমর্থন করতেই আমার এই লেখা। আমরা পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম দেশ এবং ভারতীয় উত্তরাধিকার আইনগুলো দেখব এবং সেখান থেকে বোঝার চেষ্টা করব- এই দাবি কতটা যৌক্তিক? 

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, যার পরিবারিক আইন ১৯৬১ সালের Muslim Family Laws Ordinance অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ইসলামের আদলে নারীদের উত্তরাধিকার অধিকার স্বীকৃত হলেও বাস্তবতা হলো—নারীরা প্রায়শই পরিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম ও বহুধর্মীয় দেশ যেমন তুরস্ক, তিউনিসিয়া এবং ভারত নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। সে আলোকে বাংলাদেশেও সময় এসেছে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার আইনি ও সামাজিকভাবে নিশ্চিত করার।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: আইন আছে, বাস্তবায়ন নেই বাংলাদেশের প্রচলিত শরিয়াভিত্তিক উত্তরাধিকার ব্যবস্থায়। নারী পুরুষের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তি পান (যেমন ভাই ২ অংশ, বোন ১ অংশ), স্ত্রী পায় স্বামীর সম্পত্তির ১/৮ বা ১/৪ ভাগ। অথচ নারীর জীবনে অর্থনৈতিক চাহিদা বা দায়িত্ব কম নয়। যদিও ইসলাম নারীদের উত্তরাধিকারে অধিকার দিয়েছে, বাস্তবে সমাজে এটি প্রয়োগ হয় না। অধিকাংশ নারী ভাই বা স্বজনদের চাপ কিংবা পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে সম্পত্তি দাবি করতে পারেন না। অনেক সময় ‘ভ্রাতৃপ্রেমে’ ছেড়ে দেওয়ার চাপ তৈরি করা হয়।

তুরস্ক ও তিউনিসিয়ার দৃষ্টান্ত: ধর্মীয় কাঠামো থেকে নাগরিক অধিকারে রূপান্তরিত তুরস্ক ১৯২৬ সালে সুইস সিভিল কোড গ্রহণ করে শরিয়াহ নির্ভর পরিবারিক আইন বাতিল করে। এতে নারী-পুরুষ সমানভাবে উত্তরাধিকার লাভ করেন।

তিউনিসিয়া ২০০৪ ও ২০১৮ সালে নারী অধিকারে সংস্কারমুখী আইন প্রস্তাব করে। উত্তরাধিকার আইন সংস্কারের কথা বলা হয়েছে—যদিও ধর্মীয় বিতর্ক থাকলেও রাষ্ট্র নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টায় এগিয়েছে। এই দুই রাষ্ট্র দেখিয়েছে যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নাগরিক অধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রেখে আইন সংস্কার সম্ভব।

ভারতের অভিজ্ঞতা: আইনগত স্বীকৃতি ও প্রগতিশীলতা ভারতে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে ২০০৫ সালের সংশোধনী অনুযায়ী, কন্যারা এখন বাবার সম্পত্তিতে সমান অংশীদার। মুসলিমদের ক্ষেত্রে শরিয়াহ প্রযোজ্য হলেও নারীবান্ধব আইন প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা চলছে। ভারতের প্রেক্ষাপটে নারীর আইনি সুরক্ষা রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

কেন বাংলাদেশে সমানাধিকার প্রয়োজন?

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন: সম্পত্তিতে অধিকার নারীর আর্থিক স্বাবলম্বিতার ভিত্তি। সমানাধিকার নিশ্চিত না হলে নারীরা চিরকাল পরিবার বা স্বামীর উপর নির্ভরশীল থাকবেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি: বাংলাদেশ সিড’ (CEDAW) ও এসডিজি লক্ষ্য অনুযায়ী নারী-পুরুষ সমতা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। অথচ উত্তরাধিকার আইনে সমতা অনুপস্থিত।

সামাজিক পরিবর্তনের চাহিদা: শিক্ষিত, কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু আইন এখনো শত বছর আগের বাস্তবতাকে ধারণ করে আছে।

প্রস্তাবনা

আইনি সংস্কার: একটি সমন্বিত Family Inheritance Reform Act প্রণয়ন করে নারী-পুরুষ সমান অংশ নির্ধারণ করা যেতে পারে, অন্তত ইসলামি উত্তরাধিকারের পুনঃব্যাখ্যার মাধ্যমে (ইজতিহাদের আলোকে)।

অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা: নারীরা সম্পত্তিতে অধিকার না পেলে জেলা প্রশাসক বা হিউম্যান রাইটস কমিশনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক অভিযোগ জানাতে পারবেন এমন ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।

সচেতনতা ও সামাজিক উদ্যোগ: পরিবারিকভাবে নারীকে সম্পত্তি হস্তান্তরকে উৎসাহিত করতে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা, মিডিয়া প্রচার ও এনজিওদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের নারীরা শিক্ষা, কর্মসংস্থান, নেতৃত্বে এগিয়ে গেলেও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে এখনো বঞ্চিত। ন্যায়বিচার, মানবিকতা এবং বহুত্ববাদের বাংলাদেশ গড়তে হলে, সেই চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে নাগরিক অধিকারের আলোকে উত্তরাধিকার আইন সংস্কার আজ সময়ের দাবি। সমতা না হলে নারীর সত্যিকারের ক্ষমতায়ন অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।

লেখক: চিন্তক, মানবাধিকারকর্মী

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ব র ক অন য য় আইন স

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েলে ইরানের নতুন হামলায় নিহত বেড়ে ৫, আহত ২৯

ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে অন্তত চার জায়গায় হামলা চালিয়েছে ইরান। এ হামলায় তিনজন নিহত হয় বলে জানায় জেরুজালেম পোস্ট। বিবিসি আরও দুইজন নিহতের খবর দেয়। এরপর আরেকজনের ফলে নতুন হামলায় ইসরায়েলে নিহত বেড়ে পাঁচজনে পৌঁছাল।

আজ সোমবার আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের অ্যাম্বুলেন্স ও ব্লাড ব্যাংক সংস্থাগুলো বলছে, এসব হামলায় ২৯ জন আহত হয়েছেন।

বিবিসির খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের জাতীয় জরুরি পরিষেবার প্রধান ম্যাগেন ডেভিড অ্যাডম জানান, মধ্য ইসরায়েলজুড়ে ইরানের হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুইজন নারী, একজন পুরুষ। 

এর আগে সিএনএন ইসরায়েলের ১৫ জন নিহত হওয়ার খবর দেয়। ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম কানের খবর বলছে, ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে হামলায় একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এছাড়াও বন্দরনগরী হাইফায় অন্তত দুইজন আহত হয়েছেন। এছাড়াও সেখান আরও তিনজন নিখোঁজ রয়েছেন।

এর আগে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছিল, ইরান থেকে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু হয়েছে। একাধিক ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করেছে ইসরায়েল। বর্তমানে হামলা প্রতিহত করার কাজ চলছে বলে জানিয়েছে আইডিএফ।

আজ সিএনএনের এক খবরে বলা হয়েছে, তেল আবিব ও জেরুজালেমসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন শহরে জরুরি সতর্ক সংকেত (সাইরেন) বাজতে শুরু করেছে। আইডিএফ সতর্ক করে বলেছে, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি অভেদ্য নয়।

সিএনএনের একজন প্রযোজক জেরুজালেমে সাইরেন এবং একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। তার তোলা ভিডিওতে আকাশে বহু ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যেতে দেখা গেছে।

ইসরায়েলের জরুরি পরিষেবা সংস্থা ম্যাগেন ডেভিড আদোম জানিয়েছে, তাদের দলগুলো আক্রান্ত এলাকার দিকে রওনা দিয়েছে।

সারা দেশের নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেখানে থাকার আহ্বান জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেছে, বর্তমানে বিমানবাহিনী হামলা প্রতিহত করার পাশাপাশি পাল্টা হামলা চালানোর কাজ করছে।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ওয়াইনেট নিউজ জানিয়েছে, মধ্য ইসরায়েলের পেতাহ টিকভা শহরের একটি ভবনে একটি ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হেনেছে। হামলার ফলে ওই স্থানে আগুন ধরে যায়। তবে এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

এদিকে মধ্য ইরানে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির সেনাবাহিনী এ তথ্য জানিয়েছে। আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর দাবি, বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালানো হয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরায়েলি বিমানবাহিনী সফলভাবে মধ্য ইরানে অবস্থিত একাধিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। আমাদের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এসব স্থাপনা থেকে ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হচ্ছিল।’

তবে ইসরায়েলের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

এদিকে ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি বিমান হামলায় রোববার পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা বেড়ে ২২৪ জনে পৌঁছেছে।

বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ৯০ শতাংশেরও বেশি বেসামরিক নাগরিক। হামলায় ১ হাজার ২৭০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

এপির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ১৩ জুন ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ওই হামলায় ইরানের নাতাঞ্জ ও ইসফাহান অঞ্চলের পারমাণবিক স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হন। ইরানে বর্তমানে মসজিদ ও মেট্রো স্টেশনগুলোকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের তিন শিশুসহ অন্তত ১৫ জন নিহত হয়েছেন। রোববার ইসরায়েল সরকারের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।

ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এছাড়া ইরানের হামলায় কমপক্ষে ৩৮৫ জন আহত হয়েছেন, যার মধ্যে সাত জনের অবস্থা গুরুতর।

এদিকে ইসরায়েলি পুলিশের বরাতে আল জাজিরা জানিয়েছে, তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত বাত ইয়াম শহরে ৬ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুই শিশু রয়েছে। এছাড়া সাতজন এখনও নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন জরুরি সেবাদানকারীরা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ