দিনাজপুরে ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেলের কার্যালয়ের পাশেই ডাক বিভাগের মেইল প্রসেসিং সেন্টার (এমপিসি)। এখানে নিরাপদ ডাক বাছাইসহ এই দপ্তরের কাজ সহজ করার জন্য কেনা হয়েছে ৩৩ ধরনের যন্ত্রপাতি। কিন্তু মানুষের আগ্রহ না থাকায় একদিকে চলছে অচলাবস্থা, অন্যদিকে নষ্ট হচ্ছে যন্ত্রপাতিগুলো।

এমপিসিটি নির্মাণ করা হয়েছে দিনাজপুর শহরের পুলহাট এলাকায়। প্রায় ৪০ শতক জায়গার ওপর ৫ হাজার বর্গফুটের সুদৃশ্য ভবনটিতে এখন সুনসান নীরবতা। নেই কর্মচাঞ্চল্য। সেন্টারটির চারপাশে অটো রাইস মিল হওয়ায় ওই এলাকায় সাধারণ মানুষের যাতায়াতও অপেক্ষাকৃত কম।

এমপিসি সূত্রে জানা যায়, ডাক বিভাগের কাজ ত্বরান্বিত করা, নিরাপদ ডাক বাছাই, সর্বোপরি দেশের শহর ও পল্লি অঞ্চলে দ্রুত ডাকসেবা পৌঁছানোই এমপিসির কাজ। নির্দিষ্ট কয়েকটি জেলার চিঠিপত্র-পার্সেল (ডাক বিভাগের ভাষায় মেইল–আর্টিকেল) ডাক বিভাগের পরিবহনযোগে এমপিসিতে এসে জমা হয়। সেখানে বাছাই শেষে পোস্টম্যান সেবাগ্রহীতার কাছে পৌঁছে দেন। আর অন্যান্য এলাকার চিঠিপত্র ও মালামাল চলে যায় পরবর্তী সেন্টারে।

দিনাজপুরের এমপিসিটি চালু হয় ২০২২ সালের শুরুর দিকে। এখানেও ৩৩ ধরনের ৭১১টি যন্ত্রপাতি ও আসবাব সরবরাহ করা হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রটিকে রেকর্ড ও সটিং (বাছাই) দুটি শাখায় ভাগ করা হয়েছে। অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী উভয় শাখায় পদ রয়েছে ১৬ জন। তবে দায়িত্ব পালন করছেন ৫ জন। তাঁদের মধ্যে রেকর্ড শাখায় একজন। মেইল অপারেটর পদে দুজন এবং মেইল ক্যারিয়ার পদে দুজন। নৈশপ্রহরী ও ঝাড়ুদার নেই। তবে মেইল ক্যারিয়ার পদে থাকা একজন নৈশপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে একজনকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হয়েছে, যিনি মেশিন অপারেটিং ও বৈদ্যুতিক বিষয়গুলো দেখাশোনা করেন।

গত ১২ মে দিনাজপুর এমপিসি ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, ভবনের সামনে লাগোয়া বিশাল আয়তনের বারান্দা। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল আর্চওয়ে গেট মেটাল ডিটেক্টর (নিরাপত্তা গেট)। পাশেই বন্ধ দেখা গেল স্ক্যানার মেশিনও। একে একে রাখা চিঠিপত্র বাছাইসংক্রান্ত কাজে ব্যবহারযোগ্য নানা আসবাব ও সরঞ্জাম। এর মধ্যে প্ল্যাটফর্ম ট্রলি, হ্যান্ড ট্রলি, ফোল্ডিং ট্রলি, ফ্রগ লিফট, কলাপসিবল ট্রলি, ওজন মাপার যন্ত্র। কয়েক রকমের র‌্যাক। তবে এসব আসবাবের এক-তৃতীয়াংশই অব্যবহৃত। এমনও কয়েকটি যন্ত্রপাতি ও আসবাব রয়েছে, যেগুলোর মোড়ক পর্যন্ত খোলা হয়নি।

ভবনের ভেতরে বাঁ প্রান্তে করা হয়েছে চিলিং সেন্টার বা কোল্ড স্টোরেজ। ডাক বিভাগের মাধ্যমে যদি কেউ খাদ্যপণ্য দূরবর্তী স্থানে পাঠাতে চান, তাঁর জন্যই এই চিলিং সেন্টার। কার্যক্রম চালুর প্রায় সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও চিলিং সেন্টারটি চালু হয়নি। পুরো ভবনে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র রয়েছে, যার সব কটিই নষ্ট। ভবনের বাইরে নির্দিষ্ট ঘরে রয়েছে জেনারেটর, টিনশেড ভবনের ছাদে আছে সোলার সিস্টেমও। গত বছর টিন ফুটো হয়ে পানিও পড়েছিল। পরে তা মেরামতও করা হয়েছে।

প্রায় এক মাস পর গতকাল সোমবার সকালে আবারও এমপিসি ভবনটি ঘুরে প্রায় একই রকমের দৃশ্য দেখা গেল। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত মেকানিক জাহিদুল ইসলাম চিলিং সেন্টারের সুইচ বাটন অন–অফ করে দেখছেন। রেকর্ড শাখায় সাব রেকর্ড সুপারভাইজার নাসিরুল ইসলাম দাপ্তরিক কার্যক্রম করছেন। জানালেন, দিনে দুটি গাড়িতে মালামাল আসে। জনবলও কম। দুপুরের পরে দুজন মেইল অপারেটর আসবেন। রাত ১০টা পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা মেইলগুলো সটিং করবেন। এত সুন্দর ভবন ডাক বিভাগের কাজে গতি আনতে এত আয়োজন।

রেজিস্টার দেখে সাব রেকর্ড সুপারভাইজার নাসিরুল ইসলাম বলেন, দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ চিঠি সটিং করা হয় এই সেন্টারে। তবে পার্সেল সংখ্যা খুবই কম। এমনও দিন যায়, কোনো পার্সেলই আসে না। ঈদে দীর্ঘ বন্ধের পর রোববার ৬০টি ব্যাগে মেইল এসেছে। আর পার্সেল এসেছে মাত্র একটি।

এমপিসি ভবন প্রকল্পের ডেপুটি পরিচালক সূত্রে জানা যায়, শুধু দিনাজপুর নয়, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ডাক বিভাগের সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ১৪টি স্থানে এমপিসি নির্মাণ করা হয়। দিনাজপুরের সেন্টারটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৪ কোটি ৭৮ লাখ ২ হাজার ৭০০ টাকা। ২০১৯ সালের এপ্রিলে তৎকালীন ডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ঢাকার তেজগাঁওয়ে দেশের ১৪টি এমপিসির নির্মাণকাজের ফলক উন্মোচন করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডাক বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, সেন্টারটির প্রয়োজন ছিলে। অনেক বড় কলেবরে নির্মাণও করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ যদি ডাক বিভাগে সেবা নিতে না আসে, তাহলে এই ধরনের এমপিসিগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। পরিকল্পনার অভাব আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ডাক বিভাগ পিছিয়ে পড়েছে। এই সুযোগে ছোট একটি কক্ষে বসে নামে-বেনামে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো ব্যবসা করে যাচ্ছে।

দিনাজপুরের এমপিসি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন খুলনার ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল হাসানুজ্জামান। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে এই সেন্টার করা হয়েছে। তবে এর নির্মাণ ও অন্যান্য বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক ভালো বলতে পারবেন।

এ বিষয়ে উপপ্রকল্প পরিচালক শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘ডাক বিভাগে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র কমেছে এটা সত্য, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক চিঠিপত্র ও পার্সেল সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ডাকঘরের পাশাপাশি এমপিসি সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এমপিসি ছাড়া ডাকঘর ফাংশনাল করা সম্ভব নয়। দেশে ৯ হাজার ৮৮৬টি ডাকঘরে চিঠিপত্র, পার্সেল ইস্যু ও বিলির পাশাপাশি ডাক পণ্য সটিং ও পরিবহনের জন্য ২৩টি এমপিসি রয়েছে। অধিকাংশই রেলওয়ের জায়গায়। স্বাধীনতার পর কোনো এমপিসি নির্মাণ করা হয়নি। এসব বিবেচনায় ৬৪ জেলায় চিলার চেম্বারসহ এমপিসি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৪টি জায়গায় নির্মাণকাজ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য জেলাতেও করার পরিকল্পনা রয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র এমপ স র কর ড আসব ব ভবন র

এছাড়াও পড়ুন:

বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগম মারা গেছেন

কিশোরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগম মারা গেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বার্ধক্যজনিত কারণে মঙ্গলবার বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়া ইউনিয়নের বড়মাইপাড়া এলাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। সখিনা বেগমের বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।

তাঁর ভাগনি ফাইরুন্নেছা আক্তার বলেন, নিকলী উপজেলার গুরুই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সখিনা বেগম। তিনি নিঃসন্তান। মুক্তিযুদ্ধের আগেই তাঁর স্বামী কিতাব আলীর মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর সখিনা বেগম সশস্ত্র যুদ্ধে নামেন। নিকলীতে তাঁকে দেখভাল করার কেউ না থাকায় বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়ার বড়মাইপাড়া এলাকায় ভাগনি ফাইরুন্নেছার সঙ্গে থাকতেন।

নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহানা মজুমদার মুক্তি জানান, বিকেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগমকে গুরুই এলাকার কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কয়েকটি বইয়ের লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে সখিনা বেগমের ভাগনে মতিউর রহমান সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের হাতে শহীদ হন। ওই সময় সখিনা গুরুই এলাকায় বসু বাহিনীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রাঁধুনির কাজ করতেন। কাজের ফাঁকে রাজাকারদের গতিবিধির বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন। এক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে সেখান থেকে পালিয়ে যান। ধারালো দা দিয়ে নিকলীর পাঁচ রাজাকারকে কুপিয়ে হত্যা করেন সখিনা বেগম। ওই দা ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ