ঐক্য-অনৈক্যের বিভ্রান্তিতে লন্ডন বৈঠকের তাৎপর্য
Published: 12th, June 2025 GMT
দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস, কাদা ছোড়াছুড়ি, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার পতনের পর যে জাতীয় ঐক্যের আশা করা হচ্ছিল, তা এখন ভেঙে পড়ছে অংশীজনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর নেতৃত্বের বিভ্রান্তির কারণে। বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনগণ ভেবেছিল, রাজনৈতিক দলগুলো একতাবদ্ধ থেকে নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই জনপ্রত্যাশা আজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ‘এক দফা’ দাবির ভিত্তিতে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। সেই ঐক্য ছিল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল, এমনকি নির্দলীয় মানুষও অংশ নিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক, এই ঐক্য দ্রুতই ভেঙে যেতে থাকে প্রধানত বিএনপি এবং নবগঠিত এনসিপির মধ্যে মতপার্থক্যে। বিশেষত নির্বাচনের সময় ও সংস্কার পদ্ধতি নিয়ে দ্বন্দ্ব ঐক্যের ভিতকে সবচেয়ে নাজুক করে তোলে।
নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কাছ থেকে নাগরিক সমাজ বড় প্রত্যাশা করেছিল। প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাসের মাথায় ক্ষমতার মোহ, অভিজ্ঞতার অভাব এবং দুর্নীতির অভিযোগ দলটির জনপ্রিয়তায় ধস নামায়। পাঁচতারকা হোটেলে ইফতার পার্টি, বিলাসী জীবনযাপন এবং শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে শোডাউনের মতো ঘটনা সাধারণ মানুষের আস্থায় চিড় ধরায়। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের খবর, কোনো কোনো নেতার পদত্যাগ, কারও কারও বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ ইত্যাদি দলীয় কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
অন্যদিকে বিএনপি নিজেও নানা অভ্যন্তরীণ সংকটে রয়েছে। দলটির কিছু নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং তৃণমূল নেতাকর্মীর মধ্যে দ্বন্দ্বের অভিযোগ আছে। তবে নেতিবাচক প্রবণতার বিরুদ্ধে দলটি যে শৃঙ্খলাবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চায়– তার প্রমাণ হলো, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত। তা সত্ত্বেও বিএনপি ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণা কমেনি।
এমন পরিস্থিতিতে এনসিপির প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে সরকারের অস্পষ্টতা রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ানো ছাড়া কমায়নি। বিএনপি বরাবরই বলে আসছে– নির্বাচন হতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে। সরকারের পক্ষ থেকে সেটি জুনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এক প্রকার গোঁ ধরা হয়েছিল এবং সেটির জন্য কোনো স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেখানো হচ্ছিল না। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ ভাষণে যদিও এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের কথা বলা হয়েছে; সেটি বিএনপি মানেনি। প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে বৈরী ওই মাসে নির্বাচনের ঘোষণা আবার এনসিপি ও জামায়াত যেভাবে পত্রপাঠ মেনে নিয়েছে, সেটিও প্রশ্ন তৈরি করে।
দেশে রাজনৈতিক বিভ্রান্তির মধ্যেই বিলেতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হতে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম বলছে, এই বৈঠক হতে পারে দেশের রাজনীতির সম্ভাব্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’। যদি এখানে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিষয়ে ও সময় নিয়ে সমঝোতা হয়, তবে তা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।
শোনা যাচ্ছে, লন্ডন বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পারে নির্বাচনকাল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ভোটার তালিকা যাচাই, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যদি এই আলোচনা একটি যৌক্তিক সময়সীমা (হতে পারে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে) ও সংবিধানসম্মত কাঠামোর মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারে, তবে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনৈতিক দলগুলোর বৈরিতা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে।
তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, রাজনীতির এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব কেবল যদি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার মোহ বাদ দিয়ে জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশ বহুবার সংকট পেরিয়ে এসেছে। কারণ এই জাতির প্রাণশক্তি গভীরভাবে উদার গণতন্ত্রমুখী।
বিএনপির মতো একটি প্রধান ও প্রাচীন দল এবং এনসিপির মতো নতুন সংগঠন উভয়ই যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, তবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে।
মনে রাখতে হবে, আজকের বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে দ্বিধান্বিত সন্ধিক্ষণে। এই সন্ধিক্ষণে সঠিক সিদ্ধান্ত, দূরদৃষ্টি ও দায়বদ্ধ নেতৃত্বই পারে জাতিকে আবার একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং জনগণের রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিতে। প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত তাই শুধু এই মুহূর্তের জন্য নয়; ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্যও একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি তৈরি করতে পারে।
আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি ও মানবাধিকারকর্মী
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত গণত ন ত র ক সরক র র প দ বন দ ব ব এনপ র ব যবস থ ত র জন র জন য এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘‘বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি তোলা উচিত, চব্বিশ এবং আগের গণহত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন, ভোটাধিকার হরণ—এসবের জন্য যদি আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হতে পারে। তাহলে একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণ, নারকীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করতে হবে। তাদের কার্যক্রমও নিষিদ্ধ করতে হবে। একই অপরাধে দুই রকমের বিচার হতে পারে না।’’
শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের আয়োজনে ‘স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অপরিহার্য’ শীর্ষক মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আরো পড়ুন:
দ্রুত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করুন: দুলু
নৌকা ডুবেছে, শাপলা ভাসবে: এনসিপির তুষার
মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘‘যদি আওয়ামী লীগের মতো একই ধরনের অপরাধে জামায়াতের বিচার না হয়, তাহলে সেটা হবে ইতিহাসের প্রতি অবিচার।’’
তিনি বলেন, ‘‘আজকে জামায়াত তাদের পোশাক-চেহারা, আচরণ পাল্টে নতুন রূপে হাজির হয়েছে। তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈঠক করছে। কিন্তু, মূল উদ্দেশ্য বিএনপিকে আক্রমণ করা। এই বহুরূপীদের চেহারা জনগণ চিনে ফেলেছে।’’
বিএনপির এই নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে বিএনপিই একমাত্র শক্তি। অথচ এই শক্তিকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র চলছে। সরকার নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনের নামে প্রক্রিয়া চালালেও জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা কেড়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
আলাল আরো বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার মনে করেছে, দেশের সব অনাচারের মূলে সংবিধান। কিন্তু সমস্যার মূল সংবিধান নয়—ক্ষমতার অপব্যবহার ও জনগণের ভোটাধিকার হরণ। শেখ হাসিনার ১৬-১৭ বছরের শাসনে এই অন্যায়, নির্যাতন, দুর্নীতি ও অর্থ পাচারই হয়েছে সবচেয়ে বড় বাস্তবতা।’’
ঢাকা/রায়হান/রাজীব