মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র খারিজ নির্মিত হয়েছে রমাপদ চৌধুরীর উপন্যাস অবলম্বনে। এক শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারে এক কিশোর গৃহকর্মী শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য রান্নাঘরে কয়লা জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলেটি কার্বন মনোক্সাইডে দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। ঘটনাটি পরিবারটিকে মানসিক সংকটে ফেলে। মৃত ছেলেটির বাবা এতটাই প্রান্তিক যে সন্তানের মৃত্যুর বিচার চাওয়ার সাহস বা সামর্থ্য তাঁর নেই। আজও বহু শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দোষী ব্যক্তিদের বিচার হয় না।

জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ ২০২২-এর ফল অনুযায়ী, দেশে এখন ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন শিশুশ্রমিক আছে। ২০ লাখ ১০ হাজার শিশুশ্রমিক পারিশ্রমিক পায় না। যারা পারিশ্রমিক পায়, তাদের গড় আয় মাসে ৬ হাজার ৬৭৫ টাকা।

বাংলাদেশের জাতীয় শ্রম আইন-২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী কাজে নিয়োগের সর্বনিম্ন বয়স ১৪ বছর। তবে ১২ থেকে ১৪ বছরের শিশুরা হালকা কাজে নিয়োজিত হতে পারবে, যদি তাদের শিক্ষা ও বেড়ে ওঠা বাধাগ্রস্ত না হয়। তবে হালকা কাজের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়নি।

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয় এমন ৪৩ ধরনের কাজকে সরকার শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৮ বছরের নিচে কাউকে এসব কাজে যুক্ত করা যাবে না। বর্তমানে শিশুশ্রমিকদের মধ্যে ১০ লাখ ৭০ হাজার জন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। গৃহকর্মে শিশুশ্রম এখনো শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকায় নেই। বাংলাদেশের ঝালাই (ওয়েল্ডিং), সড়ক ও পরিবহন, যন্ত্রাংশ নির্মাণ কারখানা, তামাক কারখানা, ব্যাটারি ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ খাতে শিশুদের নিয়োজিত থাকার ব্যাপারে জাতিসংঘের শিশু অধিকারবিষয়ক কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে একের পর এক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু সেসব বাস্তবায়নে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়

বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক অ্যাসোসিয়েশন, মার্চ ২০২৪–এর তথ্য অনুযায়ী শহরের বাসাবাড়িতে স্থায়ী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা কর্মীদের ৮০ শতাংশ শিশু। ঘর মোছা, বাসন ও কাপড়চোপড় পরিষ্কার করা, রান্না, পরিবারের শিশুদের যত্ন নেওয়াসহ একটা বাসার প্রায় সব কাজ তারা করে। বিনিময়ে পায় ন্যূনতম খাবার ও থাকার জায়গা। অনেক সময় গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী তাদের ঘরে বন্ধ করে কর্মক্ষেত্রে যান। কার্যত তারা বন্দিজীবন কাটাতে বাধ্য হয়।

২০২৪–এর অক্টোবরে অ্যাকশন ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) জরিপ পরিচালনা করে। জরিপ অনুযায়ী, রাজধানীতে গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার, ৩১ দশমিক ৪৫ শতাংশ গৃহকর্মী অত্যধিক কাজের চাপে থাকে। প্রতিবেদনে আরও উঠে আসে, নির্যাতনের শিকার শিশুদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ শারীরিক আঘাত, ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ মারধর, ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ বকাঝকা এবং ১ দশমিক ৭ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

ওপরের এই বাস্তবতার পরও যদি গৃহকর্মে শিশুশ্রম ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ না হয়, তাহলে ‘ঝুঁকি’র সংজ্ঞা কী?

শ্রম আইন ২০০৬-এ ‘হালকা শ্রম’ সংজ্ঞায়িত এবং এই বিষয়ক শাস্তি (যদি আইন মানা না হয়) সুস্পষ্ট করা দরকার। গৃহকর্মে শিশুদের নিয়োগ দেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের আওতায় আনতে হবে। কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে গৃহকর্মে শিশুশ্রমসহ সব ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে শিশুদের সরিয়ে আনা সম্ভব। যেমন পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে শিশুদের অংশগ্রহণ, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত করার কুফল সম্পর্কে মা-বাবা ও নিয়োগদাতাদের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রভৃতি। শিশুরা যদি নিরাপদ কোনো কাজে নিয়োজিত থাকে, তবে তাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও জীবনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সহায়তা করা উচিত, যাতে তারা পরবর্তী সময়ে যথোপযুক্ত কাজ পেতে পারে।

বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিরসনে একের পর এক কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু সেসব বাস্তবায়নে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার অভাবে অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। এই অবস্থা বদলানো দরকার। শিশুশ্রম নিরসনের কথা উঠলেই আমরা দারিদ্র্যের দোহাই দিই। কিন্তু অন্য সময় আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি নিয়ে গর্ব করি। কী অদ্ভুত বৈপরীত্য! কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, চরম দারিদ্র্য থাকলেও একটা এলাকায় শিশুশ্রমের অবসান ঘটানো সম্ভব, যদি সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতা না থাকে।

বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ গৃহকর্মে শিশুশ্রমকে স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করেন। অনেকের মনোভাব এমন যে দরিদ্র পরিবারের একটা শিশুকে নিজের বাসায় থাকতে ও খেতে দিয়ে তার উপকার করেছেন। কারোর যদি কোনো শিশুকে সহায়তা করার সদিচ্ছা থাকে, তাহলে তার মা-বাবাকে আর্থিক সহায়তা করে শিশুটির পড়াশোনা চালিয়ে নিতে দিন। তাকে নিজের বাড়ির সব কাজের ভার দিচ্ছেন কেন? এটা আসলে সস্তায় শ্রম কেনার সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।

এখন আমরা দাসপ্রথা বা সতীদাহের কথা চিন্তা করে শিউরে উঠি। মানুষের জন্য অমর্যাদাকর এই ধরনের চর্চা একসময় সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কিন্তু বর্তমান সমাজের কিছু প্রথাও কি একই রকমের অগ্রহণযোগ্য নয়? যখন আমাদের সন্তানেরা খেলছে বা স্কুলে যাচ্ছে, তখন তাদের বয়সী অন্য শিশুরা আমাদের ঘরে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছে। এটা কি বর্তমান যুগের দাসপ্রথা নয়?

আমরা সমাজে অনেক বদল আনার কথা বলছি। চারদিকেই ‘সংস্কার’ নিয়ে আলোচনা। গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুশ্রমিকদের নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। এই অমানবিক প্রথাকে স্বাভাবিক ভাবা বন্ধ করতে হবে।

লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গ হকর ম পর ব র র জন য দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

কমিশনের ‘অগ্রহণযোগ্য’ সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে: মির্জা ফখরুল

সনদ বাস্তবায়নে ঐক্যমত কমিশনের সুপারিশ ‘অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে এই সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অবস্থান তুলে ধরেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি দেওয়ার জন্য জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। সেখানে যে সকল বিষয়ে ভিন্নমত বা নোট ডিসেন্টসহ ঐকমত্য হয়েছে, তার উল্লেখ না রেখে দীর্ঘ আলোচনায় যেসব প্রসঙ্গ আলোচনা আসেনি, তা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের অন্য সকল সুপারিশ অগ্রহণযোগ্য বিধায় আমরা একমত হতে পারছি না।’’

“আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, এই সকল সুপারিশ কেবল জাতিকে বিভক্ত করবে, ঐক্যের বদলে অনৈক্য সৃষ্টি করবে।’’

মনগড়া যে কোনো সংস্কার প্রস্তাব গ্রহণ করলে জাতীয় জীবনে দীর্ঘ মেয়াদে অকল্যাণ ডেকে নিয়ে আসতে পারে বলেও এ সময় হুঁশিয়ার করে দেন মীর্জা ফখরুল।

নির্বাচনের আগে গণভোট অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক :

জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিকে অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টা… সেক্ষেত্রে (সংসদ) নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে প্রস্তাবিত গণভোট অনুষ্ঠান সম্ভব নয়।’’

তিনি বলেন, ‘‘সময় স্বল্পতা, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিপুল অঙ্কের ব্যয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ ব্যাপক লোকবল নিয়োগ এবং একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মত বিশাল আয়োজনের বিবেচনায় নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠান অপ্রয়োজনীয়, অযৌক্তিক এবং অবিবেচনাপ্রসূত। একই আয়োজনে এবং একই ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট অনুষ্ঠান করা বাঞ্ছনীয়।’’

‘‘আমরা আশা করি, জাতির প্রত্যাশা পূরণ এবং দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও ২০২৪ সালে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের সকল শহীদদের রক্তের অঙ্গীকার অনুযায়ী এবং যারা দীর্ঘ এই সংগ্রামে ফ্যাসিবাদী শাসন আমলে গুম, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, মামলা, হামলার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠন করতে পারব। প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা,’’ বলেন বিএনপির এই শীর্ষনেতা।

জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা সকলের কাম্য জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জাতির অভিপ্রায় অনুযায়ী সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠিত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হবে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা। জাতীয় সংসদকে প্রকৃত অর্থে জাতীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে পরিণত করা।’’

“আমরা আন্তরিকভাবেই চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ার সাফল্য কামনা করি। কিন্তু একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে দেশ ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমাদের অবস্থান প্রকাশে আমরা দায়বদ্ধ,’’ যোগ করেন মির্জা ফখরুল।  

উল্লেখ্য জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশমালা গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাংবিধানিক আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে সেখানে।

সুপারিশে বলা হয়েছে, ওই আদেশ জারির পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যথোপযুক্ত সময়ে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট হবে। তবে কখন সেই ভোট হবে তা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির প্রবল মতবিরোধ রয়েছে।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/তারা  

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কমিশনের ‘অগ্রহণযোগ্য’ সুপারিশ জাতিকে বিভক্ত করবে: মির্জা ফখরুল