গৃহকর্মে শিশুশ্রম: এই প্রথার অবসান হবে কবে
Published: 12th, June 2025 GMT
মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র খারিজ নির্মিত হয়েছে রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস অবলম্বনে। এক শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে এক কিশোর গৃহকর্মী শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য রান্নাঘরে কয়লা জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলেটি কার্বন মনোক্সাইডে দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। ঘটনাটি পরিবারটিকে মানসিক সংকটে ফেলে। মৃত ছেলেটির বাবা এতটাই প্রান্তিক যে সন্তানের মৃত্যুর বিচার চাওয়ার সাহস বা সামর্থ্য তাঁর নেই। আজও বহু শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোষী ব্যক্তিদের বিচার হয় না।
জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২-এর ফল অনুযায়ী, দেশে এখন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক আছে। ২০ লাখ ১০ হাজার শিশুশ্রমিক পারিশ্রমিক পায় না। যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের গড় আয় মাসে ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা।
বাংলাদেশের জাতীয় শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী কাজে নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স ১৪ বছর। তবে ১২ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা হালকা কাজে নিয়োজিত হতে পারবে, যদি তাদের শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত না হয়। তবে হালকা কাজের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়নি।
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় এমন ৪৩ ধরনের কাজকে সরকার শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৮ বছরের নিচে কাউকে এসব কাজে যুক্ত করা যাবে না। বর্তমানে শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার জন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। গৃহকর্মে শিশুশ্রম এখনো শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় নেই। বাংলাদেশের ঝালাই (ওয়েল্ডিং), সড়ক ও পরিবহন, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুদের নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে জাতিসংঘের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে একের পর এক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু সেসব বাস্তবায়নে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন, মার্চ ২০২৪–এর তথ্য অনুযায়ী শহরের বাসাবাড়িতে স্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা কর্মীদের ৮০ শতাংশ শিশু। ঘর মোছা, বাসন ও কাপড়চোপড় পরিষ্কার করা, রান্না, পরিবারের শিশুদের যত্ন নেওয়াসহ একটা বাসার প্রায় সব কাজ তারা করে। বিনিময়ে পায় ন্যূনতম খাবার ও থাকার জায়গা। অনেক সময় গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী তাদের ঘরে বন্ধ করে কর্মক্ষেত্রে যান। কার্যত তারা বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য হয়।
২০২৪–এর অক্টোবরে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) জরিপ পরিচালনা করে। জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার, ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ গৃহকর্মী অত্যধিক কাজের চাপে থাকে। প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, নির্যাতনের শিকার শিশুদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ শারীরিক আঘাত, ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ মারধর, ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ বকাঝকা এবং ১ দশমিক ৭ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
ওপরের এই বাস্তবতার পরও যদি গৃহকর্মে শিশুশ্রম ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ না হয়, তাহলে ‘ঝুঁকি’র সংজ্ঞা কী?
শ্রম আইন ২০০৬-এ ‘হালকা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত এবং এই বিষয়ক শাস্তি (যদি আইন মানা না হয়) সুস্পষ্ট করা দরকার। গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগ দেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের আওতায় আনতে হবে। কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে গৃহকর্মে শিশুশ্রমসহ সব ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে শিশুদের সরিয়ে আনা সম্ভব। যেমন পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে শিশুদের অংশগ্রহণ, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করার কুফল সম্পর্কে মা-বাবা ও নিয়োগদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রভৃতি। শিশুরা যদি নিরাপদ কোনো কাজে নিয়োজিত থাকে, তবে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও জীবনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সহায়তা করা উচিত, যাতে তারা পরবর্তী সময়ে যথোপযুক্ত কাজ পেতে পারে।
বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে একের পর এক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু সেসব বাস্তবায়নে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। এই অবস্থা বদলানো দরকার। শিশুশ্রম নিরসনের কথা উঠলেই আমরা দারিদ্র্যের দোহাই দিই। কিন্তু অন্য সময় আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে গর্ব করি। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, চরম দারিদ্র্য থাকলেও একটা এলাকায় শিশুশ্রমের অবসান ঘটানো সম্ভব, যদি সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা না থাকে।
বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ গৃহকর্মে শিশুশ্রমকে স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করেন। অনেকের মনোভাব এমন যে দরিদ্র পরিবারের একটা শিশুকে নিজের বাসায় থাকতে ও খেতে দিয়ে তার উপকার করেছেন। কারোর যদি কোনো শিশুকে সহায়তা করার সদিচ্ছা থাকে, তাহলে তার মা-বাবাকে আর্থিক সহায়তা করে শিশুটির পড়াশোনা চালিয়ে নিতে দিন। তাকে নিজের বাড়ির সব কাজের ভার দিচ্ছেন কেন? এটা আসলে সস্তায় শ্রম কেনার সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
এখন আমরা দাসপ্রথা বা সতীদাহের কথা চিন্তা করে শিউরে উঠি। মানুষের জন্য অমর্যাদাকর এই ধরনের চর্চা একসময় সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজের কিছু প্রথাও কি একই রকমের অগ্রহণযোগ্য নয়? যখন আমাদের সন্তানেরা খেলছে বা স্কুলে যাচ্ছে, তখন তাদের বয়সী অন্য শিশুরা আমাদের ঘরে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে। এটা কি বর্তমান যুগের দাসপ্রথা নয়?
আমরা সমাজে অনেক বদল আনার কথা বলছি। চারদিকেই ‘সংস্কার’ নিয়ে আলোচনা। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। এই অমানবিক প্রথাকে স্বাভাবিক ভাবা বন্ধ করতে হবে।
লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ হকর ম পর ব র র জন য দশম ক
এছাড়াও পড়ুন:
অন্তর্বর্তী সরকার না চাইলে ‘মব সন্ত্রাসের’ ঘটনাগুলো ঘটতে পারত না: বাম গণতান্ত্রিক জোট
গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে যে ‘মব’ সন্ত্রাসের শুরু হয়েছিল, সেটা এখনো চলছে এবং নগ্ন রূপ নিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা। অন্তর্বর্তী সরকার না চাইলে এমন ঘটনাগুলো ঘটতে পারত না বলেও মন্তব্য করেছেন তাঁরা। জোটের নেতারা বলেছেন, মব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাব এমন যে খারাপ কিছু তো করছে না।
আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা এ কথা বলেন। মব সন্ত্রাস ও মাজার-খানকায় হামলা বন্ধসহ সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যথাসময়ে নির্বাচনের দাবিতে এ বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল।
সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বাম জোটের কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের পর যে মব শুরু হয়েছিল, সেই মব এখনো দূর হয়নি। বরং নগ্ন রূপ নিয়েছে।...তাহলে ইউনূস সাহেব (প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস) তখন কী করলেন?’
সরকার না চাইলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে না মন্তব্য করে রুহিন হোসেন বলেন, মব নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা আকারে-ইঙ্গিতে যা বলেন, তাতে ভাবটা এ রকম যে খারাপ কিছু করছে না। অন্তর্বর্তী সরকার এসব ঘটনার দায় এড়াতে পারবে না।
দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংস্কারের নামে শ্রমিক–কৃষক–মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষা করছেন না, কিন্তু সংবিধানের চার মূলনীতি পরিবর্তন করতে চান। অবিলম্বে নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
‘মব’ সন্ত্রাস ও মাজার-খানকায় হামলা বন্ধসহ সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার করে যথাসময়ে নির্বাচনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতা–কর্মীরা। আজ সোমবার সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে