আপনি কোনো ভবনের দিকে তাকালে তার দেয়াল, জানালা আর সাজসজ্জা দেখতে পান। কিন্তু যে গোপন কাঠামো সবকিছু ধরে রেখেছে, তা দেখা যায় না। তবে ভূমিকম্পের সময় বা দীর্ঘদিনের চাপের পর হঠাৎ করেই সেই অদৃশ্য কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে।

ঠিক এ রকমই অবস্থা অনেক উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, সেগুলো বাইরে থেকে শক্ত মনে হলেও ভেতরে খুবই ভঙ্গুর।

১৬৫১ সালে ইংল্যান্ডে গৃহযুদ্ধের সহিংসতায় প্রভাবিত হয়ে দার্শনিক টমাস হবস বলেছিলেন, সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হলে এক ‘লিভায়াথান’ দরকার। অর্থাৎ এমন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র দরকার, যা বিশৃঙ্খলা দমন করে সুশাসন কায়েম করতে পারবে। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, যদি শক্তিশালী সরকার না থাকে, তবে মানুষের জীবন হবে ‘একাকী, দরিদ্র, কদর্য, হিংস্র ও সংক্ষিপ্ত’।

কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করেছে, শুধু লিভায়াথানের প্রয়োজন আছে বললেই তা গড়ে ওঠে না। বিশেষ করে বিশ শতকে যখন উপনিবেশগুলো স্বাধীনতা অর্জন করছিল, তখন এটি স্পষ্ট ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় ১৩০টি নতুন দেশ স্বাধীনতা পেয়েছে। এর মধ্যে আফ্রিকা ও এশিয়ায় প্রায় ৮০টি, আর ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০টির মতো। বাকিগুলো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়ার মতো সাম্রাজ্য ও বহুজাতিক রাষ্ট্র ভেঙে যাওয়ার পর গঠিত হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে উপনিবেশমুক্তির যে ঢেউ উঠেছিল, তার পেছনে শুধু মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাই কাজ করেনি, যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনগুলোকে সমর্থন দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, এই স্বাধীনতা আন্দোলনগুলো ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে দুর্বল করবে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণও ঠেকাবে।

১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান তাঁর ‘পয়েন্ট ফোর প্রোগ্রাম’-এ যুদ্ধোত্তর সময়ের জন্য একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। এর লক্ষ্য ছিল জাতিসংঘকে ব্যবহার করে ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষা, মার্শাল পরিকল্পনার মাধ্যমে ইউরোপকে গড়ে তোলা, উপনিবেশমুক্তির পক্ষে কাজ করা এবং দরিদ্র দেশগুলোর, বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রগুলোর প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, ঔপনিবেশিক ‘লিভায়াথান’-এর (শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা) পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা ‘লিভায়াথান’ তৈরি করা, যা কিনা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কাঠামোর মাধ্যমে সমর্থিত হবে।

ইউরোপের পুনর্গঠন ছিল অত্যন্ত সফল। কিন্তু গ্লোবাল সাউথ, মানে বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোয় নতুন শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা, ট্রুম্যান যতটা সহজ ভেবেছিলেন, বাস্তবে ততটা সহজ ছিল না। ছিল অনেক বেশি কঠিন ও ব্যয়বহুল। 

স্বাধীনতার প্রাথমিক উচ্ছ্বাস খুব দ্রুতই বিশৃঙ্খলায় রূপ নেয়। ৬০টির বেশি নতুন দেশ গৃহযুদ্ধ, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সামরিক অভ্যুত্থান এবং জাতিগত সহিংসতার মুখে পড়ে। সিরিয়া, সুদান, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া ও কলম্বিয়ার মতো দেশে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে নিয়মিত চ্যালেঞ্জ করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এমনকি যেখানে শান্তি টিকে আছে, সেখানেও তা অনেক সময়ই টিকে আছে জটিল আন্তর্জাতিক সাহায্য, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং বাইরের মধ্যস্থতার ওপর ভর করে।

আজকের দিনে সাব-সাহারান অঞ্চলের তিন-পঞ্চমাংশের বেশি দেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সক্রিয় কর্মসূচির ওপর নির্ভর করে চলছে। এই চুক্তিগুলো আর্থিক স্থিতিশীলতার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা কিনা উন্নয়ন ব্যাংক, দাতা সরকার এবং দাতব্য সংস্থাগুলোর কাছ থেকে অতিরিক্ত সাহায্য পাওয়ার পথ খুলে দেয়।

এই সহায়তার প্রবাহ দরিদ্র দেশের প্রায় ৭০ কোটি মানুষকে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে। এর পরিমাণ ওই দেশের মোট আমদানির প্রায় অর্ধেকের সমান।

ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, মাদাগাস্কার ও মালাওয়ির মতো দেশে আন্তর্জাতিক সাহায্য সরকারের মোট ব্যয়ের ৫০ শতাংশের বেশি অর্থ জোগান দেয়। এই বৈশ্বিক সহায়তা ব্যবস্থাটি দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে টিকে থাকতে সহায়তা করলেও তাদের নাগরিকদের চাহিদা ও দাতা সংস্থা এবং ঋণদাতাদের দাবির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে বাধ্য করেছে।

গত কয়েক মাসে ট্রাম্পের প্রশাসন খুবই নির্দয়ভাবে সেসব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিয়েছে, যেগুলো বহুদিন ধরে এই ভঙ্গুর বৈশ্বিক সহায়তা ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছিল। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি বন্ধ করে দিয়েছে, মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের অর্থায়ন কেটে দিয়েছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে বেরিয়ে গেছে। একই সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসন উপনিবেশবাদী ধাঁচের কিছু আকাঙ্ক্ষাও প্রকাশ করেছে। তারা গ্রিনল্যান্ড, পানামা এবং এমনকি কানাডার ওপর মার্কিন সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার হুমকিও দিয়েছে।

এদিকে যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য সাহায্যদাতা দেশও তাদের বিদেশি সহায়তার বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। 

এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার মিলিশিয়া আর যুদ্ধবাজদের দ্বারা আরও বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আবার কিছু অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী সরকার ট্রাম্পের এই নির্লজ্জ আচরণে উৎসাহিত হয়ে বাইরের দিকে নজর দিতে পারে এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ প্রতিবেশী দেশগুলোকে দখল করার চেষ্টা করতে পারে। সবাই নতুন নতুন বিদেশি পৃষ্ঠপোষক খুঁজবে। আর যারা নগদ টাকা দিতে পারবে না, তারা তাদের খনিজ সম্পদের ওপর বিশেষ সুবিধা দিতে বাধ্য হবে। ফলে এক নতুন ধরনের ‘সম্পদ উপনিবেশবাদের’ যুগ শুরু হতে পারে। 

এর অনেকটাই ইতিমধ্যে ঘটছে। রাশিয়ার বিখ্যাত বেসরকারি সামরিক প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপ এখন বুরকিনা ফাসো, মালি, সুদান, লিবিয়া এবং সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে কাজ করছে। তাদের বিনিময় হচ্ছে সোনা, হীরা আর মূল্যবান খনিজ সম্পদের অ্যাকসেস। একই সঙ্গে তুরস্ক, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান ও সৌদি আরব—সুদানের চলমান গৃহযুদ্ধে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে।

চীন এ পরিস্থিতিতে তুলনামূলকভাবে আরও গঠনতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়েছে। তারা এখন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের সবচেয়ে বড় অবদানকারী দেশ। তবে এর পেছনে তাদের কৌশলগত স্বার্থও রয়েছে। আফ্রিকায় তাদের বিনিয়োগ রক্ষা করা এবং নিজেদের প্রতিরক্ষাশিল্পকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা তাদের মূল লক্ষ্য। চীন ইতিমধ্যে জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে। ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, সলোমন দ্বীপপুঞ্জসহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে বন্দর ব্যবহারের চুক্তি করেছে। 

বিশ্বজুড়ে সীমান্তগুলো দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে, দাতাদেশগুলোর সহায়তা কমে যাচ্ছে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো ধীরে ধীরে প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হচ্ছে। এই জায়গাগুলোয় বড় শক্তিগুলো প্রভাব বিস্তার আর স্থানীয় সম্পদের নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা করছে।

এই পরিস্থিতির সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের ঘটনা অনেকটাই মিলে যায়। ১৮৮৪-৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিগুলো সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না করে তারা আফ্রিকাকে ভাগ করে নেবে প্রভাবক্ষেত্র হিসেবে। এটি ছিল এক নির্মম সমঝোতা। কিন্তু যারা এই পরিকল্পনার রূপকার, তাদের কাছে এটি ছিল বিশৃঙ্খলার চেয়ে ভালো বিকল্প।

এ ঘটনাগুলো আমাদের সামনে একটি বড় প্রশ্ন তোলে: আমরা কি আবার ধীরে ধীরে একুশ শতকের নতুন ‘আফ্রিকার লুটপাট’-এর দিকে এগোচ্ছি? যদি তা-ই হয়, তবে সেটা হবে এক ভয়াবহ ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি।

প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান শান্তিপূর্ণ নিয়মভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেটা বাস্তবায়ন করা যত কঠিনই হোক না কেন, এখনো সেটিই মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় আশার জায়গা। দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর জন্য গড়া এই আন্তর্জাতিক কাঠামোগুলো ভেঙে ফেলা হয়তো স্বল্প মেয়াদে কিছু টাকা বাঁচাবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তার পরিণতি হবে ভয়ংকর। 

রিকার্ডো হাউসমান ভেনেজুয়েলার সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এবং ইন্টার-আমেরিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ষ ট রগ ল স ব ধ নত ব যবস থ ক জ কর দ র বল য ক তর র ওপর উপন ব ইউর প সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগ কড়া নাড়ছে দরজায়

জ্বালানিশক্তির হাত ধরেই মানবসভ্যতা এগিয়ে চলেছে। আগুনের ব্যবহার আয়ত্ত করা থেকে শুরু করে বাষ্পশক্তির ব্যবহার, পরমাণু বিভাজনের মতো মাইলফলক অর্জন—সবই জ্বালানিশক্তির অবদান।

আজ আমরা এক নতুন যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে উঁকি দিচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির এক অপার সম্ভাবনা।

গত বছর নতুন করে যে বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে, তার প্রায় সবটাই এসেছে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ দুই ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে যা জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে ৮০০ বিলিয়ন ডলার বেশি।

সৌর ও বায়ুশক্তি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সাশ্রয়ী বিদ্যুতের উৎস, নবায়নযোগ্য খাতে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান, ত্বরান্বিত হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য এখনো অনেক বেশি ভর্তুকি দেওয়া হয়।

যেসব দেশ জীবাশ্ম জ্বালানি আঁকড়ে ধরে আছে, তারা তাদের অর্থনীতিকে সুরক্ষা তো দিচ্ছেই না; বরং ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কারণ, তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা হারাচ্ছে এবং একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানো মানে জ্বালানি সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। জীবাশ্ম জ্বালানির বাজারমূল্য অনিশ্চিত, এর সরবরাহে বিঘ্ন ঘটা এবং কিংবা ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কবলেও পড়তে হতে পারে, যেমনটি আমরা দেখেছি রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে আগ্রাসনের সময়; কিন্তু সূর্যালোকের বেলায় মূল্যবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই, বাতাসের ওপরও কোনো নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায় না এবং প্রায় প্রতিটি দেশেই এত নবায়নযোগ্য সম্পদ আছে যে প্রত্যেকেই চাইলে জ্বালানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে।

সর্বোপরি নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। বিদ্যুৎ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত লাখোকোটি মানুষের কাছে দ্রুত, সাশ্রয়ী ও টেকসই বিদ্যুৎ পৌঁছে দেবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। বিশেষত অফ-গ্রিড ও ছোট ছোট সৌরবিদ্যুৎ প্যানেলগুলো এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারে।

সব মিলিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা এ মুহূর্তে অপ্রতিরোধ্য; কিন্তু এই রূপান্তর এখনো যথেষ্ট গতিশীল বা সবার জন্য সহজলভ্যও নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলো এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।

২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব ডেটা সেন্টারগুলোর সম্মিলিত বিদ্যুৎ খরচ পুরো জাপানের বর্তমান বিদ্যুৎ খরচের সমান হবে। কোম্পানিগুলোর উচিত এ ডেটা সেন্টারগুলোর পরিচালনায় নবায়নযোগ্য উৎস কাজে লাগানোর অঙ্গীকার করা।

জ্বালানি খাতে এখনো জীবাশ্ম জ্বালানির আধিপত্য বিরাজ করছে, এবং কার্বন নিঃসরণ এখনো তার ঊর্ধ্বগতি বজায় রেখেছে। অথচ জলবায়ু–সংকটের সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতি এড়াতে চাইলে এগুলো হ্রাস করা ছাড়া উপায় নেই। এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে আমাদের ছয়টি ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রথমত, রাষ্ট্রগুলোকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি–নির্ভর ভবিষ্যতের প্রতি পুরোপুরি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে, প্রতিটি দেশ নতুন জাতীয় জলবায়ু পরিকল্পনা জমা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যা জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান (এনডিসি) নামে পরিচিত।

এনডিসিতে পরবর্তী দশকের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হবে। এ পরিকল্পনাগুলো অবশ্যই বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যেখানে সব ধরনের কার্বন নিঃসরণ ও সব খাতকে পর্যালোচনায় রাখতে হবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুস্পষ্ট রূপরেখা হাজির করতে হবে।

জি–২০ দেশগুলো, যারা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের প্রায় ৮০ শতাংশের জন্য দায়ী, তাদেরই এর গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের জ্বালানিব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী করে। আধুনিক গ্রিড ও স্টোরেজ ছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানি তার পূর্ণ সম্ভাবনা বিকশিত করতে পারবে না; কিন্তু নবায়নযোগ্য উৎসে বিনিয়োগ করা প্রতি ডলারের মধ্যে মাত্র ৬০ সেন্ট ব্যয় হয় গ্রিড ও স্টোরেজ বাবদ। এ অনুপাতটিকে ১/১-এ উন্নীত করতে হবে।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে মেটানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকেও নিজ নিজ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে।

২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর সব ডেটা সেন্টারগুলোর সম্মিলিত বিদ্যুৎ খরচ পুরো জাপানের বর্তমান বিদ্যুৎ খরচের সমান হবে। কোম্পানিগুলোর উচিত এ ডেটা সেন্টারগুলোর পরিচালনায় নবায়নযোগ্য উৎস কাজে লাগানোর অঙ্গীকার করা।

চতুর্থত, আমাদের জ্বালানি রূপান্তরে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এর অর্থ হলো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি–নির্ভর আগামীর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করা; এবং সেই সঙ্গে জরুরি খনিজ সরবরাহ-শৃঙ্খল সংস্কার করা।

এ মুহূর্তে এগুলো অধিকার হরণ ও পরিবেশ ধ্বংসের কারণে জর্জরিত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো মূল্য-শৃঙ্খলের তলানিতে বন্দী হয়ে আছে। অবশ্যই এর অবসান ঘটাতে হবে।

পঞ্চমত, আমাদের বাণিজ্যকে জ্বালানি রূপান্তরের সহায়ক হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি সরবরাহের শৃঙ্খলটি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং এ মুহূর্তে বৈশ্বিক বাণিজ্য আর এককেন্দ্রিক থাকছে না। নতুন জ্বালানিব্যবস্থার যুগের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশগুলোর উচিত সরবরাহে বৈচিত্র্য আনতে কাজ করা, নবায়নযোগ্য উৎসের পণ্যে শুল্ক কমানো এবং বিনিয়োগ চুক্তি আধুনিকীকরণ করা যাতে তারা এই রূপান্তরকে এগিয়ে নিতে পারে।

ষষ্ঠত ও শেষত, আমাদের উচিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া। আফ্রিকা গত বছর নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের মাত্র ২ শতাংশ পেয়েছে, যদিও বিশ্বের সেরা সৌর শক্তির ৬০ শতাংশ উৎস এ মহাদেশে রয়েছে। আমাদের কিছু আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে—যাতে ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজেটে টান না পড়ে এবং বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকগুলো যাতে তাদের ঋণদান ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে এবং অনেক বেশি বেসরকারি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারে।

আমাদের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো ও বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি মূল্যায়ন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে, যাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতিশ্রুতি, জলবায়ু সংকটের ক্ষতিপূরণ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পদ বিকল হয়ে পড়ার ঝুঁকির আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করা সম্ভব হয়।

এক নতুন জ্বালানি সম্ভাবনার যুগ আমাদের হাতছানি দিচ্ছে—এমন এক যুগ যেখানে সাশ্রয়ী, নবায়নযোগ্য, প্রাচুর্যময় জ্বালানি এক অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় সমৃদ্ধিশালী পৃথিবীকে শক্তি জোগাবে, যেখানে রাষ্ট্রগুলোর জ্বালানি স্বয়ংসম্পূর্ণতার নিশ্চয়তা থাকবে এবং বিদ্যুৎসেবা থাকবে সব নাগরিকের হাতের মুঠোয়।

ঠিক এ মুহূর্ত আমরা চাইলেই বৈশ্বিকভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করতে পারি। আসুন, আমরা এই সুযোগকে কাজে লাগাই।

আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের মহাসচিব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নবায়নযোগ্য জ্বালানির যুগ কড়া নাড়ছে দরজায়