বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশীদারত্ব ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষের ইতিহাস কেবল বঞ্চনার। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হবার সময় রাষ্ট্রব্যবস্থায় অংশীদারত্ব পাওয়ার জন্য আদিবাসীদের উত্থাপিত দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। বিগত ৫ দশকে রাষ্ট্রের যে বাজেট তৈরি হয়েছে, সেই বাজেটে আদিবাসীরা থেকেছে উপেক্ষিত ও প্রবঞ্চিত।

অর্থনীতিবিদ ড.

আবুল বারকাত রাষ্ট্রের এই প্রবঞ্চনার প্রক্রিয়াকে নামকরণ করেছেন—মানুষের ‘অ-জনগণকরণ’। মূলত দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ, যারা প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে, তারাই হলো ‘অ-জনগণ’। অন্যদিকে হাতে গোনা কিছু লুটেরা-পরজীবী-রেন্ট সিকার ও তাদের সহযোগীরা এই ‘অ-জনগণ’ভুক্ত মানুষের অংশ নয়। তারাই দেশের ৫ শতাংশ মানুষ, যারা সমাজের শ্রেণির সর্বোচ্চ স্তরের মানুষ।

বিগত ৫ দশকে (১৯৭২-২০২২) জাতীয় বাজেটে সরকারের মোট বরাদ্দ ছিল (২০২১-২২ অর্থবছরের বাজারমূল্যে) ৬০ লাখ ৩৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদিবাসী মানুষ–সংশ্লিষ্ট বরাদ্দের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫৮ কোটি টাকা। এর অর্থ হলো জাতীয় বাজেটে বরাদ্দকৃত মোট অর্থের মাত্র ১.৬৭ শতাংশ বরাদ্দ হয়েছে আদিবাসী–সংশ্লিষ্ট প্রকল্প ও কার্যক্রমে। যেখানে আদিবাসীরা মোট জনসংখ্যার ২.৯৪ শতাংশ (আদিবাসী জনসংখ্যা ৫০ লাখ হিসাবে), সেখানে জাতীয় বাজেটে ১.৬৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া একটি প্রবঞ্চনা। এই তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে ২০২৩-এ প্রকাশিত আবুল বারকাতের অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি বই থেকে।

গত ৫ দশকের বাজেটে জনসংখ্যা অনুপাতে আদিবাসীদের ন্যায্য হিস্যা ছিল ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। কিন্তু উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বরাদ্দ মিলে তারা পেয়েছে মাত্র ১ লাখ ৭৫৮ কোটি টাকা (ন্যায্য হিস্যার ৫৭ শতাংশ)। এর মধ্যে আবার উন্নয়ন বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৩৭ হাজার ২৮০ কোটি টাকা (মোট হিস্যার ২১ শতাংশ)।

এ ক্ষেত্রে মোট বাজেট বরাদ্দে ৫ দশকে তাদের বঞ্চিত হিস্যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, বর্তমানে যার বাজারমূল্য বছরে ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। জনসংখ্যাভিত্তিক এই হিসাবে বাজেটে আদিবাসী মানুষের বৈষম্য ও বঞ্চনার মাত্রা দাঁড়ায় ৭৬.১২ শতাংশ। ৫ দশক ধরে জাতীয় বাজেটে জনসংখ্যার অনুপাতে আদিবাসীদের আদর্শ হিস্যার মাত্র ৫৭ শতাংশ দেওয়া হয়েছে আর বাকি ৪৩ শতাংশ দেওয়া হয়নি।

আবার যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তার ৬৩ শতাংশ হলো অনুন্নয়ন ব্যয় বরাদ্দ, যার সঙ্গে আদিবাসীদের জীবন–জীবিকা উন্নয়নের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। এ ক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বাজেটে তাদের বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রকৃত মাত্রা আসলে ৭৬.১২ শতাংশ নয়, বরং এই মাত্রাটি হবে ৩৭৬ শতাংশ।

উন্নয়ন বরাদ্দের ৩৭ হাজার ২৮০ কোটি টাকা হিসাবে নিলে দেখা যায়, তারা তাদের প্রাপ্য আদর্শ হিস্যার মাত্র ২১ শতাংশ পেয়েছে। বাকি ৭৯ শতাংশ তাদের দেওয়া হয়নি। জনসংখ্যা অনুপাতে জাতীয় বাজেটে উন্নয়ন বরাদ্দের নিরিখে আদিবাসীদের ‘বঞ্চনা-বৈষম্য-শোষণ মাত্রা’ যদি ৩৭৬ শতাংশ হয়, তাহলে তার সমপরিমাণ অর্থ দাঁড়াবে ১ লাখ ৪০ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা (২০২১-২২ এর বাজারমূল্যে)। এই পরিমাণ অর্থ আদিবাসীদের উন্নয়নে ব্যয় না করে লুটপাট করে খেয়ে ফেলেছে সেই ৫ শতাংশ মানুষ।

পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের জন্য জাতীয় বাজেট বরাদ্দ, ২০২৩, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অংশীদারত্ব ও বাজেট ভাবনা ২০২৪, বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বাজেট ভাবনা ২০২৫, অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, গত ৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে জাতীয় মাথাপিছু বরাদ্দ বাড়লেও আদিবাসীদের মাথাপিছু বরাদ্দ কমে এসেছে।

সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২৪-২৫) জাতীয় মাথাপিছু বরাদ্দ বেড়ে হয়েছে ৪৭,০৩২ টাকা আর আদিবাসীদের মাথাপিছু বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ৬,৭৫৩ টাকায়। আর বরাদ্দ ব্যবধান বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০,২৭৯ টাকায়।

ড. আবুল বারাকাতের প্রস্তাবিত মডেল অনুসারে, আদিবাসীদের প্রতি বাজেট বরাদ্দে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে আদিবাসীদেরকে বাজেটে মাথাপিছু যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে (২০২৪-২৫ অর্থবছরের হিসাবে ৬,৭৫৩ টাকা) তার সঙ্গে বরাদ্দ ব্যবধান পূরণ করার জন্য মাথাপিছু আরও ৪০,২৭৯ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেওয়া উচিত (মোট ৪৭,০৩২ টাকা)। এর মধ্য দিয়ে প্রথমেই আদিবাসীদের প্রতি যে বরাদ্দ বৈষম্য চলে এসেছে তা দূর করা যেতে পারে। তারপর পুঞ্জীভূত বরাদ্দ–বৈষম্য দূর করার জন্য ‘ইতিবাচক বৈষম্য হ্রাস নীতি’ প্রয়োগ করা প্রয়োজন আদিবাসীদের জন্য মাথাপিছু অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার মধ্য দিয়ে।

চলমান বাজেটে আদিবাসীদের জন্য যে বৈষম্য বা বাজেট বরাদ্দ ফাঁক (৪০,২৭৯ টাকা) রয়েছে, তার আনুমানিক তিন ভাগের এক ভাগ অংশের সমপরিমাণ অর্থ (১৩,৪২৬ টাকা) আদিবাসীদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ দিতে হবে। অর্থাৎ আদিবাসীদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ হওয়া উচিত ৬০,৪৫৮ টাকা। উল্লেখ্য, আদিবাসীরা যে বাজেটে শুধু তাদের জন্য প্রস্তাবিত অংশই পাওয়ার অধিকার রাখবে এমন নয়। তারা পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী এবং ভূমি সংস্কার উদ্দিষ্ট বাজেট প্রস্তাবের হিস্যাও পাবে। কারণ, তারা এই তিন বর্গেরও প্রতিনিধিত্বশীল মানুষ।

প্রতিবছরের মতো এ বছরও অধিকারভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি) মিলে জাতীয় বাজেটে প্রান্তিক মানুষের ওপর বাজেট বরাদ্দের স্বরূপ ও প্রস্তাবনা নিয়ে ‘বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে বাজেট ভাবনা ২০২৫’-শীর্ষক গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রিপোর্টের সারসংক্ষেপে আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে আশু পদক্ষেপ হিসেবে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ কমপক্ষে ১০ হাজার ১০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করার দাবি করা হয় (যার ৬০ শতাংশ সমতলের ও ৪০ শতাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য)। এ ছাড়া আদিবাসীদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ বিদ্যমান বরাদ্দের দ্বিগুণ করার প্রস্তাবও রয়েছে।

৫ দশকের বেশি সময় ধরে আদিবাসীরা বিভিন্নভাবে শোষণ–বঞ্চনার শিকার হয়ে এসেছে। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী বাস্তবতায় এখন সময় ও সুযোগ এসেছে এই শোষণ–বঞ্চনার অবসান ঘটানোর। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের উচিত নাগরিক সমাজের দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে আদিবাসীদের উন্নয়নে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা। তাহলেই শুধু শৃগালবৃত্তির রাজনৈতিক অর্থনীতি থেকে বের হয়ে এসে প্রান্তিক মানুষের প্রতি চলমান বৈষম্য বিলোপ করা সম্ভব হবে।

মিলিন্দ মারমা আদিবাসী অধিকারকর্মী

ই–মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ব জ ট বর দ দ ড ভ লপম ন ট ন বর দ দ র জনগ ষ ঠ র বর দ দ ব প রস ত ব বর দ দ ক জনস খ য ন নয়ন ব পর ম ণ র র জন ৫ দশক

এছাড়াও পড়ুন:

জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৫.৪ শতাংশে নামিয়ে আনল এমআইএফ

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। এর আগে গত এপ্রিলে সংস্থাটির পূর্বাভাস ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। 

আজ সোমবার ওয়াশিংটনে আইএমএফের নির্বাহী পর্যদ বাংলাদেশের জন্য চলমান ঋণ কর্মসূচির দুই কিস্তির ১৩৪ কোটি ডলার ছাড় করার অনুমোদনের সঙ্গে বাড়তি ৮০ কোটি ডলার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপর আইএমএফ এক বিবৃতিতে এ তথ্যের পাশাপাশি জিডিপির পূর্বাভাসসহ অর্থনীতির বেশকিছু উল্লেখ করেছে। 

এতে বলা হয়, আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে। এ দিকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্যও আইএমএফ প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ প্রাক্কলন করেছে। যা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ অনুমানের চেয়ে কম। একই সঙ্গে সংস্থাটি জানিয়েছে, আগামী অর্থবছর শেষে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।  

বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৪ সালের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর দ্রুত অন্তর্বর্তী সরাকর গঠন রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হয়। ফলে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে পর্যায়ক্রেম যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। তবে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, বাণিজ্যে ক্রমবর্ধমান বাধা এবং ব্যাংকিং খাতে চাপ বাড়ার কারণে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা আগের চেয়ে কমেছে। 

আইএমএফের ডিএমডি এবং পর্ষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ার নাইজেল ক্লার্ক বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় নীতি কার্যক্রম ও সংস্কার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ এবং বাজেটে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানায় আইএমএফ। 

তিনি আরও বলেন, কঠিন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত এবং বর্ধিত নিম্নমুখী ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচি সংক্রান্ত অগ্রগতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তোষজনক। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, ঝুঁকিগ্রস্থ মানুষকে রক্ষা করা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং পরিবেশবান্ধব টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য সংস্কার এজেন্ডা এগিয়ে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৫.৪ শতাংশে নামিয়ে আনল আইএমএফ
  • জিডিপি প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ৫.৪ শতাংশে নামিয়ে আনল এমআইএফ
  • সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা বাড়ল
  • সরকারি কর্মচারীদের ন্যূনতম বেতন বাড়ছে ১৫০০ টাকা
  • সরকারি কর্মচারীদের ন্যূনতম বিশেষ সুবিধা বাড়ছে
  • সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ল ১০ হাজার কোটি টাকা
  • কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে: অর্থ উপদেষ্টা
  • বাজেট অনুমোদনে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক চলছে
  • উপদেষ্টা পরিষদে আজ পাস হতে পারে বাজেট
  • তেমন পরিবর্তন ছাড়াই পাস হচ্ছে বাজেট