টেকসই ও জ্বালানি সাশ্রয়ী ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে বিশ্বনেতাদের ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ আমরা এমন পৃথিবী গড়ে তুলব– যেখানে দারিদ্র্য থাকবে না, বেকারত্ব থাকবে না এবং কার্বন নিঃসরণ হবে শূন্য। ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বে তিনি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষের জীবনযাত্রায় ‘শূন্য কার্বন’ নিঃসরণ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। নিট কার্বন নিঃসরণ শূন্যের লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে বিদ্যুচ্চালিত বাহন বা বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এ শিল্পখাতের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা অবিশ্বাস্যভাবে কমে আসবে; ফলে কমবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ– যা সামগ্রিকভাবে জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী সুফল বয়ে আনবে।  


তবে কার্যকর, সাশ্রয়ী, সহজপ্রাপ্য ও নির্ভরযোগ্য চার্জিং অবকাঠামো না থাকলে ইভি খাত কেবল একটি সীমিত গণ্ডির মধ্যেই আটকে থাকবে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশে বর্তমানে মাত্র ১৪টি ইভি চার্জিং স্টেশন রয়েছে। ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা পূরণে এ সংখ্যা নগণ্য। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মতো জনবহুল ও ব্যস্ত শহরের অন্যতম প্রধান নাগরিক সমস্যা হচ্ছে বায়ুদূষণ ও যানজট। এ ক্ষেত্রে চার্জিং অবকাঠামো গড়ে তোলার মাধ্যমে সার্বিকভাবে ইভি খাতের সম্ভাবনার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।   


চার্জিং অবকাঠামো গড়ে তোলার আগে কিছু বিষয় গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি। যেমন– কৌশলগত অবস্থান ও ইন্টার অপারেবিলিটি। চার্জিং পয়েন্টগুলো এমন জায়গায় স্থাপন করতে হবে, যেখানে যানবাহনের চলাচল বেশি। যেমন– বাণিজ্যিক এলাকা, মহাসড়ক, আবাসিক এলাকা, হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্র। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানই দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ইভি চার্জিং স্টেশন স্থাপনে যৌথ উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। বিওয়াইডি, মার্সিডিজ বেঞ্জ এবং অডির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চার্জ ও ক্র্যাক প্লাটুনের মতো তৃতীয় পক্ষের সংস্থার মাধ্যমে ইতোমধ্যেই হোটেল, পর্যটন এলাকা, মহাসড়ক ও বাণিজ্যিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে চার্জিং স্টেশন স্থাপন শুরু করেছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গৃহীত এ উদ্যোগগুলোর পরিসর বিস্তৃত করা প্রয়োজন, সরকারকেও এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় ইভি অবকাঠামো পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।


উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি হতে পারে সব অংশীজনের মধ্যে সহযোগিতামূলক মনোভাব। বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, জ্বালানি প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি সেবাদাতা ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা– সবাইকে একসঙ্গে এক লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে চার্জিং প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন আনা যেমন সম্ভব, তেমনি যৌথ বিনিয়োগে কমে আসবে অবকাঠামোগত ব্যয় এবং এর মাধ্যমে সম্ভাব্য ইভি ক্রেতারাও এ খাতের ওপর আস্থা পাবেন– যা সার্বিকভাবে ইভি ব্যবহারকে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 
এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (পিপিপি) এ খাতের বিকাশে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন– পিপিপির অধীনে বেসরকারি খাত উদ্ভাবন ও মূলধনি বিনিয়োগ নিশ্চিত করবে; অন্যদিকে সরকার নিশ্চিত করবে ব্যবসাবান্ধব নীতিমালাবিষয়ক সহায়তা ও প্রণোদনা। এ ক্ষেত্রে নেপালের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০২৩ সালে নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি (এনইএ) দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ৫১টি দ্রুতগতির চার্জিং স্টেশন স্থাপন করে। গ্রিড লাইন সম্প্রসারণ ও ২০০ কেভিএ সক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফরমার বসানোর মাধ্যমে বেসরকারি উদ্যোগগুলোর সম্প্রসারণেও ভূমিকা রাখে এনইএ।   


বাংলাদেশও এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর আমাদের নির্ভরতা যত কমবে, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের দিকে আমরা ততটাই এগিয়ে যাব। কৌশলগত অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারের এ বিষয়ে কাজ করা উচিত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জ্বালানি আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ সাতটি দেশ থেকে ১৪ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এ ক্ষেত্রে খরচ হয় ৯.

৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জ্বালানি তেল আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনতে সরকার দেশের ইভি কাঠামো শক্তিশালী করে তোলার ব্যাপারে মনোযোগী হতে পারে। সবুজ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পাশাপাশি এ খাতে বিনিয়োগ এফডিআই প্রবাহ বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে।       


চার্জিং স্টেশনসহ একটি শক্তিশালী ইভি অবকাঠামো গড়ে তুলতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহও প্রয়োজন; যা আবার গ্রিড আধুনিকায়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোগ এবং স্মার্ট এনার্জি ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ ধরনের যৌথ বিনিয়োগ ইভি শিল্পের প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি ইভি খাতের বিকাশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশজুড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে; সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, জ্বালানি সেবা ও ব্যাটারি প্রযুক্তির মতো সম্পর্কিত শিল্পেও প্রবৃদ্ধি আনবে। গোল্ডম্যান স্যাকসের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ২০৩৫ সালের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে নতুন গাড়ি বিক্রির অর্ধেকই হবে ইভি।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা ছাড়াও জনস্বাস্থ্যের মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখবে ইভি খাতের বিকাশ। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হলো পেট্রোল ও ডিজেলচালিত যানবাহন। ইভির ওপর মানুষের নির্ভরতা বাড়লে বায়ুর মান উন্নত হবে, স্বাস্থ্যসেবার খরচও হ্রাস পাবে।


তাই শক্তিশালী ইভি অবকাঠামো গড়ে তুলতে যত দ্রুত সম্ভব সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই– একটি জাতীয় ইভি অবকাঠামো রোডম্যাপ তৈরি করুন, যেখানে আর্থিক প্রণোদনা ও উদ্ভাবন নিশ্চিতে নীতিগত সহায়তার উল্লেখ থাকবে। চার্জিং স্টেশন নির্মাণের জন্য স্বল্পমূল্যে জমি প্রাপ্তি, বিনিয়োগকারীদের জন্য সহজ শর্তে অর্থায়ন এবং চার্জিং যন্ত্রপাতির আমদানিতে শুল্ক ছাড়– এ ধরনের সুবিধা এ খাতে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে। পাশাপাশি ইভি খাত জোরদারকরণে বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণেই একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, পরিবেশবান্ধব ও অর্থনৈতিকভাবে গতিশীল পরিবহন খাত গড়ে তোলা সম্ভব; যার মাধ্যমে নিশ্চিত হবে সবার জন্য সবুজ ভবিষ্যৎ।  


মিঠুন ভট্টাচার্য: হেড অব বিজনেস ডেভেলপমেন্ট, বিওয়াইডি বাংলাদেশ

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর বহন অবক ঠ ম ব যবহ র ব সরক র র ওপর গ রহণ আমদ ন

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ বছর ধরে খাইট্টা বেচেন শরীয়তপুরের আজিজ

আবদুল আজিজ ঢালীর বয়স ৭০ বছর। ৫০ বছর ধরে করছেন কাঠ-গাছের ব্যবসা। সেই সঙ্গে কোরবানি ঈদের অন্তত ১৫ দিন আগে থেকে মাংস প্রস্তুত করার কাঠের খাইট্টা বিক্রি করেন। তাঁর এ ব্যবসায় সংসারে ফিরেছে সচ্ছলতা।

আজিজের বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলার রুদ্রকর এলাকায়। কোরবানি ঈদের দুই সপ্তাহ আগে থেকে বিভিন্ন হাটে তেঁতুলগাছের তৈরি খাইট্টা বিক্রি করেন। তাঁর খাইট্টা এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

স্থানীয় কয়েকজন বলেন, আজিজ পাঁচ সন্তানের বাবা। স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে সংসার তাঁর। তরুণ বয়সে এলাকায় জ্বালানি কাঠ ও ফার্নিচার তৈরির কাঠের ব্যবসা শুরু করেন। গ্রাম থেকে গাছ কিনে শ্রমিক দিয়ে ফার্নিচারের কাঠ ও জ্বালানি কাঠ প্রস্তুত করে বিক্রি করতেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন ঈদের মৌসুমে মাংস প্রস্তুত করার কাজে ব্যবহৃত খাইট্টা। ওই আয়েই সংসার চলেছে। সন্তানদের পড়ালেখা, বিয়ে দেওয়া—সবই করেছেন ওই আয় দিয়ে। আজিজের তিন ছেলে এখন কর্মজীবী। বয়সের কারণে আজিজ এখন আর কাঠের ব্যবসাটি করেন না। তবে ঈদে মাংস প্রস্তুতকাজে ব্যবহৃত খাইট্টা তৈরি ও বিক্রির কাজটি ছাড়েননি।

ঈদের অন্তত তিন মাস আগে গ্রাম থেকে বিভিন্ন আকৃতির তেঁতুলগাছ কেনেন। তা দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির খাইট্টা তৈরি করে মজুত করেন। ঈদের দুই সপ্তাহ আগে শরীয়তপুর সদরের মনোহার বাজার হাট, আংগারিয়া হাট, বুড়িরহাট, গোসাইরহাটসহ বিভিন্ন হাটে ওই খাইট্টা নিয়ে যান বিক্রির জন্য। আজিজের তৈরি প্রতিটি খাইট্টা বিক্রি করা হয় ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা দামে। এ বছর তিনি ৭০০টি খাইট্টা তৈরি করেছেন।

খাইট্টা নিয়ে সদরের মনোহর বাজার গরুর হাটের পাশে বসেছিলেন আবদুল আজিজ। অনেক ক্রেতা তা কিনে নিচ্ছিলেন। তেমনই একজন শরীয়তপুর পৌরসভার পালং এলাকার রুহুল আমীন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন গরুর হাট ঘুরে মনোহর বাজার গরুর হাট থেকে কোরবানির গরু কিনতেন। সেই সঙ্গে আজিজ চাচার তৈরি তেঁতুল কাঠের খাইট্টা কিনে নিয়ে যান।

আবদুল আজিজ প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসাটা ছাড়তে মন চায় না। তাই ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে এই বয়সেও খাইট্টা নিয়ে হাটে যান তিনি। প্রতি মৌসুমে তাঁর অন্তত দুই লাখ টাকা লাভ হয়। এই টাকা খরচ করে তিনি আনন্দ পান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ