‘বন্দুকের মুখে আমাকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়’
Published: 5th, June 2025 GMT
সোনা বানুর গা এখনো শিউরে ওঠে। গত কয়েকদিনে যা ঘটেছে, তা ভাবতেই তাঁর হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের বাসিন্দা সোনা বানুর বয়স ৫৮ বছর। গত ২৫ মে তাঁকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে ডেকে পাঠানো হয়। সেখান থেকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তিনিসহ মোট ১৪ জনকে ঠেলে (পুশ ইন) পাঠানো হয় বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে কেন পাঠানো হলো, সে সম্পর্কে সোনা বানুকে কিছুই জানানো হয়নি। কিন্তু এই ভীতিকর পরিস্থিতি তাঁর জন্য নতুন কিছু নয়। আসামে সারা জীবন ধরেই তাঁকে এমন অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সোনা বানুকে প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হচ্ছে যে তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক এবং বাংলাদেশ থেকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ নন।
ঘটনা নিয়ে সোনা বানু বলছিলেন, ‘তারা আমাকে বন্দুকের মুখে ঠেলে পাঠিয়েছে। একটি মাঠের মাঝখানে হাঁটুসমান পানিতে টানা দু’দিন আমাকে পানি ও খাবার ছাড়াই কাটাতে হয়েছে। সেখানে ছিল মশা আর জোঁকের উপদ্রব।’ চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শূন্যরেখায় এভাবে দু’দিন কাটানোর পর তাঁকে বাংলাদেশের অংশে একটি পুরোনো কারাগারে নেওয়া হয়।
এই কারাগারে সোনা বানুসহ অন্যরা দু’দিন কাটানোর পর বাংলাদেশের কর্মকর্তারা আবার তাঁদের সীমান্তে নিয়ে যান। সেখানে ভারতীয় কর্মকর্তারা তাঁদের গ্রহণ করেন এবং বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তবে তিনি একটি বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন, আর তা হলো–তাঁর সঙ্গে যাদের আবার ভারতে ফেরত নেওয়া হয়েছে, সেই দলে তাঁর সঙ্গে প্রথমে যাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছিল–তাঁরা রয়েছেন কীনা।
এটা পরিস্কার নয় যে সোনা বানুকে কেন হঠাৎ বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে, আবার কেনইবা তাঁকে ফেরত নেওয়া হয়েছে। তবে তাঁর ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ‘অবৈধ অভিবাসী’ সন্দেহে ট্রাইব্যুনাল ঘোষিত বিদেশিদের ধরপাকড় করেছেন আসামের কর্মকর্তারা এবং তাঁদের সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠিয়েছেন। বিবিসি অন্তত এমন ছয়টি ঘটনা জানতে পেরেছে, যেখানে লোকজন বলেছেন যে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং তাঁদের সীমান্তবর্তী শহরে নিয়ে ‘সীমানা পার’ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী, আসাম পুলিশ ও রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল বিবিসি। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই সাড়া মেলেনি।
বাংলাদেশ থেকে আসা সন্দেহভাজন অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান, ভারতে এখন নতুন কিছু নয়। দুই দেশের সীমন্ত এলাকার আয়তন ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার (২,৫৪৫ মাইল)। ফলে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া তুলনামূলক সহজ কাজ। যদিও অনেক সংবেদনশীল সীমান্ত রয়েছে, যেখানে কড়াকড়ি পাহারা আছে।
বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন এমন আইনজীবীরা বলছেন, কাউকে হঠাৎ বাড়ি থেকে ধরে এনে যথাযাথ প্রক্রিয়া ছাড়াই অন্য দেশে ঠেলে পাঠানোটা দুর্লভ ঘটনা। অথচ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এই প্রবণতা বেড়েছে।
ঠিক কত সংখ্যক লোককে সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠানো হয়েছে, সে বিষয়ে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু বলেনি। তবে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ সূত্রগুলো দাবি করেছে, ভারত শুধু মে মাসেই অন্তত ১২ শতাধিত লোককে ‘অবৈধভাবে ঠেলে’ পাঠিয়েছে। শুধু আসাম থেকে নয়, অন্যান্য রাজ্য থেকেও পাঠানো হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তারা বলেছেন, এর মধ্যে ১০০ লোককে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে শনাক্ত করে তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে ভারত কোনো মন্তব্য করেনি। তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ ধরনের ঘটনা রোধে তাঁরা সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছে।
গণমাধ্যমের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, ‘অবৈধ অভিবাসী’সহ অন্য রাজ্যগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও সাম্প্রতিক অভিযান আসামে পরিস্থিতি জটিল ও উত্তেজনাকর করে তুলেছে। স্থানীয় রাজনীতিতে নাগরিক ও জাতিগত পরিচয়ের ইস্যুটি দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশের সঙ্গে প্রায় তিন শ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা রয়েছে আসামের। কাজের সন্ধানে অথবা ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে প্রতিবেশী দেশ থেকে এই রাজ্যে অভিবাসন বেড়েছে। বিষয়টি আসামের লোকজনকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তাঁদের অনেকই আশঙ্কা করছেন, এর ফলে এখানকার জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটছে এবং স্থানীয়দের হাত থেকে সম্পদ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
কেন্দ্রে ও আসামে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বারবার অবৈধ অভিবাসীদের সমস্যাটি সমাধান করার আশ্বাস দিয়ে আসছে। এ জন্য তারা রাজ্যের জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এই তালিতায় তাঁরাই অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন, যারা প্রমাণ করতে পারবেন যে তাঁরা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে এখানে এসেছেন। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তান থেকে নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রতিবেশী বাংলাদেশ।
এনআরসি তালিকা থেকে অনেকের নাম বাদ যাওয়ায় এটি বারবার যাচাই–বাছাই করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বাদ যাওয়া ব্যক্তিদের যথার্থ কাগজাদি হাজির করে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণের সুযোগ দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত একটা বিশৃঙ্খল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ২০১৯ সালে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে আসামের প্রায় ২০ লাখ বাসিন্দা বাদ পড়ে যায়। তাঁদের অনেককে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলোতে রাখা হয়েছে। আর অন্যরা এই তালিকা নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন।
সোনা বানু জানিয়েছেন, তাঁর আবেদনটি এখনো সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁকে সীমানা ছাড়া করতে বাধ্য করেছে। তাঁর মতো আসামের আরও অন্তত ছয়জনের সন্ধান পেয়েছে বিবিসি, যাঁদের সবার গল্পই এক। তাঁরা সবাই মুসলিম। তাঁরা জানিয়েছেন, যে সময়টায় সোনা বানুর ঘটনাটি ঘটেছে, ঠিক একই সময়ে তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। অথচ তাঁদের প্রত্যেকেরই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে। তাঁরা কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করছেন।
আর যাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে কমপক্ষে চারজন আবার বাড়িতে ফিরে এসেছেন। কিন্তু এখনো তাঁরা জানেন না, তাঁদের কেন ধরে নেওয়া হয়েছিল।
আসামের মোট জনগোষ্ঠী তিন কোটি ২০ লাখ। এর মধ্যে এক–তৃতীয়াংশ মুসলিম। তাঁদের মধ্যে এমন অনেক অভিবাসী রয়েছেন, যারা ব্রিটিশ শাসনামলে এখানে বসতি গেড়েছেন।
আসামের বারপেতা এলাকার বাসিন্দা মালেকা খাতুন (৬৭) এখনো বাংলাদেশে রয়েছেন। সেখানে একটি পরিবার তাঁকে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দিয়েছে। মালেকা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘এখানে আমার কেউ নেই।’ তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছেন। কিন্তু তিনি জানেন না, তিনি ফেরত যেতে পারবেন কীনা, আর পারলেও কখন। এনআরসি ইস্যুতে তিনি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ও রাজ্যের হাইকোর্টে হেরে গেছেন। আবার সুপ্রিম কোর্টে আপিলও করেননি।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ শুরুর কয়েক দিন পর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, ‘আমরা তাঁদেরই ফেরত পাঠাচ্ছি যারা কীনা বিদেশি হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন আবার আদালতে আবেদনও করেননি।’ তিনি এও দাবি করেছেন, যাদের বিষয়টি এখনো আদালতে নিষ্পত্তি হয়নি, তাঁদের কোনো ‘সমস্যা’ হচ্ছে না।
তবে আসামের আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক ভূঁইয়া অভিযোগ করেছেন, সাম্প্রতিক ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। নাগরিকত্ব ইস্যু নিয়ে কাজ করা এই আইনজীবী বলেছেন, ‘যা কিছু হচ্ছে, তা হলো আদালতের আদেশের স্বেচ্ছাচার ও ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা।’
‘জোর করে ও অবৈধভাবে পুশব্যাক নীতি’ বন্ধে হস্তক্ষেপ চেয়ে একটি ছাত্র সংগঠনের করা আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক। কিন্তু তাঁদের এ বিষয়ে প্রথমে আসামের হাইকোর্টে যেতে বলা হয়েছে।
বারপেতা থেকে ১৬৭ কিলোমিটার দূরে মরিগাঁও এলাকার বাসিন্দা রিতা খাতুন। তাঁর স্বামী খায়রুল ইসলাম (৫১) একজন স্কুলশিক্ষক। সোনা বানুকে যখন বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়, সেই গ্রুপে খায়রুল ইসলামও ছিলেন। ২০১৬ সালে তাঁকে বিদেশি বলে ঘোষণা দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর দুই বছর তিনি একটি ডিটেনশেন সেন্টারেও ছিলেন। সোনা বানুর মতো তাঁর আবেদনটিও সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে আছে।
পাশের টেবিল একগাদা কাগজপত্র দেখিয়ে রিতা খাতুন বলছিলেন, ‘প্রতিটি কাগজপত্রে প্রমাণিত যে আমার স্বামী একজন ভারতীয় নাগরিক।’ স্বামীর স্কুলের ও জমির কাগজপত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষের কাছে তাঁর (খায়রুল ইসলাম) নাগরিকত্ব প্রমাণে এগুলো পর্যাপ্ত নয়।’ তিনি বলেন, তাঁর স্বামী, শ্বশুর, দাদাশ্বশুর সবাই ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু গত ২৩ মে পুলিশ এসে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই তাঁর স্বামীকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। এর কিছুদিন পর সীমান্তের শূণ্যরেখায় বাংলাদেশি একজন সাংবাদিকের করা ভিডিও দেখে তাঁরা তাঁর স্বামীকে শনাক্ত করতে পেরেছেন। তাঁরা তখনই কেবল জানতে পেরেছেন, তাঁর স্বামী কোথায় আছেন।
সোনা বানুর মতো খায়রুল ইসলামকেও ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তবে পরিবার থেকে তাঁর ফেরত আসার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলেও এ বিষয়ে পুলিশ ‘কিছুই জানে’ না বলে বিবিসির কাছে দাবি করেছে।
আরেক ভুক্তভোগী আবদুল লতিফ। যে রাতে খায়রুল ইসলামকে তুলে নেওয়া হয়, সেই একই রাতে তাঁকেও তুলে নেওয়া হয়। আবদুল লতিফের মেয়ে সানজিমা বেগম জানান, একটি ভুল পরিচয়ের কারণে তাঁর বাবাকে বিদেশি হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। তিনি বলেন, তাঁর বাবার ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র তাঁদের কাছে রয়েছে।
সানজিমা বেগম বলেন, ‘আমার বাবার নাম আবদুল লতিফ। আমার দাদার নাম আবদুল সুবহান। কিন্তু ফরেনার ট্রাইব্যুনাল থেকে এক বছর আগে যে নোটিশ আসে, সেখানে উল্লেখ রয়েছে–আবদুল লতিফ, বাবার নাম শুকুর আলী। কিন্তু তিনি (শুকুর আলী) আমার দাদা নন। এমনকি আমি তাঁকে চিনিও না।’
আবদুল লতিফের পরিবার জানতে পেরেছে যে তিনি বর্তমানে আসামে ফেরত এসেছেন। কিন্তু এখনো বাড়িতে পৌঁছাননি।
যখন এই লোকগুলো আবার বাড়িতে ফেরত আসছেন, তখন তাঁদের মধ্যে একটা ভয়ও কাজ করছে–আবার হঠাৎ তাঁদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। যেমনটা সানজিমা বেগম বলছিলেন, ‘আমরা খেলনার বস্তু নই। তাঁরা (ভুক্তভোগী) মানুষ। তাঁদের নিয়ে আপনি যা খুশি তা করতে পারেন না।’ সূত্র: বিবিসি
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প শইন কর মকর ত র ক গজপত র র পর ব র বলছ ল ন আইনজ ব বল ছ ন আস ম র কর ছ ন ব ষয়ট
এছাড়াও পড়ুন:
আসামে শত শত ভারতীয়কে বিদেশি বলে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে: মুম্বাইভিত্তিক সিজেপির প্রতিবেদন
উত্তর–পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যে হাজার হাজার দরিদ্র এবং প্রধানত শ্রমিক শ্রেণির মানুষ ‘নিদ্রাহীন’ রাত কাটাচ্ছেন। কারণ, শত শত ভারতীয় নাগরিককে বাংলাদেশি বলে আন্তর্জাতিক সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে (বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’) দেওয়া হয়েছে।
ভারতের মুম্বাইয়ের নাগরিক সমাজের সংস্থা সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিসের (সিজেপি) প্রকাশিত এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে। সাংবাদিক, আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী তিস্তা শেতেলবাদের এই সংস্থা জানিয়েছে, আসামের ৩৩ জেলার সর্বত্রই নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করে ‘নারী, শিশু ও পুরুষদের’ বেআইনিভাবে আটক করে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হচ্ছে।
তবে গত রোববার (১ জুন) ওই সব ভারতীয় নাগরিকের অনেককে বাংলাদেশ থেকে ‘পুশ ব্যাক’ (ফেরত পাঠানো) করা হয়েছে বলেও সিজেপির এই বিশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। আসামে অন্তত ছয়জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছে এই সংস্থাটি।
সিজেপির প্রতিবেদনে যে ছয় নারীর সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে, তাঁরা হলেন হাজেরা খাতুন, সোনা বানু, রহিমা বেগম, জাহানারা বেগম, আসিফা বেগম ও সাহেরা খাতুন। এই প্রতিবেদন তৈরিতে আসামের বেশ কিছু সাংবাদিক ও সমাজকর্মী অংশ নিয়েছিলেন বলেও জানানো হয়েছে।
সিজেপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৩ মে থেকে হঠাৎ করেই রাজ্যের ৩৩টি জেলায় পুলিশি অভিযান শুরু হয় এবং ‘কোনো নথিভুক্ত মামলা, নোটিশ বা আইনি যৌক্তিক ব্যাখ্যা ছাড়াই প্রায় ৩০০ মানুষকে আটক করা হয়।
সাংবিধানিক ও আইনি নিয়ম লঙ্ঘন করে বন্দীদের অবস্থান সম্পর্কে পরিবার এবং আইনজীবীদের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। যদিও প্রায় ১৫০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অসমর্থিত প্রতিবেদনগুলো বলছে, নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য এখনো আদালতে লড়ছেন, এমন ১৪৫ জনকে জোর করে সীমান্তের ওপারে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
সাংবিধানিক ও আইনি নিয়ম লঙ্ঘন করে বন্দীদের অবস্থান সম্পর্কে পরিবার এবং আইনজীবীদের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। যদিও প্রায় ১৫০ জনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অসমর্থিত প্রতিবেদনগুলো বলছে, নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য এখনো আদালতে লড়ছেন এমন ১৪৫ জনকে জোর করে সীমান্তের ওপারে ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ ঠেলে দেওয়া হয়েছে।সিজেপির প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ব্যক্তির মধ্যে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেককে আইনি ট্রাইব্যুনাল বিদেশি ঘোষণা করেছে। আবার এমন অনেকেও আছেন, যাঁরা জামিনে মুক্তি পেয়েছেন বা যাঁরা নাগরিকত্ব প্রমাণের উদ্দেশ্যে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এঁদের অন্য দেশের ঠেলে দেওয়া হলো কোনো আনুষ্ঠানিক নির্বাসনবিষয়ক আদেশ বা দ্বিপক্ষীয় প্রত্যাবাসন চুক্তি প্রকাশ না করেই। ফলে এসব ব্যক্তির পরিবার চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।
ভুক্তভোগীর বক্তব্য
বরপেটা জেলার ভাল্লুকি গ্রামের সানসের আলীর স্ত্রী ষাটোর্ধ্ব হাজেরা খাতুনকে বেআইনিভাবে জোর করে গত ২৫ মে আসাম পুলিশ আটক করে বলে অভিযোগ উঠেছে। অতীতেও তাঁকে একবার আটক করা হয়েছিল এবং তাঁর মামলা এখনো গুয়াহাটি হাইকোর্টে চলছে। তিনি বর্তমানে জামিনে রয়েছেন।
এরপরও হাজেরার পরিবারকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তাঁকে আটক করা হয়। ফলে চরম উৎকণ্ঠায় ভুগে তাঁর পরিবার নানা জায়গায় হাজেরার খোঁজ করতে শুরু করেন। কিন্তু ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত এই নারীর কোনো সংবাদ তাঁর পরিবার পায়নি বলে সিজেপির সমাজকর্মী ও সাংবাদিক নন্দ ঘোষ এবং আইনজীবী অভিজিৎ চৌধুরী জানিয়েছেন। হাজেরা মে মাসের শেষে বাসায় ফেরার পর তাঁর সঙ্গে সিজেপির প্রতিনিধিরা কথা বলেন।
হাজেরার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর মতো আরও অনেককে তিন–চারটি বাসে করে বরপেটা জেলা থেকে ৯১ কিলোমিটার দূরে মাটিয়া বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।
সিজেপির প্রতিনিধিদের হাজেরা বলেন, ‘সারা দিনরাত না খেয়ে এই সময়টা কাটাতে হয়েছে। পরের দিন সকাল ১০টার দিকে…আমরা তখনো বাসে বসে আছি…আমাদের বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পরে আমাদের সামান্য ভাত দেওয়া হয়। আমরা খুব ভয় পেয়েছিলাম, আমরা ঠিকমতো খেতেও পারিনি। এরপর আমরা ভেবেছিলাম, যে ঘরে আমরা ছিলাম, সেখানে কিছুক্ষণ হয়তো বসতে দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা বসার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডাকা হয় এবং বলে আমাদের ছবি তোলা হবে।’
হাজেরার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁর মতো আরও অনেককে তিন–চারটি বাসে করে বরপেটা জেলা থেকে ৯১ কিলোমিটার দূরে মাটিয়া বন্দিশিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়।হাজেরা সিজেপিকে বলেন, ‘এরপর আমাদের হাতে কিছু বাংলাদেশি টাকা দিয়ে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাস থেকে নামিয়ে বলা হয়, নিজেদের মধ্যে কোনো কথা না বলতে। আমরা চূড়ান্ত অসহায় বোধ করতে শুরু করি। সেখানে সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয় এবং আমাদের বাধ্য করা হয় সারা রাত অভুক্ত অবস্থায় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে।’
এরপর সকালে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি হাজেরা ও তাঁর দলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, তাঁরা কেন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছেন। তাঁদের সেখানেই রেখে দুই পক্ষের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হয় এবং তা চলতে থাকে।
হাজেরা বলেন, ‘দুই দিক থেকে আমাদের একবার এদিকে, একবার ওদিকে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের মধ্যে আলোচনা চলতেই থাকে। কিন্তু আমাদের কী হবে, সে বিষয়ে কোনো সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না।’
হাজেরা বিবি সিজেপির প্রতিবেদকদের আরও বলেন, খায়রুল ইসলাম নামের একজন স্কুলশিক্ষক তাঁদের ওপরে এবং বিশেষত নারীদের ওপরে এ ধরনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হওয়ায় তাঁকে এমনভাবে মারধর করা হয় যে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। একটা সময় পর হাজেরা এবং তাঁর দলকে কেউ বাধা না দেওয়ায় তাঁরা ভারতের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। এভাবে তাঁরা সীমান্ত অঞ্চল থেকে বরপেটা জেলার উদ্দেশে রওনা দেন।
হাজেরার এক ছেলে সিজেপির প্রতিবেদকদের বলেন, ‘৩১ মে রাত ১১টার দিকে আমরা খবর পাই, আমার মা (হাজেরা) এবং সোনা বানু নামের এক নারী গোয়ালপাড়া জেলার মহাসড়কে অবস্থান করছেন। তখন আমি জব্বার ভাইকে (স্থানীয় ছাত্রনেতা) নিয়ে যাই এবং মাকে উদ্ধার করি।’
এরপর আমাদের হাতে কিছু বাংলাদেশি টাকা দিয়ে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাস থেকে নামিয়ে বলা হয়, নিজেদের মধ্যে কোনো কথা না বলতে। আমরা চূড়ান্ত অসহায় বোধ করতে শুরু করিহাজেরা খাতুন, আসামের ভুক্তভোগী মুসলিম নারীসিজেপির প্রতিবেদকেরা বলছেন, বাকিদেরও কমবেশি একই অভিজ্ঞতা। তবে তাঁরা হয়তো অন্য দলে ছিলেন বা অন্য কোনো সীমান্ত দিয়ে তাঁদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। তাঁদেরও বৃষ্টির মধ্যে দুই দেশের মধ্যবর্তী নিরপেক্ষ অঞ্চলে এক বা একাধিক রাত কাটাতে হয়েছে। মাথার ওপর কোনো ছাদ ছিল না। বয়স্ক ও নারীদের অনেককেই অসুস্থ অবস্থায় ভেজা কাপড়ে দুই দেশের মধ্যবর্তী নিরপেক্ষ অঞ্চলে সারা রাত দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে বা পানির মধ্যে ধানখেতে বসে থাকতে হয়েছে।
স্থানীয় এক সাংবাদিক প্রথম আলোকে এই প্রসঙ্গে বলেন, আসামে এই মুহূর্তে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন, কবে তাঁদের দরজায় পুলিশ কড়া নাড়ে এবং কোনো কথাবার্তা না শুনে বা কাগজপত্র না দেখে তুলে নিয়ে সীমান্তের ওপারে নিরপেক্ষ অঞ্চলে পাঠিয়ে দেয়। নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে এ ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু কখন, কার সঙ্গে ঘটবে, তা কেউ বুঝতে পারছেন না।
আসাম রাজ্যে আগামী বছর নির্বাচন। তার আগে বাঙালি মুসলিমদের ইচ্ছামতো তুলে নিয়ে যাওয়া এবং বিদেশি বলে হেনস্তা করার বিরুদ্ধে আসামের কিছু রাজনৈতিক নেতা ইতিমধ্যে সরব হয়েছেন। তবে এই প্রক্রিয়া এখনো চলছে বলে স্থানীয় সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন।