ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন প্রথমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন তিনি একতরফাভাবে কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে এই চুক্তিটি হয় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য দেশ যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জার্মানি। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ট্রাম্প ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে ইরানের ওপর জোর খাটান। 

আল-আকসা ফ্লাডের পর ইরান তার রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির অনেক কিছুই খুইয়েছে। ইরানের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার কারণ তিনটি। প্রথমত, ইরানের আঞ্চলিক প্রধান মিত্র সিরিয়ার বাথ পার্টি ক্ষমতা হারিয়েছে। সিরিয়ার বিরোধী দল গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে এবং সেখানে ইরানের প্রভাব কমে যায়। দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল হিজবুল্লাহকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত লেবাননে হিজবুল্লাহ ছিল প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি, যারা ওই অঞ্চলে ইরানের প্রক্সি শক্তি। তৃতীয়ত, ইসরায়েল সরাসরি ইরানকে এবং মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা ইরানি বাহিনীকে নিশানা করে। 

ফলস্বরূপ ইরান এক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। বর্তমানে ইরানের কৌশল হলো আত্মরক্ষামূলক। ট্রাম্প প্রশাসনের চাপের ফলে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়। গত মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির কাছে চিঠি পাঠান, যেখানে ইরানের সঙ্গে সরাসরি পারমাণবিক আলোচনা শুরুর আহ্বান আছে। ওমানের মাধ্যমে চিঠির জবাব দেয় ইরান। এভাবে ১২ এপ্রিল ওমানের রাজধানী মাসকটে প্রথম দফায় পরোক্ষভাবে পারমাণবিক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের দিক থেকে বলা হয়, আলোচনা ছিল ‘ইতিবাচক ও গঠনমূলক’।
দ্বিতীয় দফায় উভয় পক্ষ ১৯ এপ্রিল ইতালির রাজধানী রোমে আলোচনায় বসে। সেখানে ইরানের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি; যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অংশ নেন মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক ট্রাম্পের বিশেষ প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোমে বৈঠকের সময় বলেন, ‘আমরা কিছু নীতি ও লক্ষ্যের ব্যাপারে ভালো বোঝাপড়ার মধ্যে পৌঁছেছি।’ ২৬ এপ্রিল ওমানের মাসকটে তৃতীয় দফার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। 
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা ইরানের জন্য সমস্যাজনক এই জন্য যে, এ পদক্ষেপ ইরানের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, যা মূলত আমেরিকাবিরোধী মনোভাবের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইরান বর্তমানে বড় ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা স্পষ্ট– রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কারণে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে হয়েছে। এ অবস্থা ইরানি শাসন ব্যবস্থার জন্য আরও সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

স্পষ্টতই ইরান উভয় সংকটের মধ্যে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করলে ইরানের যেমন অনেক সুবিধা, তেমনি অনেক অসুবিধাও আছে। ইরান যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হতে পারে এবং ইরান তার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারবে। এমনকি ইরান যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিনিয়োগও আকর্ষণ করতে সক্ষম হতে পারে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে দেশীয় রাজনৈতিক চাপও কমাতে পারে। বিপরীতে, দুই দেশের চুক্তির মাধ্যমে দেশীয় প্রেক্ষাপটে ইরানি শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হতে পারে। ইরান অস্তিত্ব সংকটেও পড়তে পারে। ইরানি জনগণের একটি বড় অংশের দৃষ্টিতে তখন শাসন ব্যবস্থা বৈধতার সংকটে পড়বে। কারণ ইরানের শাসন ব্যবস্থা মূলত তার পশ্চিমাবিরোধী রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে বৈধতা পায়।
চুক্তিতে না পৌঁছার সংকটও কম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিতে পৌঁছতে না পারলে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়কে মোকাবিলা করতে হবে।  ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়ালে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের নিশানায় পরিণত হতে পারে, যা তার শাসন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা আরও নড়বড়ে করে দিতে পারে। 

তবে দৃশ্যত মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের চূড়ান্ত চূক্তিতে পৌঁছা অসম্ভব। কারণ উভয় দিকের প্রত্যাশা ভিন্ন। একদিকে ট্রাম্প চান ইরানের পারমাণবিক শক্তি পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে। অন্যদিকে ইরান সীমিত পর্যায়ে তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে নিতে চায়। পাশাপাশি ইরান এই ঘোষণাও দিয়েছে, তারা পারমাণবিকের বাইরের বিষয়ে আলোচনা করবে না। অধিকন্তু উভয় দেশের মধ্যকার অবিশ্বাসও চুক্তি সফল হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

মুহিত্তিন আতামান: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সোশ্যাল সায়েন্সেস ইউনিভার্সিটি অব আঙ্কারা; ডেইলি সাবাহ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত ক ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।

সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।

ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ