১৯৪০ সালের ১৪ নভেম্বর ব্রিটেনের কভেন্ট্রি শহরে লুফটওয়াফে (জার্মান বিমানবাহিনী) যে বিমান হামলা চালায়, সেটিকে তারা এক চমকপ্রদ প্রযুক্তিগত সাফল্য হিসেবে নিয়েছিল। জার্মান প্রচারমাধ্যম দাবি করেছিল, এটি ছিল ‘পুরো যুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা’।

নাৎসি জার্মানির প্রধান প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস এ হামলায় এতটাই আনন্দিত হয়েছিলেন যে তিনি ওই হামলার নামে ‘টু কভেনট্রেট’ নামে একটি নতুন শব্দ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তারপর খুব বেশি দিন না গড়াতেই জার্মানির সেই বিজয়ের আনন্দ ফিকে হয়ে যায়। কারণ, ব্রিটিশরা খুব দ্রুত অ্যারো ইঞ্জিন ও বিমান যন্ত্রাংশ উৎপাদনের কারখানাগুলো তাদের গোপন কারখানায় সরিয়ে ফেলে। ব্রিটিশদের উৎপাদনক্ষমতা কিছুটা ব্যাহত হলেও ধ্বংস হয়নি। কয়েক মাসের মধ্যেই এসব কারখানা আবার সম্পূর্ণ উৎপাদনে ফিরে যায়।

আজ আমরা জানি, জার্মানদের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল ব্রিটিশদের মনোবলকে খাটো করে দেখা। ব্রিটিশরা দ্রুতই পাল্টা আঘাত হানার দুর্দমনীয় দৃঢ়তা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। এর কিছুদিন পরেই রয়্যাল এয়ার ফোর্স (আরএএফ) জার্মানিতে বড় ধরনের বিমান হামলা শুরু করে।

আরও পড়ুনইরান, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—কে জিতল এই যুদ্ধে২৪ জুন ২০২৫

সেই পরিস্থিতি এখন ইসরায়েলে দেখা যাচ্ছে। ইরানে হামলার প্রথম ঘণ্টাগুলোতে যে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ ইসরায়েলের সামরিক কর্তৃপক্ষ দাবি করেছিল, মাত্র ১২ দিনের মাথায় সেই বিজয় এখন কৌশলগত পরাজয়ের মতো দেখাচ্ছে। সে কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও ইসরায়েল বারবার সেই চুক্তি মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।

এখন বোঝা যাচ্ছে, ইসরায়েল তাদের ঘোষিত তিনটি যুদ্ধলক্ষ্যের একটিও পূরণ করতে পারেনি।

প্রথমত, ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি ‘সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে’ বলে দাবি করলেও তার সপক্ষে এখনো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

বলা হচ্ছে, ইরান হামলার আগে অন্তত কিছু সেন্ট্রিফিউজ (পারমাণবিক সরঞ্জাম) নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমানে ইরানের ৪০০ কেজির বেশি উচ্চমাত্রার সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম মজুত আছে বলে যে ধারণা করা হয়ে থাকে, তা কতটুকু সত্য তা–ও স্পষ্ট নয়।

যে মুহূর্তে ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এটি স্পষ্ট করে দেয়, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (যা ইসরায়েলের দ্বিতীয় যুদ্ধলক্ষ্য ছিল) এখনো শক্তিশালী ও কার্যকর এবং ইসরায়েলের জন্য এটি এক স্থায়ী হুমকি।

দ্বিতীয়ত, ইসরায়েল যেসব ইরানি জেনারেল ও বিজ্ঞানীকে হামলার শুরুর দিকে হত্যা করেছিল, তাঁদের জায়গায় দ্রুত নতুন লোকদের বসানো হয়েছে।

তৃতীয়ত, সিএনএন গেল মঙ্গলবার জানিয়েছে, পেন্টাগনের গোয়েন্দা শাখার মূল্যায়নে বলা হয়েছে, মার্কিন বাহিনীর যেসব হামলা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো হয়েছিল, তাতে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল উপাদানগুলো ধ্বংস হয়নি। এ হামলা বড়জোর কয়েক মাসের জন্য ইরানের কার্যক্রম পিছিয়ে দিতে পেরেছে।

সুতরাং এ যুদ্ধের ফলে ইসরায়েলের অর্জনের চেয়ে ক্ষয়ক্ষতিই বেশি হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ইসরায়েল এখন আর এককভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার চিত্র আঁকতে পারছে না।

যদি কভেন্ট্রির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছু বোঝা যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ইরানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ও ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন কয়েক মাসের মধ্যে আবার চালু হয়ে যাবে। সেটি ‘অনেক বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে’ বলে যুক্তরাষ্ট্র যেমনটা বলছে, আসলে তা ঠিক নয়।

আরও পড়ুনইরানে হামলা ইসরায়েলের জন্য কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে ১৭ জুন ২০২৫

কারণ কী? কারণ, ইরানের হাতে প্রযুক্তি আছে, দক্ষতা আছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধার করার জাতীয় দৃঢ়সংকল্প আছে। অর্থাৎ ইরান ঝড়ের ধাক্কা সহ্য করে তারা টিকে গেছে।

যে মুহূর্তে ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এটি স্পষ্ট করে দেয়, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (যা ইসরায়েলের দ্বিতীয় যুদ্ধলক্ষ্য ছিল) এখনো শক্তিশালী ও কার্যকর এবং ইসরায়েলের জন্য এটি এক স্থায়ী হুমকি।

১২ দিনে ইসরায়েল ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় যতটা ক্ষতির শিকার হয়েছে, তা দুই বছর ধরে হামাসের দেশীয় রকেট বা মাসের পর মাস হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি।

এই ১২ দিনে ইসরায়েলি নাগরিকেরা ধ্বংসাবশেষ দেখেছে। তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকগুলো ভেঙে পড়েছে। বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। এই দৃশ্য তারা শুধু গাজা বা লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর দেখেছে। এখন সেই ধ্বংস তাদের নিজেদের ঘরেই হয়েছে। এটি তাদের জন্য বড় ধাক্কা।

আরও পড়ুনইরান কিছুই ভুলবে না, সব মনে রাখবে২৪ জুন ২০২৫

ইরান কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করেছে। একটি তেল শোধনাগার ও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আক্রান্ত হয়েছে। ইরান দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনাতেও হামলা চালিয়েছে। যদিও ইসরায়েলের কড়া সেন্সর নীতির কারণে এসব দাবি যাচাই করা কঠিন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইরানের শাসনব্যবস্থা এখনো অটুট। শুধু তা-ই নয়, ইসরায়েলের এই একতরফা ও বিনা উসকানির আক্রমণ ইরানের জনগণকে শাসকদের পেছনে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করেছে। জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ তাদের এক করেছে, বিভক্ত করেনি।

নেতানিয়াহুর আরেকটি তথাকথিত ‘সফলতা’ ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে জড়ানো। এখন সেটিই যেন বিষের পেয়ালা হয়ে উঠেছে।

তেল আবিবের একটি বড় মহাসড়কে ‘থ্যাংক ইউ, মিস্টার প্রেসিডেন্ট’ লেখা বিশাল ব্যানার ঝুলছে। কিন্তু যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নেতানিয়াহুর যুদ্ধযন্ত্রে হঠাৎ এক বিশাল ও অকাল ব্রেক কষে দিয়েছেন, তখন এই ব্যানার আর কত দিন থাকবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন২৫০০ বছরের পুরোনো দুশমনি: ইসরায়েল কি ‘মরদখাই’? ইরান কি ‘হামান’?১৭ জুন ২০২৫

১২ দিন আগে ট্রাম্প প্রথমে বলেছিলেন, ইসরায়েলের আকস্মিক ইরান আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই জড়িত নয়। কিন্তু পরে যখন দেখলেন, আক্রমণ সফল হচ্ছে, তখন নিজেকে এর অংশ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইলেন। তিনি বললেন, এই সাফল্য কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির জন্যই সম্ভব হয়েছে।

যুদ্ধ চলাকালে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি ইরানে ‘শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের’ বিরোধী নন। কিন্তু শেষ ২৪ ঘণ্টায় ট্রাম্পের অবস্থান একেবারেই অস্থির ছিল। তিনি একদিকে ইরানের কাছে ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ’ দাবি করেন, আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ইরানকে ধন্যবাদ দেন (কারণ, ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছিল, তারা কাতারের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে হামলা চালাতে যাচ্ছে)।

সবশেষে ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ‘আমাদের সময়ের শান্তি’ ফিরে এসেছে।
এতে এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে, ইসরায়েল আর আগের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ছক এককভাবে নির্ধারণ করতে পারছে না। ইরানের প্রতিরোধ, জনগণের ঐক্য ও আন্তর্জাতিক দৃশ্যপট এখন অনেকটাই বদলে গেছে।

ইসরায়েল চেয়েছিল, ইরানকে গাজার মতো একেবারে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবে। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পরই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধ থামানোর নির্দেশ দেন। এতে নেতানিয়াহুর সেই পরিকল্পনা আচমকাই থেমে যায়। গাজার ক্ষেত্রে যেমন ইসরায়েল ইচ্ছেমতো যুদ্ধ চালাতে পারে, ইরানের ক্ষেত্রে তেমনটা করতে পারেনি। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের আদেশ উপেক্ষা করার মতো অবস্থানে নেতানিয়াহু নেই।

ডেভিড হার্স্ট মিডল ইস্ট আইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক

মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র ইসর য় ল র র জন য কর ছ ল সবচ য়

এছাড়াও পড়ুন:

ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোথায় বাধা

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন বহু দশক ধরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়াও চলছে বহু দশক ধরে। ১৯৪৫ সালের পর জাতিসংঘের ১৪০টির বেশি সদস্যরাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। তার এ অবস্থান শুধু ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সম্পর্ককেই নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূরাজনীতি, আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান মূলত ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ নীতির ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অনিশ্চিত স্বীকৃতি, ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য দাবির পক্ষে পদক্ষেপ না নেওয়া, সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে সামরিক–অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সহায়তা করা মধ্যপ্রাচ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক।

যুক্তরাষ্ট্রের এ পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে। বিপরীতে, ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে শক্তিশালী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একগুঁয়ে ও বেপরোয়া রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এ নীতি।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের অবস্থান

২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে ‘সদস্যবহির্ভূত পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পরে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৩৮টি দেশ ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ অর্জনের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করা হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা ভেটো দিয়ে থামায়।

পরবর্তী মাসে (মে ২০২৪) সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাব ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের ‘পূর্ণ সদস্য হওয়ার যোগ্য’ হিসেবে বিবেচনা ও নিরাপত্তা পরিষদকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহী হতে বলে।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৪৭টি রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে জাতিসংঘে পূর্ণ সদস্যপদ এখনো হয়নি ফিলিস্তিনের। চলতি সপ্তাহে শুরু হতে যাওয়া সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আরও কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে চলেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র এতে খুশি নয়।

ঐতিহাসিক পটভূমি: ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’

বিশ শতকের শেষ ভাগ থেকে ‘দুই রাষ্ট্রের সমাধান’ ফিলিস্তিন–ইসরায়েল শান্তিপ্রক্রিয়ার মূল কাঠামো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব প্রশাসন মূলত এই নীতিকে সমর্থন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বলে এসেছে যে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে হতে হবে, একতরফা বা আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমে নয়।

১৯৪৮ সালে দখলদার ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠা, ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধ ও ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তিচুক্তি—সব মিলিয়ে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধানের’ রূপরেখা তৈরি হয়েছে।

মার্কিন প্রশাসনের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাদের দাবি, একতরফাভাবে স্বীকৃতি শান্তি আলোচনায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে, ‘উগ্রপন্থী’ গোষ্ঠীকে উৎসাহিত করতে পারে এবং সীমান্ত, নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি করতে পারে।

ফিলিস্তিনি জনগণও সমান অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের যোগ্য। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তাদের সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েল কৌশলগত সম্পর্ক

যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিস্তিন নীতি প্রায়ই তার ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কৌশলগত সম্পর্ক দিয়ে প্রভাবিত। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাষ্ট্র সেনা সাহায্য, উন্নত অস্ত্র সরবরাহ, গোয়েন্দা তথ্য ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে দেশটিকে।

এই সমর্থনের মধ্যে শুধু মার্কিন অস্ত্র বিক্রি নয়; ইসরায়েলকে সাইবার নিরাপত্তা, সামরিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধকৌশলীয় পরামর্শ প্রদানও রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, একতরফা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া হলে ইসরায়েলের সঙ্গে এ কৌশলগত জোটে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ লক্ষণ তৈরি হতে পারে। ইসরায়েলপন্থী লবিগুলো, যেমন ‘এআইপিএসি’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখে।

ফিলিস্তিন সরকারের সক্ষমতা

যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করে। দেশটির যুক্তি, ফাতাহ (পশ্চিম তীর) ও হামাসের (গাজা) মধ্যে বিভাজন ফিলিস্তিনের স্বীকৃতির জন্য উপযুক্ত নয়। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে মনে করে।

গাজা ও পশ্চিম তীরে প্রশাসনিক অচলাবস্থা, মানবিক সংকট, বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের অভাব—এসবও ফিলিস্তিনকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিচালিত হতে ব্যর্থ করবে বলে বিশ্বাস যুক্তরাষ্ট্রের। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও ফিলিস্তিনের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনা চ্যালেঞ্জপূর্ণ হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থান পশ্চিমা ও আরব জোটের মধ্যেও বিভাজন বাড়িয়েছে, শান্তিপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আন্তর্জাতিক মর্যাদা সীমিত করেছে।

আন্তর্জাতিক আইন ও আদালতের প্রভাব

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) ২০২৪-এর পরামর্শমূলক রায় হলো, ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরায়েলের ফিলিস্তিনি অঞ্চল (গাজা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম) দখল করা অবৈধ। ইসরায়েলকে দ্রুত এ দখল ছাড়তে হবে। আবার দখলকৃত স্থানে ইহুদি বসতি নির্মাণ, এর সম্প্রসারণ ও শিক্ষানীতি বৈধ নয়।

এদিকে ২০১৫ সালে রোম সনদে স্বাক্ষর করেছে ফিলিস্তিন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) গাজা ও পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্তের এখতিয়ার দিয়েছে।

এসব আইনি ভিত্তি শক্তিশালী হলেও ফিলিস্তিনকে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাধা এখনো রয়ে গেছে।

ইসরায়েলের দখলকৃত জেরুজালেমে বিশ্ব মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ আল–আকসা

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘আরব’ বা ‘মুসলিম ন্যাটো’ এবার কি আলোর মুখ দেখবে
  • বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগে ডিন নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি
  • ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোথায় বাধা