রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিতে সরকার যেসব কমিশন গঠন করে, তার একটি ছিল নারীদের বিষয়ে। ১৯ এপ্রিল সেই কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৪৩৩টি সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর থেকে এ নিয়ে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। ফেসবুক থেকে শুরু করে নানান মাধ্যমে ফতোয়া, হেফাজতে ইসলামসহ একাধিক ইসলামি সংগঠন এবং আলেম সমাজ—সবার কণ্ঠে এক দাবি, শুধু প্রতিবেদনটি নয়, বাতিল করতে হবে পুরো কমিশনকে।

অভিযোগের তালিকাও বেশ লম্বা। ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত, ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থান, ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে পারিবারিক কাঠামো ভাঙার চেষ্টাসহ আরও অনেক কিছু। নারীর অধিকারের নামে পশ্চিমা ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথাও এসেছে বারবার। এর আগেও প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ, দুদকসহ অনেক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়েছে। নারীর প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো কমিশন আমূল ছুড়ে ফেলার আলাপ দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। শিল্প, কৃষিসহ সব খাতে তাঁরা বিপুল সংখ্যায় সক্রিয়। প্রশ্ন ওঠে, নারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আইনকানুনের সংস্কারে এত আপত্তির জায়গা কোথায়? কেবল কোনো বিশেষ সুপারিশ নয়, সব সুপারিশসহ পুরো কমিশন কেন বাতিল করতে হবে? নারীর জন্য কিছু সুপারিশও কি বাস্তবায়ন করা যায় না?

মাত্র আট মাস আগের অভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক সাহসী অংশগ্রহণ ‘দ্বিতীয় রিপাবলিকে’ তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের আশ্বাস জাগিয়েছিল। আর এখন সেমিনার, সমাবেশ, হেডলাইন—সবখানে ‘নারীরা কোথায় গেল?’ আলোচনা থেকে সর্বশেষ আওয়াজ—নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন পুরোটাই বাতিল করতে হবে।

অভ্যুত্থানের আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা-হতাশা-ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁদের অবস্থা পাল্টাতে কার্যকর উদ্যোগ বেশ বিরল। শেষ পর্যন্ত বহু প্রতীক্ষিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা এলেও প্রজ্ঞাপন জারি হতে চলে যায় অনেক সময়। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা পাচ্ছি সেই কমিশনের সুপারিশ বাতিলের দাবি। কোটি কোটি নারীর সংগত প্রশ্ন থাকতে পারে—এই অভ্যুত্থান তাহলে তাঁদের কী দিল? কিংবা কেন কিছু দিতে চাইছে না?

অভ্যুত্থানের আগে-পরে বিপরীত চিত্র

অভ্যুত্থানের নারীরা কোথায় হারিয়ে গেলেন—বহুল জিজ্ঞাসিত এ প্রশ্ন যাঁরা করেছেন, তাঁরা হয়তো এখন বুঝতে পারছেন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ শেষে নারীরা কেন হারিয়ে যান? একাত্তরে, নব্বইয়েও এমনটি ঘটেছিল। অভ্যুত্থানের নারীরা কেন হারিয়ে যান—এ প্রশ্নের উত্তর নারীদের না করে বরং অভ্যুত্থানকারী পুরুষদেরই করা সমীচীন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম এবং আন্দোলনের ফসল হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার আদতেই পুরুষতান্ত্রিক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় এখন। এটা কেবল এই কারণে নয় যে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে হরেদরে সমালোচনায় সরকার বেশ নীরব হয়ে আছে; বরং এটিও যে আন্দোলনের পর থেকে নারীদের অনলাইনে বডি শেমিং, হয়রানি, ধর্ষণের হুমকি, সহিংসতা, খেলা বন্ধ করাসহ রক্ষণশীলতার নানা হুমকি কেবল বাড়ছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ তরুণ নারী সংগঠকেরা সামান্যই সরকারের কোনো সংস্কারধর্মী উদ্যোগে শামিল হতে পেরেছেন। আবার এ রকম ক্ষেত্রে চরম রাজধানীমুখিতাও দেখছি আমরা। ঢাকার বাইরেও যে হাজার হাজার মেয়ে আন্দোলনে শরিক ছিলেন, তাঁদের ঘরে পুরেই যেন সবাই স্বস্তিতে আছে।

জুলাইয়ে নারী হয়ে রাজপথে নামার অভিজ্ঞতা সবার ক্ষেত্রে অনেকটা অভিন্ন হলেও কে কোথা থেকে প্রতিবাদ করছেন, সেটাই যেন এখন মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। ঢাকার আন্দোলনে প্রথম সারিতে থাকা চট্টগ্রামের উমামা ফাতেমাকে সবাই ন্যায্যত গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু চট্টগ্রামেই যেসব নারী আন্দোলনকারী প্রথম থেকেই মাঠে ছিলেন, ছাত্রলীগের সহিংসতার শিকার, পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন, তাঁদের কথা কোথায়? তাঁদের নিয়ে পত্রিকায় খবর নেই, সাক্ষাৎকার নেই, নেই কোনো হেডলাইন।

নারীর কোণঠাসা অবস্থার এত সুবিধাভোগী যে সেই ‘স্থিতিশীলতা’ ভাঙতে গেলে অনেকের আপত্তি থাকবে। আইয়ুব খানের মতো স্বৈরশাসক সে রকম প্রতিরোধ ভাঙতে পারলে এত বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আসা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার পারবে না কেন?

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত শিক্ষার্থী সুমাইয়া শিকদারের কথা ধরা যাক। জুলাইয়ের শুরু থেকে ছিলেন চট্টগ্রামের আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। অভ্যুত্থানের পর ৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ছাত্ররা যখন ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা হল’-এর সামনে ভাঙচুর, নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, বিদ্বেষমূলক কটূক্তি করা শুরু করেন, ছাত্রীরা তখন হল এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, সুমাইয়াসহ অনেকেই করেন সেই প্রতিবাদ। ‘হাসিনার দোসর’, ‘ফ্যাসিস্ট’ গালিও হজম করা লাগে তাঁদের তখন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এক শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার অভিযোগসহ সে ঘটনায় নয়জন ছাত্রীসহ বহিষ্কার হন সুমাইয়া।

চট্টগ্রামে অ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নেওয়া শাকিরা সাঞ্জু আন্দোলনে যাওয়ার অপরাধে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাঁর হাত ভেঙে দেন। এমন সহিংসতার শিকার হয়েও তিনি যখন ঢাকায় ‘জুলাইয়ের কন্যারা, আমরা তোমাদের হারিয়ে যেতে দেব না’ শীর্ষক সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন, তাঁকে শুনতে হয়, ‘তুমি উমামা ফাতেমাকে চেনো না? তাহলে কেমন আন্দোলনকারী তুমি?’

আসলে অভ্যুত্থানের পরপর নারীদের চলমান অনুপস্থিতি পরিকল্পিত, কাঠামোগত। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখে সেটাই কিন্তু মনে আসে। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে দেখা যাবে বলে ভেবেছিলেন অনেকে। নারীরাও ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন দুর্ভাবনা বাড়ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কি নারীবিরোধী সর্বশেষ প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম?

সরকারের কাজে একদিকে যেমন রয়েছে হতাশা, তেমনি শেষ মুহূর্তের কিছু প্রত্যাশা থাকছেই। নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে সংস্কারের জাতীয় আয়োজনে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করা দরকার। একটা মন্ত্রণালয় বা কমিশনের ওপর জোর না দিয়ে সব কটি মন্ত্রণালয়ের কাজ নারীমুখী করা দরকার। আর আন্দোলনের নারীদের খুঁজে পেতে তাঁদের অ্যাকটিভিজমের পরিসর থেকে মূলধারার রাজনীতিতে ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য আইনগত সংস্কারও জরুরি।

নারীর কোণঠাসা অবস্থার এত সুবিধাভোগী যে সেই ‘স্থিতিশীলতা’ ভাঙতে গেলে অনেকের আপত্তি থাকবে। আইয়ুব খানের মতো স্বৈরশাসক সে রকম প্রতিরোধ ভাঙতে পারলে এত বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আসা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার পারবে না কেন?

আয়েশা হুমায়ারা ওয়ারেসা: লেখক।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন র পর সরক র অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

আজও আছে পরতে পরতে সৌন্দর্য

কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে মনোহর সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশে ভবনের চারপাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী পরীর আবক্ষ মূর্তি। ছবির মতো সাজানো ‘পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি’ এখন কালের সাক্ষী।

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কলমাই নদীতীরে ১৫ একর জমিতে জমিদারবাড়িটি। ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরোনো মন্দির। লোকমুখে প্রচলিত, শরতের দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে এখানে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা কারিগররা। কালের বিবর্তনে স্থানটি এখন নির্জন। নেই আগের গৌরব-আভিজাত্যের ছাপ, এমনকি প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততাও।

মন্দির ঘুরে দেখা যায়, এর কোথাও কোথাও ইট খসে পড়েছে। পুরোনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল, যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।

দোতলা ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। যদিও সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি। এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তিরও দেখা মেলে। জমিদার আমলের টিনের চৌচালা ঘরে অস্থায়ীভাবে সরকারি তহশিল অফিস স্থানান্তর হলেও, সেটি এখন স্থায়িত্ব পেয়েছে।

লতাপতায় আচ্ছন্ন ভবনের একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেকাংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবনটির পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা মুগ্ধ করে।

দোতল আরেকটি মহল, যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্য সব ভবনের সঙ্গে এটির নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনটির বারান্দা ও পুরোনো কাঠের দরজা সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। ভবনটির মাথায় ময়ূরের সঙ্গে দুই পাশে দুই নারী মূর্তির দেখা মেলে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে গাছগাছালির সবুজে ঘেরা পুরো জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বিমোহিত করতে বাধ্য। যদিও ভবনের ভিন্ন অংশ খসে পড়ছে, হারাচ্ছে রূপ-লাবণ্য।

জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে দীঘি ও দুটি পরিত্যক্ত কূপ। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাটমন্দির। জানা যায়, নাগরপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আসেন ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল। তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জমি কিনে জমিদারি শুরু করেন।

রামকৃষ্ণ সাহার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধাগোবিন্দ। রাধা নিঃসন্তান। তবে বৃন্দাবনের তিন ছেলে– ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি তিন ভাইয়ের তরফে বিভক্ত থাকলেও, জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত। বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে কাকা রাধাগোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র কাকার জমিদারির পুরো সম্পত্তি লাভ করেন।

দৃষ্টিনন্দন পাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার না হওয়ায় একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে ইতিহাস। জমিদারবাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ