বিএনপি সমর্থিত শ্রমিকদের হামলায় এনসিপির শ্রমিক সমাবেশ পণ্ড
Published: 29th, April 2025 GMT
মোংলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) শ্রমিক উইংয়ের ডাকা পূর্বঘোষিত সমাবেশ বিএনপি সমর্থিত শ্রমিকদের হামলায় পণ্ড হয়েছে। সমাবেশস্থল সংলগ্ন মদিনা হোটেল এলাকায় পৌঁছামাত্রই তাদের ওপর অতর্কিত হামলা হয়। এ হামলায় এনসিপির শ্রমিক সংগঠনের এক নারী নেত্রীসহ অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মাগরিবের আজানের আগে এ ঘটনা ঘটে। এনসিপির শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা তাদের সমর্থিত স্থানীয় শ্রমিকদের সঙ্গে নিয়ে এ সমাবেশে যোগ দিতে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সমাবেশ স্থলে না পৌঁছে প্রাণ বাঁচাতে দিগ্বিদিক ছুটে রক্ষা পেয়েছেন তারা।
হামলা ও লাঞ্ছনার শিকার হয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতারা রাত সাড়ে ৮টায় মোংলা ত্যাগ করে। এনসিপির শ্রমিক উইংয়ের কেন্দ্রীয় নেতাদের অভিযোগ, ‘জিয়ার সৈনিক, এক হও’ শ্লোগান দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুষ্কৃতিকারীরা তাদের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটায় এনসিপির শ্রমিক উইং মোংলা বন্দরে জাহাজে কর্মরত মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের নিয়ে শ্রমিক সংঘ চত্বরে (মাঠে) সাধারণ সভা আয়োজন করে। এনসিপির কেন্দ্রীয় শ্রমিক উইংয়ের নেতারা এদিন আসতে দেরি করেন। পরে পৌনে ৬টার দিকে শ্রমিক সংঘ সংলগ্ন মদিনা হোটেল এলাকায় পৌঁছুলে তাদের মিছিল ও যাত্রারোধ করে সেখানে আগে থেকে জড়ো হওয়া বিপুল সংখ্যক বিএনপি সমর্থিত শ্রমিকসহ তাদের সহযোগীরা। এ সময় শুরু হয় হট্টগোল। একপর্যায়ে হামলা ও মারধরের ঘটনা ঘটে।
এর আগে সোমবার দুপুরে শ্রমিক সংঘ চত্বরে পূর্বঘোষিত সমাবেশস্থল দেখতে গিয়ে এনসিপির কেন্দ্রীয় সংগঠক ও শ্রমিক উইংয়ের স্থানীয় নেতা তিতুমীর চোকদারসহ ৩-৪ জন শ্রমিক হামলা ও মারধরের শিকার শিকার হয়। এ ঘটনায় মোংলা বন্দরে শ্রমিক সংগঠন দখল নিয়ে বিএনপি ও এনসিপি মুখোমুখী অবস্থান নেয়।
এ ঘটনার প্রতিবাদে (সোমবার সন্ধ্যায়) ঢাকায় এনসিপির প্রতিবাদ বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত। এনসিপির এ কর্মসূচির প্রতিবাদে মঙ্গলবার দুপুরে মোংলা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি সমর্থিত শ্রমিক নেতারা। এ সময় লিখিত বক্তব্যে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন তারা। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়, পতিত আ’লীগের দোসর চক্র এনসিপির ওপর ভর করে মোংলা সমুদ্র বন্দরে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করছে।
সংবাদ সম্মেলনে বাগেরহাট জেলা যুবদলের সদস্য ও মোংলা পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র মো.
বিএনপির এ সংবাদ সম্মেলন ও ঢাকায় এনসিপির বিক্ষোভ মিছিল এবং মঙ্গলবার বিকালে মোংলায় শ্রমিক উইংয়ের সমাবেশকে ঘিরে দুপুর থেকে শহর জুড়ে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। বিকাল ৩টা থেকে শ্রমিক সংঘ চত্বর ও আশপাশে পুলিশ, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড টহল ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। শহরের মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
অপরদিকে দুপুর থেকে মোংলা শহরের বিএনপি সমর্থিত শ্রমিকদের একাংশের বিক্ষোভ মিছিল ও মহড়ায় শহর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাচীর ভেদ করে শ্রমিকদের কোনো পক্ষ সভাস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। আর দ্বিধাবিভক্ত শ্রমিকদের হামলা ও পাল্টা হামলায় পণ্ড হয় এনসিপির শ্রমিক সংগঠনের সমাবেশ।
এ প্রসঙ্গে এনসিপির শ্রমিক উইংয়ের কেন্দ্রীয় শাখার যুগ্ম সমন্বয়কারী মোশারফ হোসেন স্বপন অভিযোগ করে বলেন, বিগত আ’লীগ আমলে বন্দরের শ্রমিক সংগঠন অকার্যকর রেখে সাধারণ শ্রমিকদের ওপর জুলুম করা হয়েছিল। এ সংগঠনের নির্বাচন ও তলবি সাধারণ সভায় অতিথি হিসেবে তিনি এবং কেন্দ্রীয় নারী নেত্রীসহ ৮ নেতা যোগ দিতে এসেছিলেন। কিন্তু তাদের ওপর ন্যাক্কারজনক হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা ‘জিয়ার সৈনিক’ হিসেবে শ্লোগান দিয়ে এ হামলায় অংশ নেয়। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এনসিপির শ্রমিক উইং কেন্দ্রীয় কমিটি কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
এদিকে হামলার পর বিএনপি সমর্থিত শ্রমিকরা শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় বিএনপি সমর্থিত শ্রমিক নেতা মো. আলাউদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তার পাশে অবস্থান করছিলেন। এ সময় শ্রমিক নামধারী তিতুমীরের নেতৃত্বে বহিরাগতরা মিলে তাদের ওপর হামলা চালিয়ে সাতজনকে আহত করেছে।
এ বিষয়ে মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে শ্রমকিদের দুই গ্রুপের মধ্যে হামলা ও সংঘাতের ঘটনা ঘটে। তবে কেউ লিখিত কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরদিকে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার রাতে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মোংলা বন্দর শ্রমিক কর্মচারী সংঘ রেজি নং-২১৪৩ শাব্দিক অর্থে মোংলা বন্দরের শ্রমিক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি একটি স্টিভেডর নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক দ্বারা পরিচালিত সংগঠন। এই শ্রমিকগণ স্টিভেডরদের নিয়ন্ত্রণে বন্দরে আগত সকল বাণিজ্যিক জাহাজ থেকে পণ্য খালাস-বোঝাইয়ের কাজ করে থাকে। মোংলা বন্দরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত স্টিভেডররা এ সকল শ্রমিকদের নিয়োগ, পরিচালনা ও সকল পাওনাদি পরিশোধ করে থাকেন। মোংলা বন্দর কোনো শ্রমিক নিয়োগ/পরিচালনা করে না। মোংলা বন্দরের শ্রমিক নেতাদের উপর হামলার সংবাদটি মূলত স্টিভেডর শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ।
বন্দরের পরিচালক (বোর্ড) স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, দেশের আমদানি-রপ্তানির ধারাবাহিকতা ও উত্তরোত্তর উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে এই সমুদ্রবন্দর বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। শ্রমিকদের এ ধরনের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে দেশে ও বিদেশে মোংলা বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, এ ধরনের সৃষ্ট সমস্যার ফলে যদি মোংলা বন্দরে জাহাজ আগমন কমে যায় তাহলে বন্দরের উপর নির্ভরশীল হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে সপরিবারে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হবে। সে সাথে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। দেশের অভ্যন্তরে ও বিদেশে বন্দরের ভাবমূর্তি সম্পর্কিত বিধায় বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ এনস প ত দ র ওপর স গঠন র অবস থ ন পর চ ল ব এনপ এ সময়
এছাড়াও পড়ুন:
আজও আছে পরতে পরতে সৌন্দর্য
কারুকার্যখচিত বিশাল ভবন। দেয়ালের পরতে পরতে মনোহর সৌন্দর্য। মনোরম পরিবেশে ভবনের চারপাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী পরীর আবক্ষ মূর্তি। ছবির মতো সাজানো ‘পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি’ এখন কালের সাক্ষী।
মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে টাঙ্গাইলের নাগরপুরের কলমাই নদীতীরে ১৫ একর জমিতে জমিদারবাড়িটি। ঢুকতেই চোখে পড়ে পুরোনো মন্দির। লোকমুখে প্রচলিত, শরতের দিনে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরিতে এখানে ব্যস্ত থাকতেন ভারতবর্ষের নামকরা কারিগররা। কালের বিবর্তনে স্থানটি এখন নির্জন। নেই আগের গৌরব-আভিজাত্যের ছাপ, এমনকি প্রতিমা তৈরির ব্যস্ততাও।
মন্দির ঘুরে দেখা যায়, এর কোথাও কোথাও ইট খসে পড়েছে। পুরোনো দিনের নকশা হারাচ্ছে তার সৌন্দর্য। মন্দিরের পেছনে বিশাল তিনটি মহল, যা সেকালে তিন তরফ নামে পরিচিত ছিল। মহলগুলোর আলাদা কোনো নাম পাওয়া যায়নি। সবচেয়ে বড় মহলে বর্তমান পাকুটিয়া বিসিআরজি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ পরিচালিত হচ্ছে।
দোতলা ভবনের নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে সবাইকে। যদিও সংস্কারের অভাবে ভবনটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। পাশেই অপূর্ব লতাপাতার কারুকার্যখচিত বিশাল আরেকটি ভবন, যার মাথায় ময়ূরের মূর্তি। এ ছাড়া কিছু নারী মূর্তিরও দেখা মেলে। জমিদার আমলের টিনের চৌচালা ঘরে অস্থায়ীভাবে সরকারি তহশিল অফিস স্থানান্তর হলেও, সেটি এখন স্থায়িত্ব পেয়েছে।
লতাপতায় আচ্ছন্ন ভবনের একাংশ বর্তমানে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং আরেকাংশে একটি বেসরকারি দাতব্য সেবা সংস্থা কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভবনটির পিলারের মাথায় এবং দেয়ালেও অসাধারণ নকশা মুগ্ধ করে।
দোতল আরেকটি মহল, যার সামনে বিশাল শান বাঁধানো সিঁড়ি। অন্য সব ভবনের সঙ্গে এটির নকশার যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ভবনটির বারান্দা ও পুরোনো কাঠের দরজা সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে কয়েক গুণ। ভবনটির মাথায় ময়ূরের সঙ্গে দুই পাশে দুই নারী মূর্তির দেখা মেলে। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে গাছগাছালির সবুজে ঘেরা পুরো জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বিমোহিত করতে বাধ্য। যদিও ভবনের ভিন্ন অংশ খসে পড়ছে, হারাচ্ছে রূপ-লাবণ্য।
জমিদারবাড়ির পেছনে রয়েছে দীঘি ও দুটি পরিত্যক্ত কূপ। এ ছাড়া জমিদারবাড়ির বিশাল মাঠের এক কোণে নাটমন্দির। জানা যায়, নাগরপুরের সঙ্গে কলকাতার একটি বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে আসেন ধনাঢ্য ব্যক্তি রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল। তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ব্রিটিশদের কাছ থেকে বিপুল অর্থের বিনিময়ে জমি কিনে জমিদারি শুরু করেন।
রামকৃষ্ণ সাহার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধাগোবিন্দ। রাধা নিঃসন্তান। তবে বৃন্দাবনের তিন ছেলে– ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন ও যোগেন্দ্র মোহন দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন। এভাবে পাকুটিয়া জমিদারবাড়ি তিন ভাইয়ের তরফে বিভক্ত থাকলেও, জমিদাররা সবাই ছিলেন প্রজানন্দিত। বৃন্দাবনের মেজ ছেলে উপেন্দ্রকে কাকা রাধাগোবিন্দ দত্তক নেন। ফলে উপেন্দ্র কাকার জমিদারির পুরো সম্পত্তি লাভ করেন।
দৃষ্টিনন্দন পাকুটিয়া জমিদারবাড়িতে প্রতিনিয়ত পর্যটকের ভিড় বাড়ছে। ইতিহাসের সাক্ষী বাড়িটি সংস্কার না হওয়ায় একদিকে যেমন সৌন্দর্য হারাচ্ছে, অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছে অজানা থেকে যাচ্ছে ইতিহাস। জমিদারবাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জোরালো হচ্ছে।