নারীদের হারিয়ে যাওয়া বনাম হারিয়ে দেওয়া
Published: 29th, April 2025 GMT
রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিতে সরকার যেসব কমিশন গঠন করে, তার একটি ছিল নারীদের বিষয়ে। ১৯ এপ্রিল সেই কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে ৪৩৩টি সুপারিশসংবলিত একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর থেকে এ নিয়ে বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। ফেসবুক থেকে শুরু করে নানান মাধ্যমে ফতোয়া, হেফাজতে ইসলামসহ একাধিক ইসলামি সংগঠন এবং আলেম সমাজ—সবার কণ্ঠে এক দাবি, শুধু প্রতিবেদনটি নয়, বাতিল করতে হবে পুরো কমিশনকে।
অভিযোগের তালিকাও বেশ লম্বা। ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত, ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থান, ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে পারিবারিক কাঠামো ভাঙার চেষ্টাসহ আরও অনেক কিছু। নারীর অধিকারের নামে পশ্চিমা ভাবাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথাও এসেছে বারবার। এর আগেও প্রধান উপদেষ্টার কাছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ, দুদকসহ অনেক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন জমা পড়েছে। নারীর প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কোনো কমিশন আমূল ছুড়ে ফেলার আলাপ দেখা যায়নি।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। শিল্প, কৃষিসহ সব খাতে তাঁরা বিপুল সংখ্যায় সক্রিয়। প্রশ্ন ওঠে, নারীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আইনকানুনের সংস্কারে এত আপত্তির জায়গা কোথায়? কেবল কোনো বিশেষ সুপারিশ নয়, সব সুপারিশসহ পুরো কমিশন কেন বাতিল করতে হবে? নারীর জন্য কিছু সুপারিশও কি বাস্তবায়ন করা যায় না?
মাত্র আট মাস আগের অভ্যুত্থানে নারীদের ব্যাপক সাহসী অংশগ্রহণ ‘দ্বিতীয় রিপাবলিকে’ তাঁদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের আশ্বাস জাগিয়েছিল। আর এখন সেমিনার, সমাবেশ, হেডলাইন—সবখানে ‘নারীরা কোথায় গেল?’ আলোচনা থেকে সর্বশেষ আওয়াজ—নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন পুরোটাই বাতিল করতে হবে।
অভ্যুত্থানের আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা-হতাশা-ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁদের অবস্থা পাল্টাতে কার্যকর উদ্যোগ বেশ বিরল। শেষ পর্যন্ত বহু প্রতীক্ষিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠনের ঘোষণা এলেও প্রজ্ঞাপন জারি হতে চলে যায় অনেক সময়। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে আমরা পাচ্ছি সেই কমিশনের সুপারিশ বাতিলের দাবি। কোটি কোটি নারীর সংগত প্রশ্ন থাকতে পারে—এই অভ্যুত্থান তাহলে তাঁদের কী দিল? কিংবা কেন কিছু দিতে চাইছে না?
অভ্যুত্থানের আগে-পরে বিপরীত চিত্রঅভ্যুত্থানের নারীরা কোথায় হারিয়ে গেলেন—বহুল জিজ্ঞাসিত এ প্রশ্ন যাঁরা করেছেন, তাঁরা হয়তো এখন বুঝতে পারছেন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ শেষে নারীরা কেন হারিয়ে যান? একাত্তরে, নব্বইয়েও এমনটি ঘটেছিল। অভ্যুত্থানের নারীরা কেন হারিয়ে যান—এ প্রশ্নের উত্তর নারীদের না করে বরং অভ্যুত্থানকারী পুরুষদেরই করা সমীচীন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম এবং আন্দোলনের ফসল হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার আদতেই পুরুষতান্ত্রিক কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় এখন। এটা কেবল এই কারণে নয় যে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে হরেদরে সমালোচনায় সরকার বেশ নীরব হয়ে আছে; বরং এটিও যে আন্দোলনের পর থেকে নারীদের অনলাইনে বডি শেমিং, হয়রানি, ধর্ষণের হুমকি, সহিংসতা, খেলা বন্ধ করাসহ রক্ষণশীলতার নানা হুমকি কেবল বাড়ছে। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ তরুণ নারী সংগঠকেরা সামান্যই সরকারের কোনো সংস্কারধর্মী উদ্যোগে শামিল হতে পেরেছেন। আবার এ রকম ক্ষেত্রে চরম রাজধানীমুখিতাও দেখছি আমরা। ঢাকার বাইরেও যে হাজার হাজার মেয়ে আন্দোলনে শরিক ছিলেন, তাঁদের ঘরে পুরেই যেন সবাই স্বস্তিতে আছে।
জুলাইয়ে নারী হয়ে রাজপথে নামার অভিজ্ঞতা সবার ক্ষেত্রে অনেকটা অভিন্ন হলেও কে কোথা থেকে প্রতিবাদ করছেন, সেটাই যেন এখন মূল্যায়নের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে। ঢাকার আন্দোলনে প্রথম সারিতে থাকা চট্টগ্রামের উমামা ফাতেমাকে সবাই ন্যায্যত গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু চট্টগ্রামেই যেসব নারী আন্দোলনকারী প্রথম থেকেই মাঠে ছিলেন, ছাত্রলীগের সহিংসতার শিকার, পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছেন, তাঁদের কথা কোথায়? তাঁদের নিয়ে পত্রিকায় খবর নেই, সাক্ষাৎকার নেই, নেই কোনো হেডলাইন।
নারীর কোণঠাসা অবস্থার এত সুবিধাভোগী যে সেই ‘স্থিতিশীলতা’ ভাঙতে গেলে অনেকের আপত্তি থাকবে। আইয়ুব খানের মতো স্বৈরশাসক সে রকম প্রতিরোধ ভাঙতে পারলে এত বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আসা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার পারবে না কেন?চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত শিক্ষার্থী সুমাইয়া শিকদারের কথা ধরা যাক। জুলাইয়ের শুরু থেকে ছিলেন চট্টগ্রামের আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক। অভ্যুত্থানের পর ৫ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে ছাত্ররা যখন ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা হল’-এর সামনে ভাঙচুর, নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ, বিদ্বেষমূলক কটূক্তি করা শুরু করেন, ছাত্রীরা তখন হল এলাকার নিরাপত্তা রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, সুমাইয়াসহ অনেকেই করেন সেই প্রতিবাদ। ‘হাসিনার দোসর’, ‘ফ্যাসিস্ট’ গালিও হজম করা লাগে তাঁদের তখন। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে এক শিক্ষকের গায়ে হাত তোলার অভিযোগসহ সে ঘটনায় নয়জন ছাত্রীসহ বহিষ্কার হন সুমাইয়া।
চট্টগ্রামে অ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নেওয়া শাকিরা সাঞ্জু আন্দোলনে যাওয়ার অপরাধে ছাত্রলীগের কর্মীরা তাঁর হাত ভেঙে দেন। এমন সহিংসতার শিকার হয়েও তিনি যখন ঢাকায় ‘জুলাইয়ের কন্যারা, আমরা তোমাদের হারিয়ে যেতে দেব না’ শীর্ষক সমাবেশে যোগ দিতে এসেছিলেন, তাঁকে শুনতে হয়, ‘তুমি উমামা ফাতেমাকে চেনো না? তাহলে কেমন আন্দোলনকারী তুমি?’
আসলে অভ্যুত্থানের পরপর নারীদের চলমান অনুপস্থিতি পরিকল্পিত, কাঠামোগত। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখে সেটাই কিন্তু মনে আসে। ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশকে ভিন্নভাবে দেখা যাবে বলে ভেবেছিলেন অনেকে। নারীরাও ভেবেছিলেন। কিন্তু এখন দুর্ভাবনা বাড়ছে, অন্তর্বর্তী সরকার কি নারীবিরোধী সর্বশেষ প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম?
সরকারের কাজে একদিকে যেমন রয়েছে হতাশা, তেমনি শেষ মুহূর্তের কিছু প্রত্যাশা থাকছেই। নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে সংস্কারের জাতীয় আয়োজনে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করা দরকার। একটা মন্ত্রণালয় বা কমিশনের ওপর জোর না দিয়ে সব কটি মন্ত্রণালয়ের কাজ নারীমুখী করা দরকার। আর আন্দোলনের নারীদের খুঁজে পেতে তাঁদের অ্যাকটিভিজমের পরিসর থেকে মূলধারার রাজনীতিতে ঠাঁই করে দেওয়ার জন্য আইনগত সংস্কারও জরুরি।
নারীর কোণঠাসা অবস্থার এত সুবিধাভোগী যে সেই ‘স্থিতিশীলতা’ ভাঙতে গেলে অনেকের আপত্তি থাকবে। আইয়ুব খানের মতো স্বৈরশাসক সে রকম প্রতিরোধ ভাঙতে পারলে এত বিপুল জনসমর্থন নিয়ে আসা গণ-অভ্যুত্থানের সরকার পারবে না কেন?
আয়েশা হুমায়ারা ওয়ারেসা: লেখক।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মঙ্গলবার কুয়াকাটায় রাস উৎসব, গঙ্গা স্নান বুধবার
প্রায় ২০০ বছর ধরে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মদনমোহন সেবাশ্রম মন্দির ও কুয়াকাটার রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরে পৃথক আয়োজনে রাস উৎসব পালন করে আসছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। এবছরও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে হবে এ উৎসব। রাস উৎসব উপলক্ষে কলাপাড়ায় বসছে ৫ দিনব্যাপী মেলা।
কলাপাড়ায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, শেষ সময়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে মন্দিরের আঙ্গিনাসহ রাধা ও কৃষ্ণের ১৭ জোড়া প্রতিমা।
মঙ্গলবার পূর্ণিমা তিথিতে রাত ৯টা ২২ মিনিটে অধিবাসের মধ্যে দিয়ে শুরু হবে রাস পূজার আনুষ্ঠানিকতা। পরের দিন বুধবার সন্ধ্যা ৭টা ৬ মিনিটে এ তিথি শেষ হবে। সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কুয়াকাটা সৈকতে গঙ্গা স্নান করবেন পুণ্যার্থীরা। এর পর মন্দিরের আঙ্গিনায় রাধা-কৃষ্ণের যুগল প্রতিমা দর্শন করবেন তারা। তাই, দুই মন্দিরেই ১৭ জোড়া প্রতিমা বানানো হয়েছে। প্যান্ডেল সাজানোর কাজ শেষ। চলছে লাইটিং ও সাজসজ্জার কাজ।
এ উৎসব উপলক্ষে কলাপাড়ার মন্দির প্রাঙ্গণ, কুয়াকাটার মন্দির প্রাঙ্গণ ও সৈকতে অস্থায়ীভাবে বসছে শতাধিক পোশাক, প্রসাধনী, খেলনা ও গৃহস্থালী সামগ্রীর দোকান। কুয়াকাটায় তিন দিনব্যাপী উৎসব হলেও কলাপাড়ায় এ উৎসব চলবে পাঁচ দিন। এসব দোকানে অন্তত ৩০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রির আশা করছেন আয়োজকরা।
কলাপাড়ার শ্রী শ্রী মদনমোহন সেবাশ্রমের রাস উদযাপন কমিটির সভাপতি দিলীপ কুমার হাওলাদার বলেছেন, আজকের মধ্যেই আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। হিন্দু ধর্মালম্বীদের এ উৎসব হলেও এখানে ৫ দিনব্যাপী মেলায় সব ধর্মের মানুষের আগমন ঘটে। আমাদের মন্দির প্রাঙ্গণে অন্তত ৭০টি দোকান বসেছে। আশা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে রাস উৎসব সম্পন্ন হবে।
কুয়াকাটার রাধা-কৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক নীহার রঞ্জন মন্ডল বলেছেন, আগামীকাল রাতভর মন্দির প্রাঙ্গণে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলবে। পরদিন সকালে গঙ্গা স্নান হবে। লাখো পুণ্যার্থীর আগমনের আশা করছি আমরা। বুধবারও গঙ্গা স্নান হবে। উৎসব উপলক্ষে আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
কলাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউসার হামিদ বলেছেন, রাস উৎসব উপলক্ষে কুয়াকাটায় ১ লাখ পুণ্যার্থী সমাগমের আশা করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি, শান্তিপূর্ণভাবে এ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে।
ঢাকা/ইমরান/রফিক