বিগত কয়েক সপ্তাহের জল্পনাকল্পনার শেষে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদুল আজহার আগের সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। দীর্ঘ ভাষণে তিনি নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের বহুল কাঙ্ক্ষিত রোডম্যাপের পাশাপাশি তিনি তাঁর সরকারের গত ১০ মাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে বন্দর ও করিডর নিয়ে যে অপরাজনীতি ঘটেছে, তার জবাবও তিনি দিয়েছেন।

সংগত কারণেই প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের দিকে সারা দেশের মানুষের নজর ছিল। বিএনপি ও বিএনপিমনা কিছু রাজনৈতিক দল অনেক দিন ধরেই নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে আসছে। প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য থেকে তারা রোডম্যাপে নিশ্চয়তা প্রত্যাশা করেছে। যদিও ড.

ইউনূস বারবার নিশ্চয়তা দিয়েছেন, কোনোভাবেই নির্বাচন আগামী বছরের জুন মাসকে অতিক্রম করবে না, তবু বিএনপির দাবি ছিল ‘সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ’। ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে—এই প্রতিশ্রুতি কেন রোডম্যাপ নয়, বিএনপির তরফে অবশ্য তার বিপক্ষে জোরালো যুক্তি মেলেনি।

অবশেষে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে জানালেন, আগামী বছরের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সুনির্দিষ্ট মাস ঘোষণার পরও অবশ্য বিএনপিকে সন্তুষ্ট করা যায়নি। তারা এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন দাবি করে এসেছে। একটা মাসের ব্যাপারে অনড় থেকে প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করার কী অর্থ, তা অবশ্য স্পষ্ট হয়নি।

যা হোক, এত দিন বিএনপি নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়ে এলেও প্রধান উপদেষ্টা কর্তৃক নির্বাচনের মাস ঘোষণার পর তারা এখন বলছে, এপ্রিলে নির্বাচনের মাস ঘোষণা নাকি ‘জাতির প্রত্যাশা’ পূরণ করতে পারেনি।

নির্বাচন ডিসেম্বর নাকি এপ্রিলে হবে—এই ডামাডোলে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিক রীতিমতো তলিয়ে গেছে। টক শোগুলোতে এত দিন আলোচনা হতো নির্বাচনকে ঘিরে ‘অনিশ্চয়তা’, ‘টানাপোড়েন’, ‘ষড়যন্ত্র’ ইত্যাদি বিষয়ে।

নির্বাচনের মাস ঘোষণার পর টক শোগুলোতে নির্বাচনের মাস হিসেবে এপ্রিলের সঠিকতা-বেঠিকতাই প্রাধান্য পাচ্ছে। অথচ প্রধান উপদেষ্টা যে তাঁর সরকারের গত ১০ মাসের কাজের ফিরিস্তি দিলেন, সে বিষয়ে মিডিয়ায় পিনপতন নীরবতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশেষত গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশে নেট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এই জরুরি অর্থনৈতিক তথ্যও মূলধারার মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারেনি। অথচ বারবার বলা হচ্ছিল, দেশে ‘অনির্বাচিত’ সরকার থাকলে কোনো বিনিয়োগ আসবে না।

বর্তমান নিবন্ধে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করব। সেটিও নির্বাচনের মাসকেন্দ্রিক অর্থহীন আলোচনার তলে চাপা পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যের দিক বিবেচনায় বিষয়টি অতিগুরুত্বপূর্ণ।

প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেছেন, ‘আমি দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাই, আপনারা সকল রাজনৈতিক দল এবং আপনাদের এলাকার প্রার্থীদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার আদায় করে নেবেন, যেন আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনেই যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে, তা কোনো প্রকার কাটাছেঁড়া ছাড়াই যেন তাঁরা অনুমোদন করেন।’

প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্য উদ্বেগজনক। তিনি আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের হাতে সংস্কার অনুমোদনের গুরুদায়িত্ব সোপর্দ করতে যাচ্ছেন, তাঁর বক্তব্যে এমন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। এতে পুরো সংস্কার উদ্যোগই একধরনের অনিশ্চয়তার ঝুঁকিতে পড়েছে।

অন্তত দুটি কারণে আগামী নির্বাচিত সংসদের হাতে সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া যায় না। প্রথম কারণটি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাজনিত। দ্বিতীয় কারণটি পদ্ধতিগত। এ ছাড়া যেসব জনগুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে না, সেসব সংস্কারের পরিণতি কী হবে, সেই প্রশ্নও থেকে যায়। ‘যেসব সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য অর্জিত হয়েছে’—কেবল সেগুলোই যদি আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনে ওঠানো হয়, তাহলে ঐকমত্য হয়নি, অথচ জনগুরুত্বপূর্ণ সংস্কার জনগণের মতামত ছাড়াই খরচের খাতায় চলে যাচ্ছে।

আরও পড়ুনসংস্কার সংস্কার শুনছি শুধু, সংস্কার কোথায়০৩ জুন ২০২৫

জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দেয় ঠিকই, কিন্তু জনগণ ও রাজনৈতিক দলের পার্থক্য ভুলে যাওয়া উচিত নয়। ভোট দিয়ে জনগণ প্রতিনিধি পাঠানোর মানে এই নয় যে ‘জনগণ’ ওই সংসদে বিলীন হয়ে গেছে। বরং জনগণ সর্বদাই বিরাজ করে। কারণ, ওই সংসদ যখন স্বৈরাচারী বা একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করে, তখন ‘জনগণ’ ধারণার বলেই আবার বিদ্রোহ বা আন্দোলন সংঘটিত হয়। জনগণ সংসদে বিলীন হয়ে গেলে তা আর সম্ভব নয়। দার্শনিক জুডিথ বাটলারের মতে ‘জনগণ’ একটি আইনাতিরিক্ত (এক্সট্রা পার্লামেন্টারি) শক্তি, যাকে ছাড়া আবার সংসদীয় রাজনীতি কল্পনা করা যায় না। কাজেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়কে জনগণের প্রতিনিধিত্বে সংকুচিত করা উচিত হবে না।

ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বলছে, সংসদের হাতে সংস্কার বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিলে তা মূলত সরকারি দলের সদিচ্ছার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন ভিন্ন ভিন্ন তিনটি রাজনৈতিক জোট রাজপথে একই দিনে একই ঘোষণা পাঠ করেছিল। তারা তিন জোটের রূপরেখা হিসেবে পরিচিত ওই ঘোষণা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে সরকারে এসে বিএনপি তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়ন করেনি।

ওই রূপরেখায় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করা হয়। ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে না পারে, সে লক্ষ্যে ব্যক্ত করা হয় দৃঢ় সংকল্প। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বই-পরবর্তী নির্বাচনী অভিযাত্রার প্রথম ধাপে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন নির্বাচনের অঙ্গীকার থেকে সরে আসে।

সরকার এ বছরের জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করতে চায়। সেখানে কী কী সংস্কার হবে, তা লিপিবদ্ধ থাকবে। গণপরিষদ গঠন অথবা গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। জুলাই সনদ ও সম্মত সংবিধান সংস্কারের খসড়া বিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সাধারণ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের মাধ্যমে জনসম্মতি আদায় করে নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কারবাদী সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নাগরিক কোয়ালিশন। এ পদ্ধতিও গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করা উচিত।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দলীয় সরকারের অধীন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আন্দোলনের চাপে দেড় মাসের কম সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয় তারা। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে জেতে আওয়ামী লীগ।

তিন জোটের রূপরেখায় দেশে ‘স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা’ ও ‘প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার’ অঙ্গীকারও করা হয়েছিল। কোনো দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের অবসান ঘটিয়ে সাংবিধানিক পন্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করাও আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। মৌলিক অধিকারবিরোধী কোনো আইন করা যাবে না, এমন অঙ্গীকারও ছিল। গত প্রায় তিন যুগের অভিজ্ঞতা বলছে, ক্ষমতায় গিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের করা অঙ্গীকার নিজেরাই ভঙ্গ করেছে।

শুধু তা-ই নয়, অন্যের প্রস্তুত করে দেওয়া সুপারিশও কি রাজনৈতিক দলগুলো বাস্তবায়ন করে? প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার (ডিসেম্বর ১৯৯০—মার্চ ১৯৯১) প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে ২৯টি টাস্কফোর্স গঠন করেছিল। টাস্কফোর্সগুলোর উদ্দেশ্য ছিল অর্থনীতি ও প্রশাসন প্রক্রিয়ার নানা রকম সমস্যার সমাধান করা।

বিগত সামরিক স্বৈরাচার আমলে ঘনীভূত হওয়া সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে দেশের আড়াই শতাধিক সেরা পেশাদার প্রতিভাবান ব্যক্তি ২৯টি টাস্কফোর্সের মাধ্যমে নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাব রেখেছিলেন। সাহাবুদ্দীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং টাস্কফোর্স গঠন প্রক্রিয়ার সংগঠক অধ্যাপক রেহমান সোবহান জানাচ্ছেন, ‘টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনগুলো এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল, যেন ১৯৯১ সালের মার্চের নির্বাচনে নির্বাচিত সরকার ও সংসদে বিরোধী দল উভয়কেই পেশ করা যায়। দুঃখজনকভাবে নির্বাচিত বিএনপি সরকার প্রতিবেদনগুলো সামান্যই কাজে লাগিয়েছিল।’

আরও উল্লেখ্য, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় নীতি ও সংস্কারের প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য দেশের শীর্ষস্থানীয় ১৬০ জন পেশাদার ব্যক্তিকে নিয়ে ১৬টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনগুলোকেও তৎকালীন নির্বাচিত সরকার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। (রেহমান সোবহান, ১২ নভেম্বর ২০২৪, প্রথম আলো)

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেসব সংস্কার সুপারিশ পরবর্তী সংসদের হাতে তুলে দিতে চাচ্ছে, তারা যে সেই সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

দ্বিতীয় কারণটি পদ্ধতিগত। এ কথা সবাই মানেন, বর্তমান বাহাত্তরের সংবিধানের একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতাকাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বৈরতান্ত্রিকতার বীজ নিহিত। সংগত কারণেই সংবিধান সংস্কার কমিশন আনীত সংস্কার সুপারিশগুলোর মূল লক্ষ্য এই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর নির্মূল এবং স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পত্তন। তথা বিদ্যমান সংবিধানকেই চ্যালেঞ্জ করা বর্তমান সংস্কারের প্রধান এজেন্ডা।

বিদ্যমান সংবিধানের অধীন গঠিত সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্যদের সমর্থনে ঠিক সেই সংশোধনীগুলোই আনতে পারে, যা বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বিদ্যমান সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ‘অসাংবিধানিক’ মনে করে এমন যেকোনো সংশোধনী আদালত বাতিল করে দিতে পারে কিংবা পরবর্তী সংসদ একই ধরনের দুই-তৃতীয়াংশের জোরে বাতিল করার সক্ষমতা ধারণ করে। অর্থাৎ সংসদে আনীত সংশোধনী স্থায়ী ও টেকসই নয়।

সংসদে ততটুকুই সংশোধনী আনা যায়, যতটুকু সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। অন্যদিকে জনগণের সার্বভৌম ইচ্ছা তথা গাঠনিক ক্ষমতার দ্বারা সমর্থিত ও বৈধতাপ্রাপ্ত মৌলিক সংস্কার চাইলেই সংসদ বা বিচার বিভাগ চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না। মৌলিক সংস্কারই বরং রাষ্ট্রের উল্লিখিত দুই বিভাগের বৈধতা ও ক্রিয়াশীলতার ভিত্তি হয়।

একদিকে যদি ৭০ অনুচ্ছেদ কার্যকর থাকে, অন্যদিকে সরকারি দলের হাতে যদি দুই-তৃতীয়াংশ আসন থাকে (যা আবার মোট প্রদত্ত ভোটের ৪০-৪৫ শতাংশের বেশি নয়); সে ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনীগুলো মূলত দলীয় প্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছাতেই ঘটে। কারণ, ৭০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক দলীয় সংসদ সদস্যরা দলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারেন না।

দুই-তৃতীয়াংশ আপনাকে সংবিধানের যেমন খুশি তেমন পরিবর্তনের ক্ষমতা দেয়, ৭০ অনুচ্ছেদ আপনাকে দলের সংসদ সদস্যদের মুখ বন্ধ রাখার ক্ষমতা দেয়। এই দুই ক্ষমতা মিলে এক প্রকাণ্ড সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়। এ কারণে সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ যেন কার্যকর না হয় তথা দলীয় সংসদ সদস্যরা যেন দলের সিদ্ধান্তের বাইরে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারেন—বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অন্য সব দল ও সুশীল সমাজ এমন মত রেখেছে।

সরকার এ বছরের জুলাই মাসের মধ্যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করতে চায়। সেখানে কী কী সংস্কার হবে, তা লিপিবদ্ধ থাকবে। গণপরিষদ গঠন অথবা গণভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে। জুলাই সনদ ও সম্মত সংবিধান সংস্কারের খসড়া বিল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সাধারণ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের মাধ্যমে জনসম্মতি আদায় করে নেওয়ার সুপারিশ করেছে সংস্কারবাদী সিভিল সোসাইটির সদস্যদের নাগরিক কোয়ালিশন। এ পদ্ধতিও গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করা উচিত।

তিন জোটের রূপরেখার পরিণতি এড়াতে পুনর্লিখিত/সংস্কারকৃত সংবিধানের পরিশিষ্ট হিসেবে এটিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনীর ক্ষেত্রে দলীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। যদি তারা সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তাহলে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয়ে পরিণত হবে।

একই ভুল বারবার করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। এক দলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর জাতীয় আকাঙ্ক্ষা ঝুলে থাকতে পারে না। তাই প্রধান উপদেষ্টা বর্ণিত সময়কালের মধ্যে নির্বাচন হচ্ছে ধরে নিয়ে এর আগেই সংস্কার বাস্তবায়ন করে পরবর্তী সংসদ যেন তা মান্য করার আইনি বাধ্যবাধকতা অনুভব করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী সংসদ সংস্কারের বৈধতা দেবে, তা নয়। বরং সংস্কারই হবে আগামী সংসদের বৈধতার ভিত্তি।

সারোয়ার তুষার যুগ্ম আহ্বায়ক ও কো-অর্ডিনেটর সংস্কার সমন্বয় কমিটি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ন জ ট র র পর খ সব স স ক র জ ল ই সনদ ড স ম বর সরক র র ব যবস থ এ বছর র ক সরক র র প রথম ন শ চয়ত পরবর ত জনগণ র ক ত কর লক ষ য প রস ত দল য় স ক ষমত ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কতটা প্রস্তুত

নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে জুলাই–পরবর্তী সময়ের রাজনীতি একটি ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচালিত হবে, তেমন এক প্রত্যাশা জাতির মনে তৈরি হয়েছে। কারণ, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে একটি বৈপ্লবিক ও ঐতিহাসিক বদল নিয়ে আসার সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করেছে। 

এ সুযোগকে যথাযথভাবে নিতে চাইলে প্রথমেই রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় স্বার্থে একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে, যে প্রক্রিয়া বর্তমানে চলমান। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক; কিন্তু জাতীয় প্রশ্নে আবার একটি ঐকমত্যে পৌঁছানোর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা থাকা ও তার চর্চার অভ্যাসও জরুরি। মতপার্থক্যের মধ্য দিয়েই আমরা একটি বৃহত্তর ঐক্যে পৌঁছাতে পারব। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় স্বার্থে এক থাকার কোনো বিকল্প নেই।

জাতীয় স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার এই তাগিদ আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর নানা সময়ের বিবৃতির মধ্যে দেখতে পাই। একে কেবল তাদের বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এর বাস্তবায়নের পথ দেখাতে হবে। নিজেদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থসংবলিত বিষয়াবলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা জরুরি। এর সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করা প্রয়োজন। কেননা বিগত সময়ে জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থতার পরিণতি ছিল গণবিচ্ছিন্নতা ও আস্থাহীনতা। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের জনগণ সেই অর্থে কখনোই ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিল না। 

গণবিচ্ছিন্নতা নয়, বরং গণসম্পৃক্ততার ওপর অধিক জোর দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের সব উন্নয়ন–পরিকল্পনা গণমানুষের চাহিদাকে কেন্দ্রে রেখে বাস্তবায়ন করার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। বছরের পর বছর ধরে আমাদের যতটা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তার সুফল খুব একটা দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে আমরা পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছি। সব সময় তথাকথিত উন্নয়নের সুফল কেবল একটি সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর হাতের নাগালে ছিল। তাই আমাদের জন্য গণমানুষকেন্দ্রিক একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। যার অনেক অবকাঠামো ও চর্চা আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান; কিন্তু সুশাসনের অভাবে তার সুফল আমাদের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে মাও সে-তুংয়ের একটি উদ্ধৃতি বেশ প্রাসঙ্গিক, ‘উন্নয়ন মানুষের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়ে একটি সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে পারে।’ সেই মুক্তির স্বাদের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের রূপরেখা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাদের আস্থা অর্জন করা সহজ হবে।

এ বাস্তবতায় জাতীয় উন্নয়নের এমন একটি সমন্বিত রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা গড়ে তুলতে হবে, যা আমাদের বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নকে প্রতিফলিত করবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের একটি ‘বাংলাদেশি ড্রিম’ বা স্বপ্ন গড়ে তুলতে হবে, যেখানে গণমানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাবে; যা আমরা অনেক উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই, যারা তাদের উন্নয়নের রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করে আজ বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। 

আমরা সব সময় দেখি যে উন্নয়ন–পরিকল্পনায় জাতিগত প্রত্যাশার চেয়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একক বা একপক্ষীয় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার তাগিদ দেখা যায়, যা বিশেষ করে বিগত দশকের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হবে।

তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকে যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করা যায়, তা হবে এক অভূতপূর্ব বিষয়। এতে রাষ্ট্রীয় পরিসরে ক্ষমতার পালাবদল ঘটলেও মৌলিক উন্নয়ন–আকাঙ্ক্ষা ও কাঠামোর কোনো বদল ঘটবে না। ফলে উন্নয়নপ্রক্রিয়া কোনো পরিস্থিতিতেই বাধাগ্রস্ত হবে না। যদিও এটি সহজ বিষয় নয়, আবার কঠিন বলে আমরা তা বাস্তবায়ন করতে পারব না ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও উচিত হবে না। 

সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি, জাতীয় স্বার্থসংবলিত বিষয়, যেমন রাখাইনে মানবিক করিডর, চট্টগ্রাম বন্দর এবং সংস্কারবিষয়ক নানা খাতের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে এখনো একটি সমন্বিত ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না হলেও অনেক বিষয়েই তারা একমত, যা প্রমাণ করে জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে একসময় একটি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব। তবে এর জন্য সময় প্রয়োজন এবং মনে রাখা জরুরি যে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া; তাই একটি স্বল্প সময়ে অন্তর্বর্তীব্যবস্থায় আমরা সব বিষয়ে একমত হতে পারব; সেই প্রত্যাশাও একটি উচ্চাভিলাষী আকাঙ্ক্ষা। 

এর জন্য যেমন যথাযথ সময় প্রয়োজন, তেমনি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোরও সেই ইতিবাচক মানসিকতারও প্রয়োজন। পৃথিবীর কোনো দেশই সংস্কারপ্রক্রিয়া এক দিনে বাস্তবায়িত করতে পারেনি। আমরা যদি প্রতিবেশী বন্ধুদেশ চীনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই ১৯৪৯ সালের বিপ্লবের পর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তাদের জাতীয় পরিসরে সংস্কারপ্রক্রিয়া ও সংলাপ জারি রেখেছে। তাদের সেই সংস্কার ছিল অগ্রাধিকার ও খাতভিত্তিক। 

একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রয়োজনীয় ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংস্কারযোগ্য খাতকে চিহ্নিত করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় যখন সবার অংশগ্রহণ ও অংশীদারত্ব থাকে, তখনই তা বাস্তবায়ন করা বাস্তবসম্মত, ফলপ্রসূ ও দীর্ঘ মেয়াদে স্থায়ী হয়। 

বর্তমান এই সময়টায় দেশটাকে সত্যিকার অর্থেই বদলে দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এক অভাবনীয় সুযোগ তৈরি করেছে। তাদের উচিত হবে সেই বিষয় নিয়ে কাজ করা। 

বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জনগণের স্বার্থেই শীত মৌসুমে নির্বাচন হওয়া উচিত
  • পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো কতটা প্রস্তুত
  • চারটি রোডম্যাপ: বিএনপির কাছে জনগণের প্রত্যাশা
  • বরগুনায় ভয়াবহ ডেঙ্গু পরিস্থিতি, স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি
  • সংবিধান সংস্কারের পদ্ধতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য বিভ্রান্তিকর: রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন
  • ‘নিরঙ্কুশ ক্ষমতার রাজনীতিতে সবকিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি হয়ে পড়ে’
  • শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতি জন্ম দিল যে জল্পনা-কল্পনার
  • শি জিনপিংয়ের অনুপস্থিতি জন্ম দিয়েছে অনেক জল্পনা-কল্পনার
  • হাসিনা মানুষের ভোটাধিকার লুণ্ঠন করেছে: আমান উল্লাহ আমান