নওগাঁর বদলগাছীর প্রত্যন্ত এক গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। বাবা আফজাল হোসেন পুরোদস্তুর একজন প্রান্তিক কৃষক। আমার জীবনেরও বড় একটি সময় বাবার সঙ্গে কৃষি কাজ করে কেটেছে। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত মাঠে কাজ করতাম, এরপর বাড়ি ফিরে রেডি হয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফিরেও বাবাকে সাহায্য করতে মাঠে যেতাম। গরু না থাকলে বাবা আর ছেলে মিলে মই দেওয়া, মাটি কেটে উল্টে দেওয়া—সবই করতাম। ধানখেতে নিড়ানি দিতে দিতে বাবার কাছ থেকে তাঁর ছেলেবেলার গল্প শুনতাম। কাজ করতে করতে যখন স্কুলের সময় হয়ে যেত, তখন তিনি নিজেই বলতেন, ‘যাও স্কুলে। আমি জীবনে যে সুযোগটি পাইনি, তোমরা সেটা হারিয়ে ফেল না।’

বাবার বয়স যখন ১০ কি ১১ বছর, তখন তাঁর বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর তাঁর কাঁধে চাপে সংসারের ভার। তাই স্কুলের আঙিনায় আর কোনো দিন পা মারাতে পারেননি। তবে সব সময় মনে হতো আমার পড়াশোনা না জানা বাবা চিন্তা ও চেতনায় কোনো শিক্ষিত মানুষের চেয়ে কম নন।

বাবাকে বুঝেছি বলেই তাঁর কথা কখনোই ফেলতাম না। একদিন এসএসসি পাস করলাম। স্কুলের সর্বোচ্চ ফলাফল আমার ঝুড়িতে থাকলেও কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সংকট দেখা দিল। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। ভর্তির টাকা থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে যে খরচ হবে তার সংকুলান করা কঠিন। গ্রামের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি বাবাকে বুঝিয়েছিলেন, চাকরির পাশাপাশি জমিজমা থাকার পরও তাঁরা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হিমশিম খাচ্ছেন। আমার বাবার না আছে চাকরি, না তেমন জমিজমা। তাহলে কীভাবে তিনি আমাকে কলেজে পড়াবেন। এর চেয়ে ভালো হয়, রাজশাহীতে আমাকে প্যারামেডিকসে ভর্তি করালে দুই-তিন বছরে পাস করে গ্রামে ওষুধের দোকান দিয়ে দিব্যি চলতে পারব।

আমরা তিন ভাই-বোন কাছাকাছি বয়সী। সবাইকে পড়াশোনা করাতে হিমশিম খাচ্ছেন মা-বাবা। অনেকের পরামর্শে একদিন আমাকে রাজশাহী শহরে নিয়ে গেলেন। বাবা–ছেলে সেবারই প্রথম রাজশাহী শহর দেখলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া গ্রামের একজনের ছাত্রাবাসে গিয়ে উঠলাম। কথা ছিল পরের দিন কলেজ থেকে ফরম তুলে ভর্তির প্রস্তুতি নেব। কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যায় রাজশাহী প্যারামেডিকেল কলেজ ঘুরে আসার পর কিছুতেই আমার মন সায় দিল না। আমি কিছুটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবাকে বললাম, ‘আমি এখানে ভর্তি হব না, সাধারণ কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হব।’

আরও পড়ুনফুটবলার মোনেম মুন্নাকে নিয়ে তাঁর ছেলের লেখা, ‘বাবা ফুটবল মাঠে ডিফেন্ডার পজিশনে খেলতেন বলে তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করতাম’৬ ঘণ্টা আগে

বাবার সীমাবদ্ধতা আমি জানতাম, কিন্তু পড়াশোনার খরচ জোগানো যে কঠিন, তা বাবা বুঝতে দিতে চাইতেন না। আমার শক্ত অবস্থান দেখে পরদিন বাসায় ফেরার পথে বাবা আমাকে একটি গল্প শোনালেন, ‘কেউ যদি ঢাকায় যেতে চায়, তাহলে তাকে হয় বাসস্ট্যান্ড অথবা ট্রেনস্টেশনে যেতে হবে। এখন তুমি যদি সেখানে পৌঁছাতে না পারো, তাহলে কীভাবে যাত্রা করবে?’

রাজশাহী থেকে নওগাঁয় পৌঁছার পর তিনি সাহস করে পকেট থেকে ২০ টাকা বের করে দিয়ে বললেন, ‘যাও কলেজের ভর্তি ফরম কিনি নিয়ে আসো। তোমার পড়াশোনার জন্য বসতভিটা বিক্রি করতে আমার সমস্যা হবে না।’

এই যে সাহসটুকু নিয়ে বাবা আমাকে এগিয়ে দিয়েছেন, সেই এগিয়ে যাওয়া আর কেউ থামাতে পারেনি। আমার পড়াশোনার জন্য বাবা খেতের জমি বিক্রি করেছেন, গাছ বিক্রি করেছেন, হালের গরু বিক্রি করেছেন, ঋণ নিয়েছেন, তবু আমাকে হারতে দেননি। আর হারতে দেননি বলেই কৃষক বাবার সন্তান পরিচয় দিতে সব সময় গর্ববোধ করেছি। সেই গর্ব নিয়েই এইচএসসি পাস করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। অক্ষরজ্ঞানহীন বাবাটাকে জীবনে না পেলে হয়তো সায়েন্টিস্টই হতে পারতাম না!

বাবার আদর্শে আমার ছোট ভাই-বোনও বড় হয়েছে। আমার মতো ভাইটাও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছে আর বোনটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর। আমাদের জীবনের যাবতীয় অর্জনে মিশে আছে আমার কৃষক বাবার আদর্শ।

আরও পড়ুনবাবা হারানো সেই আরিফুলের লেখা, ‘আব্বার সঙ্গে শেষ স্মৃতিটা কোনো দিন ভুলতে পারব না’৯ ঘণ্টা আগে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

উজানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মারাত্মক সংকটে তিস্তা নদী

আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে উজানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে তিস্তা নদী মারাত্মক সংকটে পড়েছে। আর প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প নিয়েও কেউ খোলামেলা কথা বলতে চাইছেন না।

রোববার রাজধানীর প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) ‘সংকটে তিস্তা নদী: সমাধানের পথ কী?’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) যৌথভাবে এ মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জমান। প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের সঙ্গে কোনো পানিবণ্টন চুক্তি না থাকায় এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম না মেনে উজানে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ফলে তিস্তা নদী মারাত্মক সংকটে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে আর বর্ষাকালে নিয়ন্ত্রণহীন পানিনির্গমনের ফলে বাংলাদেশ অংশে বন্যা ও ভাঙনের ঝুঁকি বাড়ছে।

মতবিনিময় সভায় বিশেষজ্ঞরা তিস্তা সমস্যার সমাধানে ভারতের সঙ্গে গঠনমূলক সম্পৃক্ততা, আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগ এবং প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের মতামত গ্রহণের ওপর জোর দেন। তাঁরা তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও পুনর্মূল্যায়নের দাবি জানান।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সরকারের কাছে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কোনো তথ্য নেই। বিগত বছরগুলোতে উন্নয়নের নামে দেশের নদীগুলোকে সংকুচিত করা হয়েছে। আমরা আর সংকুচিত করার উন্নয়ন চাই না। নদীকে নদীর মতোই রাখতে হবে।’

আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, দেশের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। যেসব প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি, সেসব প্রকল্প গ্রহণের আগে অবশ্যই জনগণের মতামত নিতে হবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব সামর্থ্য অনুযায়ী প্রকল্প নেওয়া উচিত। নদীকে রক্ষা করতে হবে কিন্তু তাকে খালে পরিণত করে নয়। এই প্রকল্প পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

বাপার প্রতিষ্ঠাতা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাপা কখনো উন্নয়নবিরোধী নয়। আমরাও চাই দেশের উন্নয়ন হোক। কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে দেশের প্রাণপ্রকৃতি, পরিবেশ ও নদীকে ঠিক রেখে। তিস্তা প্রকল্প নিয়ে কেউ খোলামেলা কথা বলতে চাইছেন না। সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে সংবেদনশীল হওয়ায় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।’

বাপার সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদারের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পরিবেশবিদ, গবেষক ও তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা অংশ নেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ