দেশের রাজনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস, কাদা ছোড়াছুড়ি, ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যবস্থার পতনের পর যে জাতীয় ঐক্যের আশা করা হচ্ছিল, তা এখন ভেঙে পড়ছে অংশীজনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আর নেতৃত্বের বিভ্রান্তির কারণে। বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জনগণ ভেবেছিল, রাজনৈতিক দলগুলো একতাবদ্ধ থেকে নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা করবে। বাস্তবতা হচ্ছে, এই জনপ্রত্যাশা আজ ব্যাপকভাবে ব্যাহত।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ‘এক দফা’ দাবির ভিত্তিতে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। সেই ঐক্য ছিল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দল, এমনকি নির্দলীয় মানুষও অংশ নিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনক, এই ঐক্য দ্রুতই ভেঙে যেতে থাকে প্রধানত বিএনপি এবং নবগঠিত এনসিপির মধ্যে মতপার্থক্যে। বিশেষত নির্বাচনের সময় ও সংস্কার পদ্ধতি নিয়ে দ্বন্দ্ব ঐক্যের ভিতকে সবচেয়ে নাজুক করে তোলে।

নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কাছ থেকে নাগরিক সমাজ বড় প্রত্যাশা করেছিল। প্রতিষ্ঠার মাত্র তিন মাসের মাথায় ক্ষমতার মোহ, অভিজ্ঞতার অভাব এবং দুর্নীতির অভিযোগ দলটির জনপ্রিয়তায় ধস নামায়। পাঁচতারকা হোটেলে ইফতার পার্টি, বিলাসী জীবনযাপন এবং শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে শোডাউনের মতো ঘটনা সাধারণ মানুষের আস্থায় চিড় ধরায়। নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের খবর, কোনো কোনো নেতার পদত্যাগ, কারও কারও বিরুদ্ধে শোকজ নোটিশ ইত্যাদি দলীয় কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। 

অন্যদিকে বিএনপি নিজেও নানা অভ্যন্তরীণ সংকটে রয়েছে। দলটির কিছু নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং তৃণমূল নেতাকর্মীর মধ্যে দ্বন্দ্বের অভিযোগ আছে। তবে নেতিবাচক প্রবণতার বিরুদ্ধে দলটি যে শৃঙ্খলাবোধ প্রতিষ্ঠা করতে চায়– তার প্রমাণ হলো, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত। তা সত্ত্বেও বিএনপি ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণা কমেনি। 

এমন পরিস্থিতিতে এনসিপির প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের ‘অতিরিক্ত স্নেহ’ প্রশ্ন তৈরি করেছে। বর্তমানে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতি দৃশ্যমান অবহেলাও তাঁর সরকারের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। তিনি যখন পদত্যগের কথা বলেছিলেন, তখন বিএনপি নেতাদের সাক্ষাৎ চেয়ে অপেক্ষা করতে হলেও এনসিপি নেতারা যখন-তখন যমুনা ভবনে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। এ চিত্র জনমনে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে বৈকি। এমনকি ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ইশরাক হোসেনের ব্যাপারেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তথা সরকারের ঔদাসীন্য বিস্ময় জাগায়। নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশ এবং শপথ পড়ানোর বিরুদ্ধে রিট উচ্চ আদালতে নাকচ হয়ে যাওয়ার পরও ইশরাকের শপথ নিয়ে নির্লিপ্ততার কী কারণ থাকতে পারে?

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে সরকারের অস্পষ্টতা রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ানো ছাড়া কমায়নি। বিএনপি বরাবরই বলে আসছে– নির্বাচন হতে হবে ডিসেম্বরের মধ্যে। সরকারের পক্ষ থেকে সেটি জুনে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এক প্রকার গোঁ ধরা হয়েছিল এবং সেটির জন্য কোনো স্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেখানো হচ্ছিল না। জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার সর্বশেষ ভাষণে যদিও এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধের কথা বলা হয়েছে; সেটি বিএনপি মানেনি। প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক দিক থেকে বৈরী ওই মাসে নির্বাচনের ঘোষণা আবার এনসিপি ও জামায়াত যেভাবে পত্রপাঠ মেনে নিয়েছে, সেটিও প্রশ্ন তৈরি করে। 

দেশে রাজনৈতিক বিভ্রান্তির মধ্যেই বিলেতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক হতে যাচ্ছে। সংবাদমাধ্যম বলছে, এই বৈঠক হতে পারে দেশের রাজনীতির সম্ভাব্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’। যদি এখানে সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন বিষয়ে ও সময় নিয়ে সমঝোতা হয়, তবে তা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক।

শোনা যাচ্ছে, লন্ডন বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে পারে নির্বাচনকাল, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ভোটার তালিকা যাচাই, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা এবং নির্বাচনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যদি এই আলোচনা একটি যৌক্তিক সময়সীমা (হতে পারে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে) ও সংবিধানসম্মত কাঠামোর মধ্যে একটি জাতীয় নির্বাচনের রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারে, তবে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং আন্দোলন-সংগ্রাম, রাজনৈতিক দলগুলোর বৈরিতা কিছুটা হলেও প্রশমিত হবে।

তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, রাজনীতির এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব কেবল যদি রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার মোহ বাদ দিয়ে জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। বাংলাদেশ বহুবার সংকট পেরিয়ে এসেছে। কারণ এই জাতির প্রাণশক্তি গভীরভাবে উদার গণতন্ত্রমুখী।

বিএনপির মতো একটি প্রধান ও প্রাচীন দল এবং এনসিপির মতো নতুন সংগঠন উভয়ই যদি জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে, তবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলবে। 

মনে রাখতে হবে, আজকের বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে দ্বিধান্বিত সন্ধিক্ষণে। এই সন্ধিক্ষণে সঠিক সিদ্ধান্ত, দূরদৃষ্টি ও দায়বদ্ধ নেতৃত্বই পারে জাতিকে আবার একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক এবং জনগণের রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিতে। প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত তাই শুধু এই মুহূর্তের জন্য নয়; ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমের জন্যও একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি তৈরি করতে পারে।

আহমেদ স্বপন মাহমুদ: কবি ও মানবাধিকারকর্মী

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত গণত ন ত র ক সরক র র প দ বন দ ব ব এনপ র ব যবস থ ত র জন র জন য এনস প

এছাড়াও পড়ুন:

‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান

ইদানীং কিছু ভদ্রলোক ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি সুযোগ বুঝে সরাসরিও বলে ফেলছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনেই দেশ ভালো চলছিল। দু–একজন এ-ও বলছেন, গত ৪০ বছরে এখনকার মতো খারাপ অবস্থা নাকি তাঁরা দেখেননি।

এই ‘মহামানবদের’ কথা মান্য করলে প্রশ্ন এসেই যায়, কী লাভ হলো গণ–অভ্যুত্থান করে, এত জীবন বিসর্জন দিয়ে, এত রক্ত ঝরিয়ে?

আওয়ামী লীগের শত্রুরা উত্তর দিক: সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে হাসিনা পতনের এক দফা দাবিতে রূপান্তরের কী প্রয়োজন ছিল? গণবিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেড় দশকে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী ব্যবস্থাকে ভেঙে খান খান করে ফেলার কী এমন প্রয়োজন ছিল?

হাসিনা-পরবর্তী এই ‘ভগ্ন হৃদয়ের’ যুগে ভারতীয় শিল্পী কবির সুমনের সে গানটি ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই...শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই’ শুনি আর ভাবি, ২০২৪-এর ‘ডামি’ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাকে আজীবন ক্ষমতায় দেখতে চাওয়া অলিগার্কদের কী যে আকুতি ছিল!

মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে নেত্রীর পতন দেখে হয়তো সেদিন তাঁরা শুনেছেন কিংবা গেয়েছেন অন্য কোনো গান। হতে পারে আরেক ভারতীয় শিল্পী হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া সেই গান তাঁরা গেয়েছিলেন, ‘চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...আমার বলার কিছু ছিল না।’

আক্ষেপ কেন, কমরেড, জীবন নিয়ে পালিয়ে তো তিনি নিরাপদেই আছেন দিল্লিতে!

তবু ‘সে কি ভোলা যায়, তুমি আমারই ছিলে’ হে বাংলাদেশ সাম্রাজ্য! সত্যিই তো তাঁর এবং তাঁদের একচেটিয়া অধিকার ছিল যেভাবে খুশি যত বেশি ক্ষমতা, অর্থ, প্রতিপত্তি ভোগের।

একটি অভিজাত গোষ্ঠীকে (অলিগার্কি) হাসিনা-প্রদত্ত সেই লাভজনক স্থিতাবস্থা হারিয়ে কীভাবে চুপ করে বসে থাকবে এর ‘ভাগ্যবান’ সদস্যরা! নতুন রাজনৈতিক বিনিয়োগও কিছু দরকার হবে যদি ভবিষ্যৎ মুনাফার আশা করতে হয়।

টাকাওয়ালাদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে বা জালিয়াতির মাধ্যমে সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব উপহার, তাঁর চামচাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং দলীয় অনুগতদের মিডিয়ার লাইসেন্স প্রদানসহ কত ধরনের দান-দক্ষিণার ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ‘ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়ানোর’ দাবিদার বর্তমানে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগপ্রধান হাসিনার সরকার।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে কর্ণফুলী টানেল, পদ্মা সেতু থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল রোড, ডজন ডজন নতুন ব্যাংক থেকে শত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি—এ রকম বড় বড় ব্যয়বহুল প্রকল্প গ্রহণে তাঁর কোনো তুলনাই হয় না।

একটু–আধটু দুর্নীতি হলেও অন্তত মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন তো দেখাচ্ছিলেন তাঁর সভাসদরা। এই ধরুন, লাখো কোটি টাকার ব্যাংকঋণ জালিয়াতি, খেলাপি, দলীয় নেতা মাস্তানদের হাজার হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও সম্পদ লুণ্ঠন, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার ইত্যাদি বিষয় দেড় দশকের স্থিতিশীলতার তুলনায় এমনকি বাড়াবাড়ি!

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

জনগণকে কষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিকল্প ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন জনদরদি হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালের ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত, ২০১৮ সালে নৈশকালীন ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচন করে হাসিনা তাঁর বাবা শেখ মুজিবের তৈরি একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার নতুন মডেল দাঁড় করান পৃথিবীর সামনে।

যাঁরা এই আওয়ামী শাসনের ‘স্থিতিশীলতা’ নস্যাৎ করতে চেয়েছে তাদের ‘ঠ্যাং ভেঙে’ দিতে একটুও দ্বিধা করেনি হাসিনা সরকার। সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টাকারীদের ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়া হয়েছে গুম, খুন, সহিংসতা, জঙ্গিনাটক, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, প্রতিবাদ দমন ও বাক্‌স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে। সে জন্য আপনারা তাঁকে ফ্যাসিবাদী বলার সাহসও পাননি তখন।

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে হাজারো তরুণ ও সাধারণ মানুষ নিহত (শহীদ) হওয়ার দায় নিতে চাননি হাসিনা। উল্টো তাঁর দাবি, ৫ আগস্ট তাঁকে মারতেই লক্ষ জনতা গণভবন অভিমুখে যাত্রা করেছিল।

আরও পড়ুন‘আমি কী অপরাধ করেছি’— সবাই জানেন শিরোনামটা...৩০ জুলাই ২০২৫

আরও রক্তপাত এড়াতেই নাকি তাঁর নিজের লোকদের মায়া ছেড়ে ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করে ভারতে পাড়ি জমান শেখ হাসিনা।

তাই আজ তাঁর ফেরার অপার ইচ্ছা যেন স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি গানের মতোই, ‘তোমাদের পাশে এসে বিপদের সাথি হতে আজকের চেষ্টা আমার।’

যাদের ‘এতিম’ করে রেখে উনি চলে গেলেন, তাদের কারও কারও বক্রোক্তি এ রকম: এক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের পর বহুত শখ করে তো ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে; তাঁর সরকার এখন পর্যন্ত কী করতে পেরেছে? নির্বাচন, সংস্কার, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি, অর্থনীতি জোরদার—কোনটি পেরেছে?

যেন এত সব বিষয় নিয়ে জনমনে কোনো ক্ষোভই ছিল না হাসিনার আমলে। এটি সেই বিস্মৃত অতীত, যেটি নিয়ে কল্পিত সংগীত রচিত হয়: ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা স্বৈরশাসকদের টিকে থাকার দুটি মূলমন্ত্রেই ব্যর্থ২২ আগস্ট ২০২৪

তার মানে, তাঁর শাসনকালই জাতির জন্য ছিল আদর্শ। এটা প্রমাণ করার এক অদৃশ্য প্রচেষ্টা রয়েছে আজ এখানে, আমাদের চারপাশে, আশপাশে।

সত্য, মিথ্যা মিশিয়ে এমন দাবি করেন কারা এবং কেন—সেটা আমাদের একটু বোঝা দরকার।

হাসিনার চামচা ও সুবিধাভোগী, তাঁর ঘরানার অসৎ বুদ্ধিজীবী, তাঁর হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতি নিয়ে নির্বিকার নেতা-কর্মী-সমর্থক, বর্তমান আমলে বিশেষ কিছু না পেয়ে প্রবলভাবে হতাশ কতিপয় সুশীল অথবা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বোধ ব্যক্তির পক্ষেই ফ্যাসিবাদী শাসনামলকে উত্তম বলা সম্ভব।

এতে হাসিনার লোকদের বড় লাভ হতে পারে দায় স্বীকার না করে বা ক্ষমা না চেয়েই তাঁদের হাত ও নামসমূহকে দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের রক্তের দাগ থেকে মুক্ত করা।

এ প্রচেষ্টা ঘটে যাওয়া সত্যকে অস্বীকার, শহীদদের আত্মত্যাগ অগ্রাহ্য, আহত ব্যক্তিদের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং মজলুমদের অনুভূতির সঙ্গে মশকরা ছাড়া আর কিছুই না।

এগুলোই আবার জুলাই বিপ্লবের পক্ষের শক্তির বয়ান তৈরিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে।

আরও পড়ুনহাসিনা শাসনের উন্নয়নের বানোয়াট গল্প০৩ অক্টোবর ২০২৪

পরিবর্তনের পক্ষে জনগণের প্রবল আকাঙ্ক্ষার কোনো কমতি ছিল না এবং হত্যা-দুর্নীতিসহ ফ্যাসিবাদী কর্মকাণ্ডের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে কমবেশি সংস্কারের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক চিন্তা, গণতান্ত্রিক ভাবনা, কিংবা আমলাতান্ত্রিক কর্মসূচিকে জনমত তৈরির জন্য সেভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। একটা একটা করে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উত্তম বিকল্প জনগণের সামনে আনলে গণমানুষকে নতুন ধারণা ও আশাবাদ উপহার দেওয়া যেত।

কয়েকটি মডেল নির্বাচন দিয়ে, তরুণদের পরিবেশ রক্ষার মতো সামাজিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত করে, রাজনৈতিক দলসমূহকে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি প্রতিরোধে অংশীদার বানিয়ে এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ঠিকঠাক করে, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করে হাসিনার কুশাসনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করা যেত।

ধারণা করি, জনগণের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগগুলো সম্পর্কে জনসম্পৃক্ততার অভাব হাসিনার উপকারভোগীদের নিজস্ব গান গাওয়ার পরিসর দিয়েছে।

ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট রাজনৈতিক দল এবং ২০২৪-এর আন্দোলনে পুরোভাগে থাকা ছাত্র ও অন্য শক্তিগুলো পরস্পরের মধ্যে লজ্জাজনক কুতর্কে জড়িয়ে পড়ায় গণ–অভ্যুত্থান ও পরিবর্তনের এজেন্ডা এবং উপযোগী বয়ান যথেষ্ট মার খেয়েছে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণও কিছুটা বিভ্রান্ত ও হতাশ হয়েছে।

বাংলাদেশিদের বর্তমান হতাশা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হওয়াটাই কাম্য ছিল পরাজিত শক্তির। হাসিনা বিহনে আওয়ামী উপকারভোগী বা অন্ধ সমর্থকেরা গোপালগঞ্জ বা অন্য কোনো অঞ্চলে নিরালায় বসে যেন গুনগুন করে গাইছে গগন হরকরার গান, ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে...।’ তারা বুঝতে পারছে না জাতির জীবনে শেখ হাসিনা এমন এক জুলুমশাহি শাসকের নাম ও ফ্যাসিবাদের প্রতিমূর্তি; যার শাসন পুরো দেশকে বানিয়ে ফেলেছিল ‘জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ’।

নিজেদের বাইরে জনগণের অন্য যেকোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতার ভাগ দিতে না চাওয়া সেই ফ্যাসিবাদী ধারায় ছেদ টেনেছে জুলাই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার গঠন, যেটিও আশা করি বাংলাদেশের শেষ সরকার নয়।

বিদায় নেওয়া ফ্যাসিবাদ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে যেকোনো দেশেই অনেকটা পুরোনো দিনের গান। এই গান অবশ্যই স্মৃতিজাগানিয়া কিন্তু চলমান বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভবিষ্যতে আবারও ফ্যাসিবাদকে সহ্য করবে, এমন প্রজন্ম এ দেশে সেকেলে এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তরুণেরা এবং অভিজ্ঞ বিবেকবানেরা এখন অজানা এক নতুন বাংলাদেশের অপেক্ষায়।

ফলে ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’ গান বাদ দিয়ে হাসিনার মানসপুত্রদের এখন নিরালা নিঝুম ও যথাযথ ভাবগম্ভীর পরিবেশে বসে মুদ্রিতনেত্রে মন্দ্রসপ্তক কণ্ঠে ভক্তিভরে গাওয়া উচিত, ‘মা, আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা... ।’

খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক

*মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদে আমাদের যে সম্মতি সেটি আইনের ঊর্ধ্বে: সালাহউদ্দিন
  • সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ ও মাদকমুক্ত বন্দর গড়তে চাই : সাখাওয়াত
  • বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রূপগঞ্জে লিফলেট বিতরণ 
  • জুলাই আন্দোলনকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়াবেন না: টুকু
  • সবাই অপেক্ষা করছে একটা নির্বাচনের জন্য
  • ‘হাসিনার আমলই ভালো ছিল’—এটা কোন ঘরানার গান
  • সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে দেশে ফ্যাসিবাদ, উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিতে পারে: তারেক রহমান
  • সরকারের একটি অংশ অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে: তারেক রহমান
  • ট্রাম্পের প্রতি মার্কিন জনগণের সমর্থন ৪০ শতাংশে ঠেকেছে
  • জাতিসংঘে সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশ-পাকিস্তান বৈঠক, ফিলিস্তিন ইস্যুতে উদ্বেগ