অভ্যন্তরীণ সুবিধা পেতে পাক-ভারত ‘যুদ্ধ’
Published: 8th, May 2025 GMT
ভারত ও পাকিস্তানের চলমান সংঘাতের ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে আগাম কিছু বলা কঠিন। কারণ পুরো ঘটনা একটু একটু করে খোলাসা হচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি বদলাতে থাকে বলে পুরো চিত্র সহজে বোঝা যায় না। তবে এ ধরনের ঘটনা শুধু দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, এখানে বাইরের কিছু বিষয়ও যুক্ত থাকে। এ ক্ষেত্রে কাছের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই আমাদের প্রধান আগ্রহ।
বিশ্ব এখন খুব ছোট হয়ে এসেছে। যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও বাংলাদেশে পড়েছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ তীব্র হলে তার প্রভাবও পড়তে বাধ্য। তাদের সংঘাতের কারণে ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশের ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। তারা কয়েক দিন দেশ দুটির আকাশসীমা এড়িয়ে চলবে। এসব কিছু স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, এই সংঘাত তীব্রতর হবে কিনা। যদিও এখন পর্যন্ত ভারত পেহেলগামে (কাশ্মীর) হামলার নেপথ্যে পাকিস্তানের ভূমিকা প্রমাণে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দেখাতে পারেনি। পাকিস্তান প্রস্তাব করেছিল, ঘটনার যৌথ ও আন্তর্জাতিক তদন্ত হোক। এতে সত্যিকার অপরাধীরা বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু ভারত সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এর নেপথ্যে পাকিস্তান জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু তা এখনও স্পষ্ট নয়।
আমার মনে হয়, ভারত যে আক্রমণ করেছে– এটি তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। অভ্যন্তরীণভাবে সুবিধা পেতে ভারত সরকার পাকিস্তানে এই হামলা চালাতে পারে। বিশেষত হিন্দুত্ববাদীদের কাছে পাকিস্তান একটি শত্রু রাষ্ট্র বলে বিবেচিত।
এখন প্রশ্ন হলো, ঘটনা কোন দিকে যেতে পারে? এ ক্ষেত্রে দুই দেশের কর্তাদের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো বিবেচনায় নেওয়া জরুরি। যেমন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিফ মুনির। তিনি একজন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের লোক। দেশটির অতীতের অনেক সেনাপ্রধানের মনস্তত্ত্বের চেয়ে তাঁর মনস্তত্ত্ব ভিন্ন। এমনকি পেহেলগামের ঘটনার আগেও তাঁর এক বিবৃতি আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। ভারতের মিডিয়াগুলো খুব ব্যাপকভাবে সেই বিবৃতি প্রচার করেছে। সেখানে তিনি কোনো কিছু অস্পষ্ট রাখেননি। সব কিছু খোলাসা করেছেন।
তার পরও সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কেমন হবে, সেটি স্পষ্ট করে বলা বেশ মুশকিল। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে আগেও যুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়, এবারের সংঘাতকে আগের যুদ্ধগুলোর সঙ্গে মেলানো যায় না। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। কারণ এই মুহূর্তে অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যু চলমান পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যেমন ভারত প্রকাশ্যভাবে ফিলিস্তিন বিষয়ে ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বন করেছে। খবরের কাগজে আমরা দেখেছি, ভারতীয় সেনাসদস্য ইসরায়েলের হয়ে যুদ্ধ করেছে। শুধু তাই নয়। ভারত প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। আলজাজিরার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এগুলো প্রকাশ পেয়েছে। দেশটি ইসরায়েলে বোমা ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের বিরাজমান শত্রুতা আরও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।
আপাতদৃষ্টে দূরবর্তী ঘটনা মনে হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এগুলোর একটি ভূমিকা রয়েছে। এভাবে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ বেড়েছে। নেতানিয়াহুর সঙ্গে মোদির বৈঠক ইত্যাদি ঘটনা চলমান পরিস্থিতিতে ইন্ধন দিয়েছে। বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের আক্রমণের বার্তা পেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তাদেরও এ পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বা ইতিবাচকভাবে নেওয়ার কোনো কারণ নেই।
তবে পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ হবে বলে মনে হচ্ছে না। পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে একটু প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হয়, যদিও পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারে। ভারত কয়েকটি জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত করতে পেরেছে, যেটি পাকিস্তানের পক্ষে করা সম্ভব বলে মনে হয় না। ভারত সন্ত্রাসী আস্তানার কথা বলে সহজেই হামলার নিশানা বানাতে পারে। এ ক্ষেত্রে দেশটির আন্তর্জাতিক সম্মতিও পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। পাকিস্তানের এ ধরনের সুযোগ নেই। ভারতের আইএসপিআর থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তারা কোনো সামরিক এলাকায় হামলা করেনি। আমার বিশ্বাস, বিবৃতিটির উদ্দেশ্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। পাকিস্তানের এভাবে সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত করে কোনো বিবৃতি দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ সামরিক ঘাঁটি ছাড়া পাকিস্তান কোথায় সুনির্দিষ্টভাবে হামলা চালাবে– এই সুযোগ দেশটির নেই। পাকিস্তান বলতে পারবে না– ভারতের ওই অঞ্চলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রয়েছে, সুতরাং সেখানে আমরা হামলা চালিয়েছি।
পাকিস্তানের হামলা করার সুযোগ রয়েছে মাত্র দুটি। যে জায়গা থেকে ভারত হামলা চালিয়েছে, সেখানে পাল্টা জবাব দেওয়া, যা পাকিস্তান চিহ্নিত করতে পারবে কিনা, তাতেও সন্দেহ রয়েছে। ইতোমধ্যে ভারত দাবি করেছে, তারা নৌ, বিমান ও স্থল তিনটি পথে হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে মন্দির কিংবা কোনো জনবসতি অঞ্চলে হামলা চালালে সেটি খারাপ নজির তৈরি করবে। আন্তর্জাতিকভাবে পাকিস্তান অসুবিধায় পড়বে। দ্বিতীয়ত, সামরিক ঘাঁটিতে হামলা ছাড়া পাকিস্তানের অন্য কোনো বিকল্প নেই। সুতরাং ভারত খুব পরিকল্পিতভাবে বিবৃতিটি দিয়েছে, যেখানে তারা দাবি করেছে, তারা সামরিক ঘাঁটিতে হামলা করেনি।
প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান ভারতের সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে পরিস্থিতি আরও তীব্র করে তুলবে কিনা? যদি তারা সেটি করে তবে ঘটনার দায়ও তাদের নিতে হবে। এদিক থেকেও পাকিস্তানের অবস্থান অনুকূলে নয়। তবে দুই দেশের জনগণের মধ্যে যেহেতু বৈরিতা রয়েছে, সুতরাং সেনাপ্রধান মুনিরও হামলার প্রতিশোধ নিতে চাইবেন। এগুলো তাদের পুরোনো ও চলমান উত্তেজনার ভিত্তিতে কিছু মূল্যায়ন, যা বিবেচনায় রাখা জরুরি।
ভারতের ব্যাপারে জাতি গঠনের বিষয়টি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ভারত নিয়ে আমরা গর্ব করতাম যে, তারা পুরো জনগোষ্ঠীকে একই পরিচয়ে তৈরি করতে পেরেছে– কাশ্মীর, মিজোরাম, আসামের মতো কয়েকটি অঞ্চল ছাড়া। তবে তাদের মধ্যে ভারতীয় পরিচয় প্রধান হয়ে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু মোদির শাসনামলে এই যৌথ অবস্থান কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এটা এখনও সম্ভব হয়নি। আমরা এখনও বাঙালি, বাঙালি মুসলমান ইত্যাদি পরিচয় নিয়ে বিতর্কে রয়ে গেছি। ভারতের এ সমস্যা আমাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে পাকিস্তান-ভারত সংঘাতের সঙ্গে যুক্ত মনে নাও হতে পারে। তবে এই অভ্যন্তরীণ সংকটের পেছনে নিশ্চয় একটি জাতিগত ও রাজনৈতিক ভূমিকা রয়েছে।
আন্তর্জাতিক নেতারাও এই মুহূর্তে বিভিন্ন চাপের মধ্যে রয়েছেন। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টসহ অনেকে ভারত-পাকিস্তান পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এখনও আশা করা যায়, পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে আসতে পারে।
ওবায়দুল হক: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন পর স থ ত ইসর য় ল চলম ন
এছাড়াও পড়ুন:
যশোরে অতিবর্ষণে ভেসে গেছে ১৩৪ কোটি টাকার মাছ
পোনা উৎপাদন ও মাছ চাষে দেশের প্রথম স্থানে রয়েছে যশোরের অবস্থান। জেলাটিতে অতিবর্ষণে এবার মৎস্য খাতে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। টানা ভারি বর্ষণে মাছের ঘের, পুকুর ও বিল তলিয়ে এ ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা মৎস্য অফিস।
মাছ চাষিদের ভাষ্য, গত ৪ দশকের মধ্যে এবার ক্ষতির রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে মৎস্য খাতে চাহিদার তুলনায় যশোরে উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বিপুল পরিমাণ এই অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সরকারের সহযোগিতা দাবি করেছেন তারা।
জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার আট উপজেলায় ৬ হাজার ২১৯টি মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৩ হাজার ১২৭টি, অভয়নগরে ৩৪০টি, ঝিকরগাছায় ৩৬০টি, মণিরামপুরে ৫৪০টি, কেশবপুরে ২৬০টি, শার্শায় ১ হাজার ৩২টি, চৌগাছা ও বাঘারপাড়ায় ২৮০টি খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আরো পড়ুন:
স্থগিত হওয়া জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ শুরু ১৮ আগস্ট
মাছ ছিনতাইয়ের মামলায় সাবেক এমপির ছেলে কারাগারে
ক্ষতিগ্রস্ত চাষি রয়েছেন ৫ হাজার ৪০৮ জন। এর মধ্যে সদরে ২ হাজার ৮৯৩ জন, অভয়নগরে ৩১৫ জন, ঝিকরগাছায় ৩৬০ জন, মণিরামপুরে ৫১০ জন, কেশবপুরে ১৯০ জন, শার্শায় ৭৬০ জন, চৌগাছায় ১৬০ জন ও বাঘারপাড়ায় ২২০ জন। ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ৪ হাজার ৭৮১ হেক্টর।
ভারি বর্ষণে পুকুর, ঘের ও বিল তলিয়ে ৫ হাজার ৩৪১ টন মাছ ও ৮৩০ লাখ পোনা ভেসে গেছে। ফলে মাছে ১০৪ কোটি ৮ লাখ ও পোনায় ১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১০ কোটি ৪০ লাখ টাকার।
বিগত ৪৭ বছরে জেলায় মৎস্য খাতে এমন ক্ষতি কখনো হয়নি বলে জানিয়েছেন ফিরোজ মৎস্য হ্যাচারির সত্ত্বাধিকারী ফিরোজ খান। তিনি বলেন, “১৯৭১ সালে পর এই প্রথম এমন ভারি বর্ষণের মুখোমুখি হতে হয়েছে কৃষকদের। ফলে ক্ষতির পরিমাণ আমাদের ধারণার বাইরে চলে গেছে। যদি কয়েক বছর এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে চাষিরা আর মাছ চাষ করবে না।”
তিনি আরো বলেন, “কৃষিতে সরকার প্রচুর পরিমাণ প্রণোদনা দিলেও মৎস্যখাতে সরকারের কোনো নজর নেই। অথচ আমরাই সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।”
যশোর জেলা মৎস্য চাষি সমিতির সভাপতি জাহিদুর গোলদার বলেন, “একদিকে খাবারের দাম বেশি, অন্যদিকে অতিবৃষ্টি ও অতিরিক্ত খরা। সবমিলিয়ে বিগত ৮ থেকে ১০ বছর চাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”
তিনি বলেন, “মাছের খাবারের দাম বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে। আবার কৃষি থেকে আমাদের শিল্পখাতে উন্নিত করে বিদ্যুৎ বিলের ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একসময় কৃষি হিসেবে এই খাতে বিদ্যুৎ ছিলো ২ টাকা ৪৫ পয়সা রেট। এখন আমাদের বিল দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ টাকা রেটে। এ বছর কৃষকরা যে পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা পুষিয়ে উঠতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
জেলা মৎস্য অফিসার সরকার মুহাম্মদ রফিকুল আলম জানিয়েছেন, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর রেকর্ড পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। ফলে কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে আমরা আবেদন করেছি। তবে এখনো আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। তবে বিদ্যুতের রেট কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যশোর জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যশোর জেলায় মোট ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন হয়েছিল। এর বিপরীতে জেলার নিজস্ব চাহিদা ছিল প্রায় ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। ফলে নিজেদের চাহিদা মিটিয়েও জেলায় ১ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি মাছ উদ্বৃত্ত ছিল, যা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়েছিল।
ঢাকা/প্রিয়ব্রত/মেহেদী