সম্প্রতি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে চুরির অভিযোগে এক নারীকে গাছে বেঁধে মারধর ও মাথার চুল কেটে দেওয়ার মতো অমানবিক ও নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবেশীর ফ্রিজ থেকে মাংস চুরির অভিযোগে প্রথম দফায় ওই নারীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে যান তাঁর স্বামী। রাত ৮টার দিকে ওই নারীর বাড়িতে ভাঙচুর করে তাঁকে তুলে আবার প্রতিবেশীর বাড়ি নিয়ে আসে একদল লোক। সেখানে তাঁকে মারধর করে মাথার চুল কেটে দেওয়া হয়। রাত ১০টার দিকে সালিশ বসান স্থানীয় ইউপি সদস্য। এ সময় মারধরের শিকার নারীর দুটি গরু, একটি ছাগল ও স্বর্ণালংকারের বিনিময়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘ষড়যন্ত্র করে চুরির নাটক সাজিয়ে আমার সঙ্গে অন্যায় করেছেন গ্রামের লোকজন। আমি বিচারের আশায় থানায় মামলা করেছি। মামলা তোলার জন্য সকলেই হুমকি দিচ্ছে।’
গত ১০ জুন (মঙ্গলবার) রাতে সাতজনকে আসামি করে মামলা করেন ভুক্তভোগী নারী। পরদিন সকাল ৯টার দিকে তিন নারী আসামিকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এরপর আসামিদের ছিনিয়ে নিতে বেলা ১১টায় থানা ঘেরাও করে শতাধিক মানুষ।
শিরীন হক
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান
সদস্য ও প্রতিষ্ঠাতা সভানেত্রী, নারীপক্ষ
আমরা এখনও সভ্য হতে পারিনি। একটি হলো– নারীকে আমরা এখনও মানুষ হিসেবে গণ্য করি না। অন্য বিষয়টি হলো– অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। নারীর ওপর সহিংসতার যে আলামত আমরা দেখছি, এই দুটো মিলেই সেটির কারণ। একদিকে আমরা সভ্য হলাম না, অন্যদিকে নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখলাম না।
আমাদের নারীপক্ষের একটি স্লোগানই আছে– নারীকে মানুষ হিসেবে চিনুন, জানুন, সম্মান করুন। সমাজ হিসেবে আমরা এই মানসিকতা এখনও অর্জন করতে পারলাম না। এত বছর ধরে নারী আন্দোলন করেও এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনটা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে আর কত বছর লাগবে জানি না। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সচেতনতা তৈরি করার জন্য কম টাকা খরচ করেনি। সেই সচেতনতা তৈরি হয়নি বলেই মনে হয়।
বহু পথনাটক, উঠান বৈঠক, বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারণা সত্ত্বেও আমরা সেটি অর্জন করতে পারলাম না। এটি আমাদের দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী বলব আমি জানি না। তারপরও চালিয়ে যেতে হবে আমাদের কাজ।
বর্তমানে ভার্চুয়াল জগতে সহিংসতা এক নতুন দুশ্চিন্তার কারণ। বিশেষ করে যুবনারীদের ক্ষেত্রে এই অভিযোগ বেশি শোনা যায়। ডিজিটাল সুরক্ষা আইন যেটি এখন হলো, সেটি কতটুকু এই ক্ষেত্রে সফলভাবে প্রয়োগ করা যাবে, তা এখনও বলা যাচ্ছে না। এটির মধ্যে দিয়ে নারী কতটা সুবিচার পেতে পারে সেটি এখনও পরিষ্কার না।
ভার্চুয়াল জগতে নারীকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, নানারকমভাবে ছোট করা হচ্ছে, যৌনবস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। সেটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য নারীরা কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? থানাতে আমরা সহজে যেতে চাই না। কারণ থানাগুলো নারীবান্ধব না। নারীপক্ষ অনেকদিন পুলিশের সঙ্গে প্রশিক্ষণের কাজ করেছে। থানাগুলোকে নারীবান্ধব করা যায়নি এখনও। আমাদের সংবিধানে ন্যায়পালের একটি পদ আছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এতো সরকার এলো, গেল কিন্তু ন্যায়পাল কেউ নিয়োগ দিল না। এটি যেমন একটি বিষয়, আরেকটি হচ্ছে সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা সুপারিশ করেছি যে, একটি স্থায়ী নারীবিষয়ক কমিশনের। যেটি স্বতন্ত্র হবে ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। সাংবিধানিক কমিশন হবে। তারা সংসদের কাছে জবাবদিহি হবে। এরকম একটি কমিশন যদি দাঁড় করানো যায়, তাহলে আমার মনে হয় কমিশন অনেক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারে। মনস্তাত্ত্বিক যে পরিবর্তন দরকার সমাজের, সেটিকে এগিয়ে নিতে পারবে। v
গ্রন্থনা: দ্রোহী তারা
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
অযত্নে অচল ১৮ আইসিইউ শয্যা
চট্টগ্রামে আবার চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস। ঈদুল আজহার পর হঠাৎ করে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। ইতোমধ্যে দু’জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শহর-গ্রামে করোনা মোকাবিলায় প্রস্তুতি কম। অনেক হাসপাতালে কিটের অভাবে হচ্ছে না পরীক্ষা। এ নিয়ে প্রিয় চট্টগ্রামের বিশেষ আয়োজন
নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) কয়েকটি শয্যা নড়বড়ে হওয়ায় রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। মরিচা পড়ে যায় শয্যার লৌহদণ্ডে। কোনোটির স্ক্রু ছিল ভাঙা, অনেক শয্যার চাকা থেকে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতিই ছিল নষ্ট। দীর্ঘদিন ধরে অকেজো পড়ে ছিল আইসিইউর গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম বাইপ্যাপ মেশিন, হাই ফ্লো ন্যাসাল ক্যানুলা, ইনফিউশন পাম্প, কার্ডিয়াক মনিটর, সিরিঞ্জ পাম্প। এখনও শয্যার সঙ্গে নেই ভেন্টিলেটর।
অযত্ন-অবহেলায় করোনা চিকিৎসার জন্য ‘ডেডিকেটেড’ চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ১৮ আইসিইউ শয্যার অবস্থা নাজুক। বর্তমানে করোনা চিকিৎসার জন্য শয্যা ও চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সচলের চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। এটা সময়সাপেক্ষ হওয়ায় করোনা পরীক্ষা ও যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। করোনা ইউনিটে ২২ জন চিকিৎসকের পদও এখন খালি।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর থেকে সরকারিভাবে হাসপাতালটিতে করোনা পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও সেটা হয়নি। এখন পরীক্ষা হলেও রয়েছে কিট ও জনবল সংকট।
আবার বন্দরনগর চট্টগ্রামে চোখ রাঙাচ্ছে করোনাভাইরাস (কভিড)। হঠাৎ করেই বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। এরই মধ্যে দু’জনের মৃত্যুতে কিছুটা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এতে নড়েচড়ে বসেছে স্বাস্থ্য প্রশাসন। তবে এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায়নি করোনা রোগীদের চিকিৎসা। চট্টগ্রামে আসেনি চাহিদামতো কিট। বর্তমানে প্রতিদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল ও করোনা ডেডিকেটেড জেনারেল হাসপাতালে অনেক রোগী করোনা পরীক্ষা করাতে এলেও কিট সংকটের কারণে তারা ফিরে যাচ্ছেন। জেনারেল হাসপাতালে পর্যাপ্ত কিট না থাকায় কয়েকদিন আগে চমেক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ৫০টি কিট এনে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালটি করোনা রোগীদের জন্য ‘ডেডিকেটেড’ বলা হলেও এটি এখনও করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। কয়েকদিন আগে চমেক হাসপাতাল থেকে একটি ভেন্টিলেটর ধার করে এনেছে হাসপাতালটি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক, কিটের চাহিদাপত্র পাঠানো হলেও আশানুরূপ সাড়া মেলেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জেনারেল হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল ১৮ আইসিইউ শয্যা। অনেক চিকিৎসা যন্ত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। বেশির ভাগ যন্ত্রই সচল অবস্থায় নেই। করোনা ইউনিটের জন্য যে ২২ জন চিকিৎসককে এই হাসপাতালে সংযুক্তিতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তারাও অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গেছেন। এখন ‘শূন্য’ চিকিৎসকদের সেই পদগুলো। তাই করোনা ডেডিকেটেড এই হাসপাতালটি পুরোপুরি চালু করতে আইসিইউ বিভাগের জন্য বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি নতুন প্রয়োজন হবে। নিয়োগ দিতে হবে চিকিৎসকও, যা সময়সাপেক্ষ।
এমন নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে করোনা রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড হাসপাতালটি পুরোপুরি প্রস্তুত করা চ্যালেঞ্জের মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় নষ্ট যন্ত্রপাতি সচল করে আপাতত পাঁচ থেকে ছয়টি আইসিইউ শয্যা চালু করতে চায় স্বাস্থ্য প্রশাসন। এজন্য কয়েকদিন ধরে তোড়জোড়ও শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২০ সালের দিকে করোনা মহামারির শুরুতে চট্টগ্রামে আইসিইউ শয্যার অভাবে বেশির ভাগ রোগী জরুরি মুহূর্তে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকায় তখন জেনারেল হাসপাতালে বিশেষায়িত করোনা চিকিৎসার জন্য ১০টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়। পরে এ সংখ্যা বাড়িয়ে ১৮ করা হয়। ২০২০ সালে করোনা ইউনিটের জন্য ২২ জন চিকিৎসক সংযুক্তিতে দেওয়া হলেও গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তাদের একসঙ্গে বদলি করা হয়। এরপর থেকে সেখানে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি।
করোনা রোগীর চাপ বাড়তে থাকায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের একমাত্র সদর এই হাসপাতালটিতে ডেঙ্গু ওয়ার্ডকে এখন করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হয়েছে। সাধারণ রোগীদের জন্য থাকা আইসিইউ শয্যায় চিকিৎসা পাবেন করোনা রোগীরাও।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক সংকটসহ নানা বিষয়ে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত আলাপ হচ্ছে। এগুলো পূরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে চিকিৎসক ও নার্স এনে ঘাটতি পূরণ করা হবে।’
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন বলেন, ‘আপাতত ডেঙ্গু ওয়ার্ডকে করোনা রোগীদের আইসোলেশন ওয়ার্ড করা হয়েছে। করোনা রোগীদের আইসিইউর প্রয়োজন হলে সেটিরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিটসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম চেয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। এরইমধ্যে কিছু এসেছে, আরও আসবে বলে জানানো হয়েছে।’
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আকরাম হোসেন বলেন, ‘করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখানে কয়েকজনকে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। ঢাকা থেকে একটি টিম এসেছে। তারা আইসিইউ বিভাগের নষ্ট-অচল যন্ত্রপাতিগুলো মেরামত করে ঠিক করার চেষ্টা করছেন। এরইমধ্যে ৫ থেকে ৬টি অনেকটা সচল হয়েছে। সংযুক্তিতে পাঁচজন চিকিৎসক দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, চিকিৎসকসহ যাবতীয় বিষয়ে আমি প্রতিনিয়ত উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছি। আশা করছি আগামীতে আরও কিছু যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছাবে।’