চীনের উত্থান ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাস্তবতা
Published: 12th, June 2025 GMT
মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ সম্ভাবনা ক্ষীণ; কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার ত্রিসংযোগস্থলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা জটিল করে তুলছে, ঠিক সেই সময়ে যখন চীন কৌশলগতভাবে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।
চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মিজোরামের রাজধানী আইজলে একটি চমকপ্রদ রাজনৈতিক ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমানা ঘেঁষা এই রাজ্যে মিয়ানমারভিত্তিক দুটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী একীভূত হওয়ার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা।
চিনল্যান্ড কাউন্সিল (সিসি) কয়েক বছর ধরে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের চিন রাজ্যে সক্রিয় ছিল। ২০২১ সালে ইন্টেরিম চিন ন্যাশনাল কনসালটেটিভ কাউন্সিল (আইসিএনসিসি) গঠিত হয়। এটি গঠিত হয় মূলত সিসি-এর কিছু ভিন্নমতাবলম্বী অংশের উদ্যোগে। উভয় গোষ্ঠীই ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে– গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলকারী মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে– লড়াই করেছে। মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী লালদুহোমা গণমাধ্যমকে জানান, চিনের জনগণের সংগ্রামে সহায়তা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য থেকেই তিনি এই একত্রীকরণে ভূমিকা রাখেন। একীভূত সংগঠনের নাম রাখা হয়– চিন ন্যাশনাল কাউন্সিল (সিএনসি)।
ভারতের মিজোরামে মিজো, পার্শ্ববর্তী মণিপুরের কুকি, মিয়ানমারের চিন ও তার আশপাশের রাজ্যের চিন জনগণ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বম সম্প্রদায় একই জাতিগোষ্ঠীর অংশ, যাদের সম্মিলিতভাবে ‘জো জনগোষ্ঠী’ (মিজো-কুকি-চিন সম্প্রদায়ের সমষ্টিগত নাম) বলা হয়। আন্তর্জাতিক ও প্রাদেশিক সীমারেখা দ্বারা বিভক্ত হলেও তাদের মধ্যে একটি গভীর জাতিগত বন্ধন বজায় আছে। তবে একটি ভারতীয় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহীদের ঐক্য গড়ার পদক্ষেপ নেওয়া নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারত মিয়ানমার নিয়ে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করে এসেছে। ভারত জান্তা সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও, কৌশলগত ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখতে সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছে। এ ক্ষেত্রে দিল্লিতে গণতান্ত্রিক বিরোধী পক্ষের সদস্যদের একটি সেমিনারে আমন্ত্রণ জানানোর ঘটনাও উল্লেখযোগ্য।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের মেইতেই ও নাগা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর একটি অংশ মণিপুর ও মিয়ানমারভিত্তিক কুকি-চিন বিদ্রোহীদের সহায়তা করছে। এই কুকি-চিন বিদ্রোহীরা আক্রমণ চালাচ্ছে মিয়ানমারভিত্তিক মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর ওপর। মেইতেই ও নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো আবার জান্তা সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে চলছে।
লালদুহোমার দলের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের জো জনগণের প্রতি সমর্থন প্রকাশের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে– ভারত কি জো জাতিগোষ্ঠীভুক্ত চিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করছে, যে বিদ্রোহীরা বর্তমানে মিয়ানমার-ভারত সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে?
এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করেন। অভ্যুত্থানের পর তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। এ সাক্ষাৎ জান্তা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বার্তা দেয়। মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতা ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোর জন্য এক কূটনৈতিক সংকটে পরিণত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের পরিস্থিতি : ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতপন্থি শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হওয়া এবং তাতে ভারতের কৌশলগত পরিবেশ আরও জটিল হয়ে ওঠা।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত স্পষ্টভাবে হাসিনাপন্থি অবস্থান নিয়েছে। তিনি ও তাঁর দলের শীর্ষ নেতারা এখন ভারতের আশ্রয়ে রয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূস এখন চীনঘেঁষা নীতি নিয়েছেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে তাঁর চার দিনের চীন সফরসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে তা স্পষ্ট। ঢাকা থেকে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউনূস সরকারের ওপর মার্কিন প্রভাবও বাড়ছে।
ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি সফল করতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক জরুরি। কারণ এই নীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের সংযোগ জোরদারে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি এটি সীমান্তবর্তী মিয়ানমার ও বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক হতে পারে। তবে বাংলাদেশের ভেতরে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পুনঃসংগঠনের ইঙ্গিত আসামে ও পশ্চিমবঙ্গে উদ্বেগ তৈরি করছে।
সতর্ক কৌশলের প্রয়োজন
ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এক জটিল ভূকৌশলগত এলাকা। যেখানে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়াবলির সীমানা প্রায়ই একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার মিলনস্থলে অবস্থিত এই অঞ্চল। অঞ্চলটি জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময়, পরিবেশ ও ভূপ্রকৃতিগতভাবে সংবেদনশীল। রাজনৈতিকভাবেও জটিল। ফলে এখানে নিরাপত্তা, কৌশলগত ও মানবিক সমস্যা সব ঘনীভূত।
ভারতের পশ্চিম সীমান্তে মূল উদ্বেগ পাকিস্তান ও পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসবাদ। উত্তর-পূর্ব সীমান্তে খেলোয়াড় অনেক। তাদের স্বার্থও পরস্পরবিরোধী। বহু জাতিগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের স্বার্থ-সংঘাতে এই অঞ্চল প্রায় স্থায়ীভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। ভারতে সম্ভবত আর কোনো অঞ্চলেই অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
সীমান্তবর্তী জাতিগোষ্ঠীর উপস্থিতি, তাদের জাতিগত আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের মিশ্রণ এখানে জটিল আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতা তৈরি করেছে। এই অঞ্চল সংঘাতপ্রবণ হয়ে উঠেছে, যার প্রভাব পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে এখানে একটিও ভুল সিদ্ধান্ত বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান হয়। পরে দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই অনিশ্চয়তার নতুন অধ্যায়। গণতন্ত্রপন্থিরা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) গঠন করে। এর সশস্ত্র শাখা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ)। এটি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। দেশটি জড়িয়ে পড়ে গৃহযুদ্ধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে ভারতের সীমান্তবর্তী অনেক অংশের নিয়ন্ত্রণ হারায়। মণিপুর ও মিজোরামের সীমানায় অবস্থিত চিন রাজ্যে সিএনএ, সিডিএফ ও কেএনএর মতো জো জনগোষ্ঠীর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা শুরু করে জান্তা বাহিনী। এসব গোষ্ঠী পিডিএফের মিত্র হিসেবে নিজেদের জো জনগণের প্রতিনিধি বলে দাবি করে থাকে।
চিন রাজ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার পর এর প্রভাব পড়ে ভারতে। মিজোরাম ও মণিপুরে শরণার্থী প্রবাহ শুরু হয়। মিজোরামে, যেখানে জো-জনগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের উষ্ণভাবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু মণিপুরে জো ও নাগা দুটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে, শরণার্থী আগমনের ফলে রাজ্য জনসংখ্যার ভারসাম্য হারাচ্ছে। মেইতেই সম্প্রদায় অনুপ্রবেশকারী বহিষ্কারের দাবি তোলায় জো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের উত্তেজনা বাড়ে।
২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই ও জো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ভয়াবহ জাতিগত সংঘাত শুরু হয়। পরবর্তী দুই বছরে প্রায় ৩০০ জনের প্রাণহানি ঘটে। এতে মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলোর পুনরুত্থানের আশঙ্কা তৈরি হয়। এই গোষ্ঠীকে এক সময় ভারত দমন করেছিল।
ভারতের মিয়ানমার সীমান্তে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। অনুপ্রবেশ, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চলাচল ঠেকাতে ভারত ‘ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম’-এর পরিসর সীমিত করেছে। ‘প্রটেকটেড এরিয়া রেজিম’ পুনর্বহাল করেছে। সীমান্তে কাঁটাতার নির্মাণ শুরু করেছে। তবে এই পদক্ষেপগুলো জো ও নাগা জনগণের ঐতিহ্যবাহী আন্তঃসীমান্ত সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে।
ইম্ফলভিত্তিক এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব সিদ্ধান্তে মেইতেইদের মধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঠেকানো নিয়ে আশ্বাস তৈরি হলেও, জো ও নাগা জনগণের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। তা ছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের বহু মানুষ অনানুষ্ঠানিক সীমান্ত বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল।
বিদ্রোহীদের মোকাবিলা
২০২৫ সালের মে মাস নাগাদ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল অব নাগালিমের (এনএসসিএন-আইএম) অন্যতম নেতা ইকাটো চিশি সিউ মিয়ানমারে চলে যান। যেখানে তিনি এইচ এস রামসান ও অ্যাবসালম রামান নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থি একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীতে যোগ দেন বলে জানা যায়। এই পদক্ষেপ নাগা শান্তি আলোচনাকে বিপদের মুখে ফেলে। একই সঙ্গে নাগা সশস্ত্র সংগ্রামের পুনরুত্থান নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়।
এনএসসিএন-আইএম ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী বিদ্রোহী গোষ্ঠী– যা নাগাল্যান্ডকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এরা ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারের নাগাল্যান্ড সীমান্তবর্তী এলাকায় সক্রিয়। ভারত থেকে স্বাধীনতার দাবিতে গঠিত হলেও, তারা ১৯৯৭ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রয়েছে। বর্তমানে তারা বৃহত্তর নাগাল্যান্ড দাবি করছে, যেখানে আসাম, মণিপুর ও অরুণাচল প্রদেশের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত। তবে ওই তিন রাজ্যই এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
২০২৪ সালে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) এক আদালতে দাবি করে, এনএসসিএন-আইএমের মিয়ানমারভিত্তিক চীন-মিয়ানমার মডিউল নিষিদ্ধ মেইতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কাংলেই ইয়াউল কানবা লুপ (কেওয়াইকেএল) এবং পিপলস লিবারেশন আর্মিকে (পিএলএ) সহায়তা করে ভারতে অনুপ্রবেশ করাতে। যেন তারা জো জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালাতে পারে। কেওয়াইকেএল এবং পিএলএ মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকাভিত্তিক সাতটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম। গোষ্ঠীগুলো ভারত থেকে আলাদা হতে চায়। মিয়ানমার ও বাংলাদেশে তাদের ঘাঁটি রয়েছে।
এনআইএর এই অভিযোগে নাগা ও মেইতেই উভয় গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এনএসসিএন-আইএমের দাবি, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী কুকিদের পক্ষ নিচ্ছে। এরপর ভারত সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিছুটা উন্নত হয়। তবে সিউর পদক্ষেপ আবারও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির বিরোধিতাকারী এনএসসিএন-কে (ইয়ুং অং) এখনও মিয়ানমারের নাগা স্বশাসিত অঞ্চলে সক্রিয় রয়েছে। এই অঞ্চল ভারতের নাগাল্যান্ড ও চীনের ইউনান প্রদেশের সীমান্তঘেঁষা।
মিয়ানমারের সাগাইং, চিন ও রাখাইন রাজ্যে ভারতের একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যারা প্রায়ই মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করে। জো জনগোষ্ঠীর মধ্যে কুকি ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) চিন ও সাগাইংয়ে সক্রিয়। এরা জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্স আর্মিকে (কেআইএ) সহযোগিতা করে। কেআইএর সঙ্গে এনএসসিএনের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। কেএনএ ও কেআইএ উভয়েরই রাখাইনভিত্তিক আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে।
জোমি রেভলিউশনারি আর্মি (জেডআরএ) চিন ও সাগাইং অঞ্চল থেকে পরিচালিত হয় এবং মিয়ানমারের চিন ন্যাশনাল আর্মির (সিএনএ) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। সিএনএর সঙ্গে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্টের (এমএনএফ) ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ২০২৩ সালে লালদুহোমার জোরাম পিপলস মুভমেন্টের (জেডপিএম) কাছে ক্ষমতা হারায় এমএনএফ। এমএনএফেরও আরাকান আর্মির সঙ্গে পুরোনো সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে জোমি রেভলিউশনারি অর্গানাইজেশন (জেডআরও), যা চিন রাজ্যে সক্রিয়, তারা মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে সহযোগিতা করে। মণিপুরি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিএলএ সাগাইংয়ে সক্রিয় এবং জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী উলফা-ইন্ডিপেন্ডেন্টেরও (উলফা-আই) মিয়ানমারে ঘাঁটি রয়েছে। তারা বিদ্রোহবিরোধী কর্মকাণ্ডে জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করে বলে জানা যায়।
ইম্ফলভিত্তিক সাংবাদিক প্রদীপ ফানজৌবমের মতে, মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ভারতীয় বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর পুনর্গঠনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। অথচ সরকারের অবস্থান এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। ‘আমরা নতুন নতুন সমীকরণ ও পুনর্গঠনের খবর পাচ্ছি,’ বলেন তিনি। ‘সরকার কী অনুমোদন করবে আর কী করবে না– তা এখনই ঠিক করতে হবে। অথচ এখনও আমরা সেই পুরোনো কৌশলই দেখছি। এক গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে আরেক গোষ্ঠীকে দমন করার খেলা।’
একসময় ভারত ও মিয়ানমার যৌথ সামরিক অভিযান চালিয়ে এনএসসিএন-কে, উলফা-আই, পিএলএ, জেডআরএ এবং কেএনএর ঘাঁটি ধ্বংস করেছিল। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ায় এ ধরনের যৌথ অভিযানের সুযোগ কম। পাশাপাশি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের শীতলতাও সীমান্তবর্তী বিদ্রোহীদের দমন করতে বাংলাদেশের সহযোগিতার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে তুলেছে।
চীনা চ্যালেঞ্জ
ভারত-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছুটা উষ্ণতা এলেও সীমান্ত পরিস্থিতি এখনও উত্তেজনাপূর্ণ। উভয় দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) পাশে সামরিক ও নাগরিক অবকাঠামো নির্মাণ করছে। চীন সম্প্রতি অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে ইয়ারলুং সাংপো নদীর ওপর ‘বিশ্বের বৃহত্তম বাঁধ’ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। ভারত আশঙ্কা করছে, এই বাঁধ ব্রহ্মপুত্র নদের পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হতে পারে।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারে চীনের পদক্ষেপগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। চীন বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানি ব্যবহারসহ নানা কৌশলগত অবকাঠামো প্রকল্পে জড়িত হতে চাইছে। সেই সঙ্গে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার চাইছে। মিয়ানমারে চীনের উপস্থিতি এতটাই বেড়েছে যে গণতন্ত্রপন্থিরা জান্তা সরকারকে ‘চীনা ক্রীড়নক’ বলেও আখ্যায়িত করছে। কিছুটা পশ্চিমা সমর্থনও পাচ্ছে তারা।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (সিএমইসি) এখনও একটি মূল অগ্রাধিকার। কিয়াওকফিউ গভীর সমুদ্রবন্দরসহ অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে চীনের ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার আরও সহজ হচ্ছে।
মিয়ানমার সরকার একটি আইন পাস করেছে– পাবলিক সিকিউরিটি সার্ভিসেস ল। এর মাধ্যমে মিয়ানমারে চীনা ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় চীনের নিরাপত্তা বাহিনী সক্রিয় হতে পারবে। এমনকি দেশটি চীনা নববর্ষকে জাতীয় ছুটি হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে।
সম্ভবত এরই প্রতিদানস্বরূপ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ৯ মে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে মিয়ানমারের জান্তা নেতা সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ বোঝায়, চীন ও রাশিয়া তাদের পাশে রয়েছে। ভারতের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, এই সাক্ষাৎ রাশিয়ারও চীনের সঙ্গে মিয়ানমার ইস্যুতে অবস্থান সাযুজ্যের ইঙ্গিত দেয়। চীন ও রাশিয়া দুটোই মিয়ানমার জান্তার অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ।
এর আগে চীন মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেসি অ্যালায়েন্স আর্মিকে (এমএনসিএএ) শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের লাশিও শহরটি জান্তার কাছে হস্তান্তরের জন্য রাজি করায়। এই শহর চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চীন বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কাছে অনুরোধ করেছে, তারা যেন সিএমইসির রুটের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো থেকে দূরে থাকে। তবে জান্তা সরকারের প্রতি চীনের স্পষ্ট সমর্থন বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রপন্থি গোষ্ঠীগুলোর কাছে চীনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে পারে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, মিয়ানমারের কিছু অংশে চীনবিরোধী মনোভাব বাড়ছে ক্রমশ। v
সৌজন্যে: আউটলুক ম্যাগাজিন, ১ জুন ইস্যু
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব চ ছ ন নত ব দ সশস ত র গ ষ ঠ স ম ন তবর ত ২০২১ স ল র জ ত গত ক উন স ল জ ত গত ব মণ প র ও র জন ত ক সহয গ ত পদক ষ প সরক র র জনগ ষ ঠ ক শলগত জনগণ র প রব শ ন প রব র জন য অবস থ ক এনএ গঠন র র ওপর স গঠন প এলএ সমর থ
এছাড়াও পড়ুন:
জনগণের স্বার্থেই শীত মৌসুমে নির্বাচন হওয়া উচিত
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে অনুষ্ঠিত হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার এত দিন ২০২৫-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২৬-এর জুন পর্যন্ত একটি লম্বা সময়ের যেকোনো সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এমনটা বলে আসছিল। নির্দিষ্ট করে কোনো তারিখ না দেওয়ার কারণে অনেকের মধ্যে দ্বিধা ও সংশয় ছিলই নির্বাচনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কতটুকু আন্তরিক, তা নিয়ে।
জনপরিসরে এমন কথা আলোচিত হচ্ছিল যে কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার একটি সম্ভাবনা আছে। শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ঈদের আগের বক্তৃতায় এটি স্পষ্ট করেছেন যে ২০২৬-এর এপ্রিলের প্রথম ভাগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর এই সরকার যখন গঠিত হয়েছিল, তখন বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষের সব শক্তির সমর্থন ছিলই। আওয়ামী লীগ বাদে প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর সমর্থনের কারণে গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সহিংসতা কম হয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর অধ্যাপক ইউনূস বারবার বলেছেন যে নির্বাচনের তারিখ নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্তের ওপর।
রাজনৈতিক দলগুলো যখনই চাইবে, তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবেন, এমন কথাও তিনি বেশ কয়েকবারই বলেছেন। বিএনপিসহ প্রায় সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল হয় ডিসেম্বর, না হয় শীত মৌসুমে; অর্থাৎ ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে তাদের অবস্থানের কথা জানায়। এর মধ্যে জামায়াত নির্বাচনের সময় নিয়ে বেশ কয়েকবার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। বিভিন্ন সময় তারা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানায়।
প্রধান উপদেষ্টা যখন বারবার রাজনৈতিক দলগুলো যখন চাইবে নির্বাচন হবে, এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ও সংখ্যা বিবেচনায় শীত মৌসুমে নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই যৌক্তিক ছিল।
কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, কোনো কারণ ব্যাখ্যা না করেই এনসিপি ও জামায়াত বাদে সব রাজনৈতিক দলের মতামত উপেক্ষা করে এপ্রিলে নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট করা হলো। বাংলাদেশে এপ্রিলে নির্বাচন হওয়ার অসুবিধা নানা ধরনের এবং তা কোনোভাবেই শুধু রাজনৈতিক নয়, বাংলাদেশের গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ায় এপ্রিলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিও রয়েছে। আমাদের স্বভাবগত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ব্যক্তিগত ও দলীয় ইগো ও তর্কে জেতার অদম্য ইচ্ছাকে সরিয়ে রেখে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা করে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, শীত মৌসুমে নির্বাচন ঘোষণা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা। সুসম্পর্ক তৈরি করলে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিষয়ে আলোচনা বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতেও অন্তর্বর্তী সরকারের সুবিধা হবে। এই সরকারেরও বেশির ভাগ অভিজ্ঞ অংশীদার ও কমিশনের বিশেষজ্ঞরাও তা-ই চান বলেই জানি।জনসংখ্যা, আবহাওয়া, নির্বাচনপদ্ধতির দিক থেকে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের মিল রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ায় জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রচণ্ড গরমে কাজ করতে গিয়ে ৫০০-এর বেশি মানুষ মারা যান। সেদিন দেশটিতে তাপমাত্রা ছিলই ৩০ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুরুতে ২৭০ জনের কথা বলা হলেও কয়েক দিনের মধ্যে এই সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। মৃত্যুর এ সংখ্যা শুধু নির্বাচন আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। ভোটারদের মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে দেখানো হয়েছে। এ ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় হাজারো মানুষকে।
আরও পড়ুন নির্বাচন এপ্রিলে কি আসলেই হবে৪ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশে এপ্রিলে তাপমাত্রা ছুঁয়ে ফেলে ৩৫ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর যদি হিটওয়েভ থাকে, তাহলে তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যায় ৪০ ডিগ্রি। চিকিৎসকেরা বলছেন, ৩৫ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এক ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ালে হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি হয়। বিশেষ করে ৫০ বছরের বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি ভয়াবহ।
নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে ও ভোটের দিনে যদি প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ হয় এবং জনগণের মৃত্যু হয়, সেই দায়ভার কে নেবেন? প্রধান উপদেষ্টার প্রচার বিভাগের এক কর্মকর্তা সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছেন যে এপ্রিলের প্রথম ভাগে নাকি তাপমাত্রা সহনীয় থাকবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে অস্থিতিশীল আবহাওয়ার মাস এপ্রিল, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহ, বজ্রসহ বৃষ্টি, কালবৈশাখীর মতো প্রচণ্ড ঝড় হয় এই মাসে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়টি হয়েছিল ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাসে। সেই দুর্যোগে দেড় লাখ মানুষ মারা যান। কোনো আবহাওয়াবিদ আগামী বছরের এপ্রিল মাসকে সহনীয় ও নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত মনে করেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক।
এ ছাড়া এপ্রিলে বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যায়। ভোটের দিন সাধারণ ছুটি থাকলেও গরমের কারণে সারা দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে না। মফস্সল ও গ্রামাঞ্চলে দিনে যেমন লোডশেডিং হবে, তেমনি সন্ধ্যার পরও বিদ্যুৎ না থাকার শঙ্কা রয়েছে। এতে ভোট গণনা কার্যক্রম ভেঙে পড়তে পারে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত চলবে রমজান মাস। এমন ধর্মীয় সময়সূচির মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর জোরালো প্রচারণা চালানো মোটেও সম্ভব হবে না। এমনকি ভোটাররাও নির্বাচনের যে উৎসবের আমেজ, সেটাতে যুক্ত হতে পারবেন না।
ঈদুল ফিতরে বেশির ভাগ মানুষই বাড়ি যাবেন। সেখান থেকে কাজে ফিরে আবার অল্প কদিনের মধ্যেই ভোট দিতে বাড়ি ফিরতে হবে। যাঁরা নিম্নবিত্ত, অল্প বেতনের চাকরি করেন, তাঁরা অর্থ খরচ করে আবার গ্রামে ফিরে ভোট দিতে উৎসাহিত হবেন না। ভোটার উপস্থিতিও কমে যাবে।
নির্বাচনের ব্যাকআপ প্ল্যানও রাখতে হয়; অর্থাৎ প্রাকৃতিক কারণে বা অন্য কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে ভোট আয়োজন করা না গেলে, সেটি দ্রুততম সময়ে করার পরিকল্পনা করতে হয়। কিন্তু এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন ভেস্তে গেলে পরবর্তী সময়ে ভালো সময় নেই।
৯ এপ্রিল থেকে ১৯ মে পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষা। এরপর ঈদুল আজহা। ১১ জুন থেকে এইচএসসি পরীক্ষা। এরপর শুরু হবে বর্ষা, বাড়বে বন্যার আশঙ্কা। শুধু তা-ই নয়, খরচের বিষয়ও রয়েছে। একটি নির্বাচন আয়োজন মানে হাজার কোটি টাকা খরচ। প্রচণ্ড হিটওয়েভ, ঘূর্ণিঝড় কিংবা কালবৈশাখীর কারণে নির্বাচন নতুন করে আয়োজন করতে হলে খরচ হবে দুবার। সেই বিলাসিতার সুযোগ নেই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে।
এসব যুক্তির বিপরীতে কেন শীত মৌসুমের বদলে গ্রীষ্মে নির্বাচন করতে হবে, তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে গ্রহণযোগ্য যুক্তির অভাব রয়েছে; বরং ‘৫ বছর চাই’-এর মতো বিরাজনীতিকরণ ও রাজনীতিবিমুখতার প্রচার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে চালাচ্ছেন। প্রধান উপদেষ্টা ও তাঁর প্রচার বিভাগ সংস্কার ও বিচারের কথা বলে সময় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
এই যুক্তির অসারতা দুটি। এক, এপ্রিলের সঙ্গে শীত মৌসুমের পার্থক্য মাত্র দুই মাসের। মাত্র দুই মাসে বড় ধরনের কোনো বিচারিক অগ্রগতি এবং সংস্কার করা সম্ভব নয়। দুই, সংস্কার নিয়ে সরকারের কাজ এত দিন পর্যন্ত কেবল ‘রেটরিক’ বা ‘কথায়’ সীমাবদ্ধ রয়েছে। তাই মাত্র কয়েক মাসে বড় ধরনের অগ্রগতি না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত, শীত মৌসুমে নির্বাচন ঘোষণা করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলা। সুসম্পর্ক তৈরি করলে গঠিত কমিশনগুলোর সুপারিশ বিষয়ে আলোচনা বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতেও অন্তর্বর্তী সরকারের সুবিধা হবে। এই সরকারেরও বেশির ভাগ অভিজ্ঞ অংশীদার ও কমিশনের বিশেষজ্ঞরাও তা-ই চান বলেই জানি।
প্রধান উপদেষ্টার উচিত সরকারের মধ্যে ‘নৈরাজ্যপ্রিয়’ অংশকে গুরুত্ব না দিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনা করা। আর এই ঐকমত্যের পথে সফল যাত্রা ও গণতান্ত্রিক গ্রহণযোগ্য ক্ষমতার পরিবর্তন করতে পারে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত শীত মৌসুমেই।
● ড. সাইমুম পারভেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষ সহকারী
* মতামত লেখকের নিজস্ব