ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। সেই সঙ্গে এ যুদ্ধের বিরোধিতাও অব্যাহতভাবে বাড়ছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সব শাখার হাজারো সংরক্ষিত সেনা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের কাছে যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। যুদ্ধের পরিবর্তে হামাসের কাছে জিম্মি বাকি ৫৯ জনকে মুক্ত করার জন্য একটি চুক্তি করার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

১৮ মাস আগেও খুব কম ইসরায়েলির মধ্যেই ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে পরাজিত করে জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য তুলে ধরা এ যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে সন্দেহ ছিল।

ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গত জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতি এবং ৩০ জনের বেশি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি অনেকের মধ্যে আশা জাগিয়েছিল যে খুব শিগগিরই এ যুদ্ধের অবসান ঘটতে পারে।

কিন্তু গত মার্চের মাঝামাঝি ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় আবার ভয়াবহ হামলা শুরু করার পর সে আশা ভেঙে গেছে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান ড্যানি ইয়াতম বলেন, ‘আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে ইসরায়েল খুব খারাপ অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি, নেতানিয়াহু মূলত নিজের স্বার্থ নিয়েই বেশি ভাবছেন। তাঁর অগ্রাধিকারের তালিকায় জিম্মিরা নন; বরং নিজের ও তাঁর সরকারকে স্থিতিশীল রাখার স্বার্থ।’

এপ্রিলের প্রথম দিকে প্রকাশিত ইসরায়েলি সরকারের কাছে পাঠানো প্রথম খোলাচিঠিতে বিমানবাহিনীর এক হাজার সংরক্ষিত সেনা ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্য স্বাক্ষর করেছিলেন।

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে ইয়াতমের মতো যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন, তাঁদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করে আসছেন। কেউ কেউ আবার ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন।

ড্যানি ইয়াতম বলেন, ‘আমি চিঠিতে সই করেছি এবং আমি এই প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছি রাজনৈতিক কারণে নয়; জাতীয় স্বার্থের কারণে। আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে আমার দেশ পথ হারাতে যাচ্ছে।’

এপ্রিলের প্রথম দিকে প্রকাশিত ইসরায়েলি সরকারের কাছে পাঠানো প্রথম খোলাচিঠিতে বিমানবাহিনীর এক হাজার সংরক্ষিত সেনা ও অবসরপ্রাপ্ত সদস্য স্বাক্ষর করেছিলেন।

চিঠিতে এই সেনারা লিখেছেন, ‘যুদ্ধ জারি রাখার বিষয়টি সরকারঘোষিত লক্ষ্যগুলোর কোনোটি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখছে না; বরং এটি জিম্মিদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’

চিঠিতে স্বাক্ষরকারীরা তাঁদের অনুসরণ করতে অন্যান্য ইসরায়েলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কারণ, গাজায় এখনো বেঁচে থাকা ২৪ জন জিম্মির জীবনরক্ষার সময় ফুরিয়ে আসছে। তাঁরা বলেন, ‘প্রতিটি নতুন দিন তাঁদের জীবনকে নতুন করে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থায় দ্বিধাগ্রস্ত প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য অপমানজনক।’

আমি চিঠিতে সই করেছি এবং আমি এই প্রতিবাদে অংশ নিচ্ছি রাজনৈতিক কারণে নয়; জাতীয় স্বার্থের কারণে। আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন যে আমার দেশ পথ হারাতে যাচ্ছে। —ড্যানি ইয়াতম, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান

পরবর্তী সপ্তাহগুলোতে প্রায় প্রতিটি শাখার সেনারা—এমনকি বিশেষ বাহিনী ও গোয়েন্দা শাখাও খোলাচিঠি দিয়েছে। সব মিলিয়ে চিঠিতে স্বাক্ষরকারীর সংখ্যা ১২ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর হাজারো ইসরায়েলি সংরক্ষিত সেনা নেতানিয়াহু সরকারের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন এর চেয়ে বেশি সেনা এ ডাক প্রত্যাখ্যান করছেন।

বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলের সংরক্ষিত সেনার সংখ্যা ৫০-৬০ শতাংশে নেমে গেছে। আর এটি দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য এক বড় সংকট হতে চলেছে। কারণ, কোনো যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে সংরক্ষিত সেনাদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হয়। ১৯৮২ সালে ইসরায়েলের প্রথম লেবানন যুদ্ধের পর আর কখনো এমন সংকট দেখা যায়নি।

আরও পড়ুনএবার দামেস্কে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে হামলা চালাল ইসরায়েল৬ ঘণ্টা আগে

ইয়োভ (ছদ্মনাম) নামে পদাতিক দলের একজন সংরক্ষিত সেনা গত গ্রীষ্মে গাজা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি আর সেখানে যাবেন না বলে জানিয়েছেন।

ইয়োভ বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, আমি আমার ভাই–বোনদের সাহায্য করতে যাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করতাম, কিছু ভালো কাজ করছি—কঠিন হলেও ভালো। অথচ এখন আমি বিষয়টিকে সেভাবে দেখি না।’

ইয়োভ বলেন, গাজায় সুড়ঙ্গের ভেতরে জিম্মিদের মৃত্যুঝুঁকির মুখে রেখে হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খুব শক্তিশালী ও হামাসকে পরাজিত করতে পারি। কিন্তু বিষয়টি হামাসকে পরাজিত করা নিয়ে নয়, বিষয়টি হলো—আমরা আমাদের দেশকে হারাচ্ছি।’

সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের কাছে পাঠানো চিঠিতে ড্যানি ইয়াতমের মতো যাঁরা স্বাক্ষর করেছেন, তাঁদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করে আসছেন। কেউ কেউ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর সরকারবিরোধী আন্দোলনে অংশও নিয়েছেন।

ইয়োভ বলেন, গাজায় যুদ্ধ করার সময় তিনি চেষ্টা করেছিলেন নৈতিকতাসম্পন্ন একজন সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে।

কিন্তু ইসরায়েলের সমালোচকেরা বলছেন, যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ইসরায়েলের জন্য এ দাবি করা তত কঠিন হয়ে পড়ছে যে তাদের সেনাবাহিনী বিশ্বের সবচেয়ে নৈতিক সেনাবাহিনী।

সম্প্রতি উদার বামপন্থী সংবাদপত্র হারেৎজে প্রকাশিত এক কলামে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল আমিরাম লেভিন বলেন, এখন উচ্চপদস্থ কমান্ডারসহ সেনাদের আদেশ অমান্য করার কথা ভাবার সময় এসেছে।

আমিরাম লেভিন লিখেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি এবং ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী ও আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের ওপর যে আঘাত আসছে, তাতে চুপ করে বসে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

আরও পড়ুনইসরায়েলে দাবানল, মানুষজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে০১ মে ২০২৫

তবে ইসরায়েল এ সীমা এরই মধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছে বলে দাবি করেছেন কিছু সমালোচক, যাঁরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দেশটির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

এদিকে নেতানিয়াহু এসব সমালোচককে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেছেন। তাঁদের উদ্বেগকে উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন, এগুলো ‘অপপ্রচারমূলক মিথ্যা’। তিনি আরও বলেন, বিশৃঙ্খল ও বিচ্ছিন্ন কিছু পেনশনভোগী গোষ্ঠী এসব কথা ছড়াচ্ছে। এদের (সংরক্ষিত সেনা) অধিকাংশই বহু বছর ধরে সেনাবাহিনীতে নেই।

তবে জনমত জরিপগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, ওই চিঠিগুলো ক্রমবর্ধমান জনমতেরই প্রতিফলন। ইসরায়েলের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেন যে অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্ত করাই এখন সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

তেল আবিবে এক বছরের বেশি সময় ধরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। সেখানে বিক্ষোভকারীরা জিম্মিদের ছবির পাশাপাশি যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনি শিশুদের ছবি প্রদর্শন করে প্রতিবাদ করছেন।

খোলাচিঠিগুলো ঘিরে সৃষ্ট বিতর্কের মধ্যে এমন আবেগঘন প্রতিবাদ ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে অস্বস্তিতে ফেলেছে।

আরও পড়ুন৫ বছরের যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে জিম্মিদের মুক্তি দিতে রাজি হামাস২৬ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সরক র র ক ছ ইসর য় ল র র জন য কর ছ ন ব ষয়ট প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

সৌদি আরবের কাছে ৩৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিল যুক্তরাষ্ট্র

সৌদি আরবের কাছে ৩৫০ কোটি ডলারের ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফরের আগে শুক্রবার এ অনুমোদন দেওয়া হলো।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি তারা কংগ্রেসকে জানিয়েছে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে থাকবে মধ্যপাল্লার ১ হাজার ‘এআইএম–১২০’ ক্ষেপণাস্ত্র। আকাশে থাকা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করার জন্য কোনো আকাশযান থেকে (এয়ার টু এয়ার) এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া যায়।

আগামী ১৩ থেকে ১৬ মে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর আগে সম্প্রতি প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে ইতালির রাজধানী রোমে সংক্ষিপ্ত সফর করেছিলেন তিনি। এটিই ছিল দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম বিদেশ সফর।

তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবের সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্যচুক্তি করার কথা আগে থেকেই বলে আসছিলেন ট্রাম্প। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে মস্কো ও কিয়েভের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করছে রিয়াদ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ