আমরা কি অজান্তেই নব্য সাম্রাজ্যবাদী যুগে গিয়ে পড়ছি
Published: 1st, June 2025 GMT
আপনি কোনো ভবনের দিকে তাকালে তার দেয়াল, জানালা আর সাজসজ্জা দেখতে পান। কিন্তু যে গোপন কাঠামো সবকিছু ধরে রেখেছে, তা দেখা যায় না। তবে ভূমিকম্পের সময় বা দীর্ঘদিনের চাপের পর হঠাৎ করেই সেই অদৃশ্য কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে।
ঠিক এ রকমই অবস্থা অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, সেগুলো বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও ভেতরে খুবই ভঙ্গুর।
১৬৫১ সালে ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের সহিংসতায় প্রভাবিত হয়ে দার্শনিক টমাস হবস বলেছিলেন, সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হলে এক ‘লিভায়াথান’ দরকার। অর্থাৎ এমন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র দরকার, যা বিশৃঙ্খলা দমন করে সুশাসন কায়েম করতে পারবে। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, যদি শক্তিশালী সরকার না থাকে, তবে মানুষের জীবন হবে ‘একাকী, দরিদ্র, কদর্য, হিংস্র ও সংক্ষিপ্ত’।
কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, শুধু লিভায়াথানের প্রয়োজন আছে বললেই তা গড়ে ওঠে না। বিশেষ করে বিশ শতকে যখন উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করছিল, তখন এটি স্পষ্ট ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় ১৩০টি নতুন দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। এর মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ায় প্রায় ৮০টি, আর ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০টির মতো। বাকিগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়ার মতো সাম্রাজ্য ও বহুজাতিক রাষ্ট্র ভেঙে যাওয়ার পর গঠিত হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে উপনিবেশমুক্তির যে ঢেউ উঠেছিল, তার পেছনে শুধু মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেনি, যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনগুলোকে সমর্থন দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, এই স্বাধীনতা আন্দোলনগুলো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে দুর্বল করবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণও ঠেকাবে।
১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তাঁর ‘পয়েন্ট ফোর প্রোগ্রাম’-এ যুদ্ধোত্তর সময়ের জন্য একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। এর লক্ষ্য ছিল জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষা, মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে ইউরোপকে গড়ে তোলা, উপনিবেশমুক্তির পক্ষে কাজ করা এবং দরিদ্র দেশগুলোর, বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলোর প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ঔপনিবেশিক ‘লিভায়াথান’-এর (শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা) পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ‘লিভায়াথান’ তৈরি করা, যা কিনা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামোর মাধ্যমে সমর্থিত হবে।
ইউরোপের পুনর্গঠন ছিল অত্যন্ত সফল। কিন্তু গ্লোবাল সাউথ, মানে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নতুন শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, ট্রুম্যান যতটা সহজ ভেবেছিলেন, বাস্তবে ততটা সহজ ছিল না। ছিল অনেক বেশি কঠিন ও ব্যয়বহুল।
স্বাধীনতার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস খুব দ্রুতই বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়। ৬০টির বেশি নতুন দেশ গৃহযুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সামরিক অভ্যুত্থান এবং জাতিগত সহিংসতার মুখে পড়ে। সিরিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়ার মতো দেশে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে নিয়মিত চ্যালেঞ্জ করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এমনকি যেখানে শান্তি টিকে আছে, সেখানেও তা অনেক সময়ই টিকে আছে জটিল আন্তর্জাতিক সাহায্য, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বাইরের মধ্যস্থতার ওপর ভর করে।
আজকের দিনে সাব-সাহারান অঞ্চলের তিন-পঞ্চমাংশের বেশি দেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সক্রিয় কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে চলছে। এই চুক্তিগুলো আর্থিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা কিনা উন্নয়ন ব্যাংক, দাতা সরকার এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অতিরিক্ত সাহায্য পাওয়ার পথ খুলে দেয়।
এই সহায়তার প্রবাহ দরিদ্র দেশের প্রায় ৭০ কোটি মানুষকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে। এর পরিমাণ ওই দেশের মোট আমদানির প্রায় অর্ধেকের সমান।
ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার ও মালাওয়ির মতো দেশে আন্তর্জাতিক সাহায্য সরকারের মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশের বেশি অর্থ জোগান দেয়। এই বৈশ্বিক সহায়তা ব্যবস্থাটি দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করলেও তাদের নাগরিকদের চাহিদা ও দাতা সংস্থা এবং ঋণদাতাদের দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে বাধ্য করেছে।
গত কয়েক মাসে ট্রাম্পের প্রশাসন খুবই নির্দয়ভাবে সেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছে, যেগুলো বহুদিন ধরে এই ভঙ্গুর বৈশ্বিক সহায়তা ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছে, মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের অর্থায়ন কেটে দিয়েছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে বেরিয়ে গেছে। একই সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন উপনিবেশবাদী ধাঁচের কিছু আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছে। তারা গ্রিনল্যান্ড, পানামা এবং এমনকি কানাডার ওপর মার্কিন সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার হুমকিও দিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য সাহায্যদাতা দেশও তাদের বিদেশি সহায়তার বাজেট কমিয়ে দিয়েছে।
এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার মিলিশিয়া আর যুদ্ধবাজদের দ্বারা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আবার কিছু অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সরকার ট্রাম্পের এই নির্লজ্জ আচরণে উৎসাহিত হয়ে বাইরের দিকে নজর দিতে পারে এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ প্রতিবেশী দেশগুলোকে দখল করার চেষ্টা করতে পারে। সবাই নতুন নতুন বিদেশি পৃষ্ঠপোষক খুঁজবে। আর যারা নগদ টাকা দিতে পারবে না, তারা তাদের খনিজ সম্পদের ওপর বিশেষ সুবিধা দিতে বাধ্য হবে। ফলে এক নতুন ধরনের ‘সম্পদ উপনিবেশবাদের’ যুগ শুরু হতে পারে।
এর অনেকটাই ইতিমধ্যে ঘটছে। রাশিয়ার বিখ্যাত বেসরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপ এখন বুরকিনা ফাসো, মালি, সুদান, লিবিয়া এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে কাজ করছে। তাদের বিনিময় হচ্ছে সোনা, হীরা আর মূল্যবান খনিজ সম্পদের অ্যাকসেস। একই সঙ্গে তুরস্ক, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও সৌদি আরব—সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে।
চীন এ পরিস্থিতিতে তুলনামূলকভাবে আরও গঠনতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়েছে। তারা এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশ। তবে এর পেছনে তাদের কৌশলগত স্বার্থও রয়েছে। আফ্রিকায় তাদের বিনিয়োগ রক্ষা করা এবং নিজেদের প্রতিরক্ষাশিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা তাদের মূল লক্ষ্য। চীন ইতিমধ্যে জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্দর ব্যবহারের চুক্তি করেছে।
বিশ্বজুড়ে সীমান্তগুলো দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে, দাতাদেশগুলোর সহায়তা কমে যাচ্ছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হচ্ছে। এই জায়গাগুলোয় বড় শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার আর স্থানীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা করছে।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের ঘটনা অনেকটাই মিলে যায়। ১৮৮৪-৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না করে তারা আফ্রিকাকে ভাগ করে নেবে প্রভাবক্ষেত্র হিসেবে। এটি ছিল এক নির্মম সমঝোতা। কিন্তু যারা এই পরিকল্পনার রূপকার, তাদের কাছে এটি ছিল বিশৃঙ্খলার চেয়ে ভালো বিকল্প।
এ ঘটনাগুলো আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন তোলে: আমরা কি আবার ধীরে ধীরে একুশ শতকের নতুন ‘আফ্রিকার লুটপাট’-এর দিকে এগোচ্ছি? যদি তা-ই হয়, তবে সেটা হবে এক ভয়াবহ ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি।
প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান শান্তিপূর্ণ নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা বাস্তবায়ন করা যত কঠিনই হোক না কেন, এখনো সেটিই মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় আশার জায়গা। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য গড়া এই আন্তর্জাতিক কাঠামোগুলো ভেঙে ফেলা হয়তো স্বল্প মেয়াদে কিছু টাকা বাঁচাবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তার পরিণতি হবে ভয়ংকর।
রিকার্ডো হাউসমান ভেনেজুয়েলার সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ষ ট রগ ল স ব ধ নত ব যবস থ ক জ কর দ র বল য ক তর র ওপর উপন ব ইউর প সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
আমরা কি অজান্তেই নব্য সাম্রাজ্যবাদী যুগে গিয়ে পড়ছি
আপনি কোনো ভবনের দিকে তাকালে তার দেয়াল, জানালা আর সাজসজ্জা দেখতে পান। কিন্তু যে গোপন কাঠামো সবকিছু ধরে রেখেছে, তা দেখা যায় না। তবে ভূমিকম্পের সময় বা দীর্ঘদিনের চাপের পর হঠাৎ করেই সেই অদৃশ্য কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে।
ঠিক এ রকমই অবস্থা অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, সেগুলো বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও ভেতরে খুবই ভঙ্গুর।
১৬৫১ সালে ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের সহিংসতায় প্রভাবিত হয়ে দার্শনিক টমাস হবস বলেছিলেন, সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হলে এক ‘লিভায়াথান’ দরকার। অর্থাৎ এমন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র দরকার, যা বিশৃঙ্খলা দমন করে সুশাসন কায়েম করতে পারবে। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, যদি শক্তিশালী সরকার না থাকে, তবে মানুষের জীবন হবে ‘একাকী, দরিদ্র, কদর্য, হিংস্র ও সংক্ষিপ্ত’।
কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, শুধু লিভায়াথানের প্রয়োজন আছে বললেই তা গড়ে ওঠে না। বিশেষ করে বিশ শতকে যখন উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করছিল, তখন এটি স্পষ্ট ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় ১৩০টি নতুন দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। এর মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ায় প্রায় ৮০টি, আর ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০টির মতো। বাকিগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়ার মতো সাম্রাজ্য ও বহুজাতিক রাষ্ট্র ভেঙে যাওয়ার পর গঠিত হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে উপনিবেশমুক্তির যে ঢেউ উঠেছিল, তার পেছনে শুধু মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেনি, যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনগুলোকে সমর্থন দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, এই স্বাধীনতা আন্দোলনগুলো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে দুর্বল করবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণও ঠেকাবে।
১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তাঁর ‘পয়েন্ট ফোর প্রোগ্রাম’-এ যুদ্ধোত্তর সময়ের জন্য একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। এর লক্ষ্য ছিল জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষা, মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে ইউরোপকে গড়ে তোলা, উপনিবেশমুক্তির পক্ষে কাজ করা এবং দরিদ্র দেশগুলোর, বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলোর প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ঔপনিবেশিক ‘লিভায়াথান’-এর (শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা) পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ‘লিভায়াথান’ তৈরি করা, যা কিনা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামোর মাধ্যমে সমর্থিত হবে।
ইউরোপের পুনর্গঠন ছিল অত্যন্ত সফল। কিন্তু গ্লোবাল সাউথ, মানে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নতুন শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, ট্রুম্যান যতটা সহজ ভেবেছিলেন, বাস্তবে ততটা সহজ ছিল না। ছিল অনেক বেশি কঠিন ও ব্যয়বহুল।
স্বাধীনতার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস খুব দ্রুতই বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়। ৬০টির বেশি নতুন দেশ গৃহযুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সামরিক অভ্যুত্থান এবং জাতিগত সহিংসতার মুখে পড়ে। সিরিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়ার মতো দেশে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে নিয়মিত চ্যালেঞ্জ করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এমনকি যেখানে শান্তি টিকে আছে, সেখানেও তা অনেক সময়ই টিকে আছে জটিল আন্তর্জাতিক সাহায্য, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বাইরের মধ্যস্থতার ওপর ভর করে।
আজকের দিনে সাব-সাহারান অঞ্চলের তিন-পঞ্চমাংশের বেশি দেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সক্রিয় কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে চলছে। এই চুক্তিগুলো আর্থিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা কিনা উন্নয়ন ব্যাংক, দাতা সরকার এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অতিরিক্ত সাহায্য পাওয়ার পথ খুলে দেয়।
এই সহায়তার প্রবাহ দরিদ্র দেশের প্রায় ৭০ কোটি মানুষকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে। এর পরিমাণ ওই দেশের মোট আমদানির প্রায় অর্ধেকের সমান।
ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার ও মালাওয়ির মতো দেশে আন্তর্জাতিক সাহায্য সরকারের মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশের বেশি অর্থ জোগান দেয়। এই বৈশ্বিক সহায়তা ব্যবস্থাটি দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করলেও তাদের নাগরিকদের চাহিদা ও দাতা সংস্থা এবং ঋণদাতাদের দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে বাধ্য করেছে।
গত কয়েক মাসে ট্রাম্পের প্রশাসন খুবই নির্দয়ভাবে সেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছে, যেগুলো বহুদিন ধরে এই ভঙ্গুর বৈশ্বিক সহায়তা ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছে, মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের অর্থায়ন কেটে দিয়েছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে বেরিয়ে গেছে। একই সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন উপনিবেশবাদী ধাঁচের কিছু আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছে। তারা গ্রিনল্যান্ড, পানামা এবং এমনকি কানাডার ওপর মার্কিন সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার হুমকিও দিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য সাহায্যদাতা দেশও তাদের বিদেশি সহায়তার বাজেট কমিয়ে দিয়েছে।
এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার মিলিশিয়া আর যুদ্ধবাজদের দ্বারা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আবার কিছু অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সরকার ট্রাম্পের এই নির্লজ্জ আচরণে উৎসাহিত হয়ে বাইরের দিকে নজর দিতে পারে এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ প্রতিবেশী দেশগুলোকে দখল করার চেষ্টা করতে পারে। সবাই নতুন নতুন বিদেশি পৃষ্ঠপোষক খুঁজবে। আর যারা নগদ টাকা দিতে পারবে না, তারা তাদের খনিজ সম্পদের ওপর বিশেষ সুবিধা দিতে বাধ্য হবে। ফলে এক নতুন ধরনের ‘সম্পদ উপনিবেশবাদের’ যুগ শুরু হতে পারে।
এর অনেকটাই ইতিমধ্যে ঘটছে। রাশিয়ার বিখ্যাত বেসরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপ এখন বুরকিনা ফাসো, মালি, সুদান, লিবিয়া এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে কাজ করছে। তাদের বিনিময় হচ্ছে সোনা, হীরা আর মূল্যবান খনিজ সম্পদের অ্যাকসেস। একই সঙ্গে তুরস্ক, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও সৌদি আরব—সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে।
চীন এ পরিস্থিতিতে তুলনামূলকভাবে আরও গঠনতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়েছে। তারা এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশ। তবে এর পেছনে তাদের কৌশলগত স্বার্থও রয়েছে। আফ্রিকায় তাদের বিনিয়োগ রক্ষা করা এবং নিজেদের প্রতিরক্ষাশিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা তাদের মূল লক্ষ্য। চীন ইতিমধ্যে জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্দর ব্যবহারের চুক্তি করেছে।
বিশ্বজুড়ে সীমান্তগুলো দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে, দাতাদেশগুলোর সহায়তা কমে যাচ্ছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হচ্ছে। এই জায়গাগুলোয় বড় শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার আর স্থানীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা করছে।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের ঘটনা অনেকটাই মিলে যায়। ১৮৮৪-৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না করে তারা আফ্রিকাকে ভাগ করে নেবে প্রভাবক্ষেত্র হিসেবে। এটি ছিল এক নির্মম সমঝোতা। কিন্তু যারা এই পরিকল্পনার রূপকার, তাদের কাছে এটি ছিল বিশৃঙ্খলার চেয়ে ভালো বিকল্প।
এ ঘটনাগুলো আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন তোলে: আমরা কি আবার ধীরে ধীরে একুশ শতকের নতুন ‘আফ্রিকার লুটপাট’-এর দিকে এগোচ্ছি? যদি তা-ই হয়, তবে সেটা হবে এক ভয়াবহ ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি।
প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান শান্তিপূর্ণ নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা বাস্তবায়ন করা যত কঠিনই হোক না কেন, এখনো সেটিই মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় আশার জায়গা। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য গড়া এই আন্তর্জাতিক কাঠামোগুলো ভেঙে ফেলা হয়তো স্বল্প মেয়াদে কিছু টাকা বাঁচাবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তার পরিণতি হবে ভয়ংকর।
রিকার্ডো হাউসমান ভেনেজুয়েলার সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ